মঙ্গলবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়

মোহন রায়হান

ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়

ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তান সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের অধিকারকে পদদলিত করে তার শাসন-শোষণ-নিপীড়ন স্থায়ী রূপ দিতেই হাজার বছরের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানে। বাঙালির মায়ের ভাষা, মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিতে চায়। শান্তিকামী বাঙালি সেটা মেনে নেয় না। বরং প্রতিবাদে, প্রতিরোধে গর্জে ওঠে। গানে, কবিতায়, স্লোগানে, বক্তৃতায় উত্তাল হয়ে ওঠে সমগ্র দেশ। পরিশেষে লাল রক্তে ¯œান করে জীবন ঢেলে দেয় রাজপথে। রফিক, শফিক, বরকত, সালামসহ শহীদদের বুকের উষ্ণ রক্তস্রোত বেয়ে ১৯৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রাম। নতুন দেশ, নতুন রাষ্ট্র, নতুন স্বপ্ন, আশা-আকাক্সক্ষা কিন্তু স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও সমতা, সামাজিক ন্যায় বিচার এবং মানবিক মূল্যবোধ আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সঙ্গত কারণেই মাতৃভাষা বাংলাভাষা আজও স্বমহিমায় সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠা পায়নি। বরং পাকিস্তানি প্রেতাত্মা যেন ভর করে আছে সর্বত্র! স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস, আদালত, প্রশাসন, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান কোথাও বাংলাভাষা পূর্ণ প্রতিষ্ঠা পায়নি। বরং অপ ও বিকৃত ব্যবহারে বাংলাভাষা আজ হুমকির মুখোমুখি। বাংলা ব্যবহারে গৌরব ও আনন্দের বদলে লজ্জা এবং বিষাদ অনুভব করে এরা।

বর্তমান পুঁজিবাদী বিশ্বের ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থায় পণ্য নির্ভর জীবনে কতভাবে, কীভাবে মানুষকে শোষণ করা যায় পুঁজিবাদী দেশগুলোর এবং দেশীয় পণ্য উৎপাদন প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়তই নিত্য নতুন গবেষণার মাধ্যমে সেসব আবিষ্কার করে। বিজ্ঞান যেমন তার নতুন নতুন আবিষ্কারের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী মানুষের জীবন সহজ করে দিয়েছে আবার তাকে জটিল কঠিন দুরূহও করে তুলেছে। অর্থাৎ বিজ্ঞানের আশীর্বাদ এবং অভিশাপ উভয়েরই ফল ভোগ করছে মানুষ। তথ্য-প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের প্রতীক- কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসআপ, ভাইবার, উইচ্যাট, ইমু ইত্যাদি। যা আমাদের সারা বিশ্বকে মুহূর্তের মধ্যে হাতের মুঠোয় এনে দিচ্ছে কিন্তু বিদেশি অপসংস্কৃতির সহজ অনুপ্রবেশ আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে কীভাবে গ্রাস করছে, ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে তা একবার আমাদের গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার। বিশেষত আমাদের বালক, বালিকা, কিশোর ও যুবকদের কী ভয়ানক ক্ষতির কারণ তা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়! বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা তথা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে তাদের কতটুকু দূরে নিয়ে যাচ্ছে তাকি আমরা একবারও ভাবি? রেডিও, টিভি এবং ব্যক্তি জীবনে কতিপয় বাঙালির বীভৎস বাংলা উচ্চারণ শুনলে গা ঘিনঘিন করে, বমি আসে, মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে। ইচ্ছে করে একাত্তরের মতো আবার স্টেনগানের ট্রিগারে আঙ্গুল রাখি। গ্রেনেডের মতো গর্জে উঠি ভয়ানক বিস্ফোরণে।

বাংলা ভাষার যথার্থ চর্চা এবং ব্যবহার আজ কোথাও দেখি না। ফলে দিন দিন গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে  বাংলাভাষা। সাধারণ মানুষ এবং কতিপয় বাংলা-প্রেমিক  ছাড়া  কারও কাছেই বাংলার কোনো কদর  নেই।

ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত আর দুই লাখ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে আজ আবার উচ্চারণ করতে হচ্ছে- ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়।’ লেখক : কবি

সর্বশেষ খবর