বৃহস্পতিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

জলবায়ুর মারাত্মক ঝুঁকিতে ১৬ কোটি মানুষ : প্রধানমন্ত্রী

মিয়ানমারের বাহানায় রোহিঙ্গা ফেরতে বিলম্ব

রুহুল আমিন রাসেল ও কাজী শাহেদ, নিউইয়র্ক থেকে

জলবায়ুর মারাত্মক ঝুঁকিতে ১৬ কোটি মানুষ : প্রধানমন্ত্রী

জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে করমর্দনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

বাংলাদেশের প্রায় ১৬ কোটি মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে মারাত্মক ঝুঁকিতে থাকার কথা জাতিসংঘে তুলে ধরেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তিনি বলেছেন, বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। বাংলাদেশের জন্য জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সৃষ্ট সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সহায়তা প্রয়োজন। একই সঙ্গে কৃষি, জনস্বাস্থ্য, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মতো ক্ষেত্রে প্রযুক্তি উন্নয়ন ও হস্তান্তর প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষয়ক্ষতি নিরসনে প্যারিস চুক্তি মেনে চলতে বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। গতকাল নিউইয়র্কের জাতিসংঘ সদর দফতরে অনুষ্ঠিত প্যারিস চুক্তি সিওপি-২৪ বাস্তবায়ন সংক্রান্ত সদস্যদের উচ্চ পর্যায়ের আলোচনায় এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি আগামী ২০২০ সাল পূর্ব উচ্চাভিলাষ এবং প্যারিস চুক্তি মেনে চলার মাধ্যমে জলবায়ু অর্থায়নের ওপর আলোচনায় গুরুত্ব দিতে পোল্যান্ডে এ বছরের শেষ নাগাদ অনুষ্ঠিতব্য সিওপি-২৪ এর সুযোগ কাজে লাগাতে জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের নেওয়া স্বল্প কার্বন কর্মসূচির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই প্রায় ৬০ লাখ সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন করেছে। দরিদ্র মানুষের মধ্যে ২০ লাখ উন্নত মানের রান্নাবান্নার স্টোভ বিতরণ করেছে।

শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর সরকার জলবায়ুজনিত সমস্যা এবং দুর্যোগ ঝুঁকি কমিয়ে আনতে জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। এবং জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় জিডিপির ১ শতাংশ এ খাতে বরাদ্দ দিয়েছে। সরকার জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের ফলে অভিযোজন ও প্রশমনে কৃষিতে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে কৃষি সময়োপযোগী করতে নিজস্ব অর্থায়ন থেকে ৪৫ কোটি মার্কিন ডলার বরাদ্দ দিয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় জলবায়ুজনিত পরিস্থিতি সহিষ্ণু বিভিন্ন ধরনের শস্য উদ্ভাবন করা হচ্ছে।

খাদ্য নিরাপত্তা ও সুশিক্ষা বড় চ্যালেঞ্জ : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও সুশিক্ষা নিশ্চিত করাই আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ভূখণ্ডের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর দেশ। এই জনগোষ্ঠীকে প্রযুক্তিসমৃদ্ধ করা প্রয়োজন, যাতে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাদের কর্মসংস্থানের নিরাপত্তা নিশ্চিত হতে পারে।’ মঙ্গলবার বিকালে  জাতিসংঘ সদর দফতরের প্লেনারি হলে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) আয়োজিত ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে টেকসই উন্নয়ন’ শীর্ষক প্লেনারি সেশনে দেওয়া ভাষণে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক সাংবাদিকদের এ বিষয়ে ব্রিফ করেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট এনরিক পেনা নিয়েতো, হল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুস্ট, জনসন অ্যান্ড জনসনের সিইও এবং মজিলা ফায়ার ফক্সের সিইও প্রমুখ অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। এদিকে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমার তালবাহানা করছে।

প্রধানমন্ত্রীকে ডব্লিউইএফের বার্ষিক সভায় আমন্ত্রণ : ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) প্রেসিডেন্ট বোর্গে ব্রেনডি আগামী জানুয়ারিতে সুইজারল্যান্ডের দাভোসে অনুষ্ঠেয় ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বার্ষিক সভায় যোগদানের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। মঙ্গলবার বিকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার নিউইয়র্কে অবস্থানকালীন হোটেল গ্রান্ড হায়াতে সৌজন্য সাক্ষাতে ব্রেনডি এ আমন্ত্রণ জানান। বৈঠকের পর পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। ডব্লিউইএফ প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীকে জানান, প্রায় ১০০ দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান এবং সেই সঙ্গে বৃহৎ বিনিয়োগকারীরা এই বার্ষিক অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। বাংলাদেশ এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাদের দেশে বিনিয়োগ ও উন্নয়নকে আরও ত্বরান্বিত করতে পারে।

নেদারল্যান্ডসের রানী ম্যাক্সিমার সঙ্গে বৈঠক : একই দিন প্রধানমন্ত্রী নেদারল্যান্ডসের রানী ম্যাক্সিমার সঙ্গে বৈঠক করেন। রানী ম্যাক্সিমা, একইসঙ্গে যিনি জাতিসংঘ মহাসচিবের সামাজিক অন্তর্ভুক্তিমূলক কার্যক্রমের বিশেষ দূত, প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিমূলক সূচকে এগিয়ে আছে। তিনি এ বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কার্যক্রম অব্যাহত রাখার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করেন। এলজিআরডি ও সমবায়মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ডা. দীপু মনি, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. নজিবুর রহমান এ সময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন।

বরাদ্দ কমলে শান্তিরক্ষা বাধাগ্রস্ত হবে :জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বরাদ্দ না কমানোর আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, বরাদ্দ কমানো হলে তা বিশ্বের বিরোধপূর্ণ এলাকাগুলোয় শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য বাধাগ্রস্ত করবে। এ জন্য বিশ্বনেতাদের সতর্ক করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। মঙ্গলবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে তিনি এ কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে খরচ এবং কর্মীর সংখ্যা কমালে তা শান্তি মিশনের কাজে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। শান্তিরক্ষায় সামনের সারিতে যারা কাজ করছে; তাদের উদ্বেগের বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে শুনতে হবে। সংঘাতপ্রবণ এলাকার মানুষের জানমাল রক্ষার পাশাপাশি শান্তি ফিরিয়ে আনতে ভূমিকার জন্য জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের ভূমিকা বরাবর প্রশংসা পেলেও বাজেট স্বল্পতার কারণে শান্তিরক্ষীদের নিরাপত্তা ও তাদের কর্মক্ষমতায় অনেক ক্ষেত্রে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের উদ্যোগে ‘অ্যাকশন ফর পিস কিপিং’ শীর্ষক ওই বৈঠকে শান্তি মিশনের গুরুত্ব তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, শান্তিরক্ষা কার্যক্রম বিশ্বের মানুষের মঙ্গলের জন্য। সুতরাং এ কার্যক্রমের মর্যাদা রক্ষায় অবশ্যই ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে কাজ করতে হবে। বহু মানুষের জীবনে জাতিসংঘের এই শান্তিরক্ষা কার্যক্রম আশার আলোকবর্তিকা। তাই এটাকে আমাদের অবশ্যই সম্মান জানাতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, শান্তিরক্ষীদের এমন সব জায়গায় পাঠানো হয়, যেখানে অশান্তি বিরাজ করছে। সেখানে তাদের নানা ধরনের অরাজকতা ও হুমকির মোকাবিলা করতে হয়। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন মানের সেনা সদস্যরা  শান্তিরক্ষা মিশনে পাশাপাশি কাজ করে। এসব বিষয় শান্তিরক্ষা কার্যক্রমকে কঠিন ও বিপজ্জনক করে তোলে। এ কারণে শান্তিরক্ষীদের স্পষ্ট নির্দেশনা দিতে হবে। আর সেই দায়িত্ব পালনে তাদের যথেষ্ট কর্তৃত্ব এবং আধুনিক সরঞ্জামে সজ্জিত করতে হবে। মোতায়েনের ক্ষেত্রে তাদের দক্ষতা ও আন্তরিকতা বিবেচনায় নিতে হবে। তাদের নিরাপত্তা অবশ্যই বাড়াতে হবে। জাতিসংঘ মহাসচিবের দায়িত্ব নেওয়ার পর অ্যান্তোনিও গুতেরেস শান্তি মিশনে শান্তিরক্ষীদের প্রাণহানির উচ্চ হার দেখে উদ্বেগ প্রকাশ করে অ্যাকশন ফর পিস কিপিং (এফোরপি) নামের এ উদ্যোগ নেন। এফোরপি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীদের তাদের কাজের জন্য আরও উপযুক্ত করে তুলবে—এ প্রত্যাশা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, শান্তি মিশনের কার্যক্রম এগিয়ে নিতে সদস্য দেশগুলোকে তাদের যৌথ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে হবে যথাযথভাবে। আর অর্পিত দায়িত্ব পালনে বাংলাদেশ সবসময়ই প্রস্তুত। এ বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য জাতিসংঘ মহাসচিবকে ধন্যবাদ জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রম আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শান্তি রক্ষায় জাতিসংঘের আহ্বানে সাড়া দিতে বাংলাদেশ কখনো ব্যর্থ হয়নি। শান্তিরক্ষায় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমাদের অনেক শান্তিরক্ষীকে প্রাণ দিতে হয়েছে। তবু দায়িত্ব পালনে আমরা কখনো পিছপা হইনি। এখন আমরা সম্ভব স্বল্পতম সময়ে আমাদের শান্তিরক্ষী মোতায়েন করতে পারি। যে কোনো চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতির দ্রুত মোকাবিলা করার মতো প্রশিক্ষণ তাদের দেওয়া হয়। যেখানে তারা যায়, মানুষের হৃদয় ও মন জয় করতেই তারা কাজ করে। বৈঠকে শেখ হাসিনা বলেন, নিজেদের নিরাপদ রাখার সক্ষমতা শান্তিরক্ষীদের থাকতে হবে। প্রয়োজনে বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষা করার কাজটি তাদের করতে হবে।

 এ বিষয়টি মাথায় রেখে মালিতে শান্তিরক্ষীদের সুরক্ষায় মাইন প্রতিরোধক যানবাহন সরবরাহ করার কথা তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। ব্যক্তিগত আগ্রহে শান্তিরক্ষা মিশনে নারী সদস্যের সংখ্যা বাড়ানোর কথাও বলেন তিনি।

 প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা কঙ্গোতে প্রথম নারী হেলিকপ্টার পাইলট পাঠিয়েছি। এটি আমাদের জন্য একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। শান্তি মিশনে যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করে।  এর মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প সরকার জাতিসংঘ ও শান্তি মিশনের জন্য বরাদ্দ কমিয়ে আনার পথে হাঁটছে। গত বছর যুক্তরাষ্ট্র শান্তিরক্ষা মিশনের মোট বাজেটের ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ দিতে রাজি হলেও ডিসেম্বরে তা ২৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার কমানোর ঘোষণা দেয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মঙ্গলবারও জাতিসংঘে তার বক্তৃতায় বলেছেন, শান্তি মিশনের মোট বাজেটের ২৫ শতাংশের বেশি তার দেশ দিতে রাজি নয়।

সর্বশেষ খবর