সমরেশ মজুমদারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন আলতাফ হোসেন। আলতাফ হোসেন সাহেবের ডাকনাম মিনু। আমরা ডাকতাম মিনুভাই। পার্ল পাবলিকেশন্সের মালিক। অত্যন্ত প্রাণবন্ত এবং হৃদয়বান মানুষ। বইয়ের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন অল্প বয়স থেকেই। চিরকুমার। বড় বোনের বাড়িতে থাকতেন। বোন তাকে ছেলের মতো স্নেহ করতেন, ভালোবাসতেন। মিনুভাই তার ভাগনে-ভাগনিদের আপন সন্তানের মতো ভালোবাসতেন। পার্ল পাবলিকেশন্সের বাংলা বাজারের শোরুমে ভাগনে তুহিনকে মাঝে মাঝে নিয়ে এসে বসাতেন। সেই তুহিন এখন পার্ল পাবলিকেশন্সকে আরও বড় করেছে।
আহা, আমাদের মিনুভাই অল্প বয়সে চলে গেলেন।
সেই বিকেলটির কথা পরিষ্কার মনে আছে। ঊননব্বই বা নব্বই সাল। বাংলা একাডেমির বইমেলা চলছে। সমরেশ মজুমদার এসেছেন ঢাকায়। মিনু ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর আগেই পরিচয় ছিল। মিনু ভাইয়ের স্টলসমরেশদার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘এই আমি রেণু’। থ্রিলারধর্মী রোমান্টিক উপন্যাস। পড়ে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। ফাঁকে ফাঁকে পড়ছিলাম তার গল্প। তারপর তাঁর সেই বিখ্যাত ট্রিলজির প্রথম পর্ব ধারাবাহিকভাবে ছাপা শুরু হলো দেশ পত্রিকায়। ‘উত্তরাধিকার’। তখন দেশ পত্রিকা সাপ্তাহিক। এক পর্ব পড়ে সারা সপ্তাহ পাগলের মতো অপেক্ষা। অসামান্য উপন্যাস। দ্বিতীয় পর্ব ‘কালবেলা’। নকশাল আন্দোলন পরিষ্কার হয়ে উঠল চোখের সামনে। একদিকে গভীর প্রেম আরেকদিকে আন্দোলন। মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখার মতো লেখা। তখন পর্যন্ত তৃতীয় পর্ব ‘কালপুরুষ’ লেখা শুরু হয়নি। এই প্রিয় লেখক বাংলাদেশে? পরিচয়ের মুহূর্তেই তিনি আমার কাঁধে হাত দিলেন। তা কী লিখছ এখন? আমি প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বললাম, তুমি কী লিখছ? বয়সে চৌদ্দ-পনেরো বছরের বড় একজন লেখককে তুমি করে বলে ফেললাম। সমরেশদা কিছু মনেই করলেন না। অনেকক্ষণ গল্প হলো। এক বিকেলেই গভীর বন্ধুত্ব হয়ে গেল সমরেশদার সঙ্গে। কলকাতায় গেলে প্রতিটি সন্ধ্যা তাঁর সঙ্গে। ঢাকায় এলে সন্ধ্যা তো বটেই কখনো কখনো সারাদিন একসঙ্গে। আমার গেন্ডারিয়ার ফ্ল্যাটে গিয়েছেন অনেকবার। রফিক আজাদ, হুমায়ূন আহমেদ, মিনুভাই আরও কেউ কেউ সারাদিন আড্ডা দিয়েছি আমরা। সমরেশদা ঢাকায় এলেই হুমায়ূন ভাইয়ের ফ্ল্যাটে আড্ডা হতো নিয়মিত। একবার মিনুভাই আমাদের নিয়ে গেলেন আমার এলাকা বিক্রমপুরে। শ্রীনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ছিলেন মিনু ভাইয়ের আত্মীয়। তাঁর আতিথেয়তায় দিন কাটল আমাদের। নৌ-ভ্রমণ হলো পদ্মায়।
নরসিংদীর বিখ্যাত রাজনীতিবিদ রাজিউদ্দীন রাজু আমাদের রাজুভাই মিনুভাইয়ের আত্মীয়। রাজু ভাইয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব হলো সমরেশদার। প্রায়ই রাজুভাই আমাদের এদিক-ওদিক বেড়াতে নিয়ে যেতেন। একবার দীর্ঘ নৌকা ভ্রমণ হলো ভৈরব ব্রিজ পর্যন্ত।
সমরেশদার সঙ্গে কতদিনকার কত মধুর স্মৃতি। হুমায়ূন আহমেদ এবং আমাকে কলকাতার পত্রপত্রিকায় লেখার ব্যবস্থা করেছিলেন সমরেশদা। আমাদের নিয়ে ‘দেশ’ এবং ‘বর্তমান’ পত্রিকায় বেশ কয়েকটি লেখা লিখেছিলেন।
তিনবার সমরেশদার সঙ্গে নিউইয়র্কে যাওয়া হয়েছে আমার। প্রথমবার আমি উঠেছিলাম আমার বড় বোনের বাড়িতে। এক সন্ধ্যায় সমরেশদাকে নিয়ে গেলাম ব্রুকলিনের সেই বাড়িতে। আমার দুলাভাইয়ের সঙ্গে খুবই বন্ধুত্ব হলো তার। দুই ভাগনি সমরেশদার ন্যাওটা হয়ে গেল। সমরেশদা আমাদের পারিবারিক বন্ধু হয়ে গেলেন। আর এই ফাঁকে ফাঁকে সমরেশ মজুমদার জনপ্রিয়তার শীর্ষে আরোহণ করতে লাগলেন। উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষের পর দুই পর্বে লিখলেন ‘সাতকাহন’ নামে আরেক অসামান্য উপন্যাস। এই উপন্যাস তাঁর জনপ্রিয়তায় নতুন মাত্রা যোগ করল। লিখলেন ‘গর্ভধারিণী’। প্রায় লাখখানেক কপি বিক্রি হলো এই উপন্যাসের। দুই বাংলার জনপ্রিয়তম লেখক সমরেশ মজুমদার। বাংলাদেশের সঙ্গে, বাংলাদেশের পাঠকদের সঙ্গে তাঁর অসাধারণ সম্পর্ক। বছরে একবার-দুবার তিনি বাংলাদেশে আসেনই। ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ সম্পাদক নঈম নিজামকে খুবই ভালোবাসেন সমরেশদা। ঢাকায় এলে নঈম তাঁকে ঢাকা ক্লাবে রাখেন। ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ থেকে বড় সম্মাননাও দেওয়া হয়েছে তাঁকে। বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রত্যেক ঈদ সংখ্যায় তিনি উপন্যাস লেখেন। মাঝে মাঝে কলাম লেখেন। এখনো তাঁর জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী।
এপিজে অক্সফোর্ড বুকস আয়োজিত সাহিত্য উৎসবে গেছি গত বছর। এক সেমিনারে সমরেশদা এলেন। তাঁকে দেখে আমি চমকে উঠলাম। স্বাস্থ্যবান সুপুরুষ মানুষটি যেন রাতারাতি ভেঙেচুরে গেছেন। একটু পা টেনে টেনে হাঁটছিলেন। আমি ছুটে গিয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরলাম। তুমি এমন হয়ে গেছ কেন সমরেশদা? সমরেশদা হাসিমুখে বললেন, শরীরটা ভালো যাচ্ছে না।
আমরা দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। মঞ্চে উঠে সমরেশদা হুমায়ূন আহমেদের কথা বললেন, আমার কথা বললেন, আমাদের নিয়ে স্মৃতিচারণ করলেন। প্রতিটি শব্দে ঝরে পড়ছিল আমাদের জন্য তাঁর অপরিসীম মমত্ববোধ এবং ভালোবাসা।
সমরেশদা, বাংলাদেশের সাহিত্যের পাঠকরা তোমাকে খুব ভালোবাসে। হুমায়ূন আহমেদ তোমাকে খুব ভালোবাসতেন। আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি। এত মানুষের ভালোবাসা যে লেখক পান, জগৎ-সংসারে তাঁর আর কী চাওয়ার থাকতে পারে? তুমি দীর্ঘজীবী হও। তোমার হাতের সোনার কলম অক্ষয় হোক।