শনিবার, ৩ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

ডেঙ্গু মোকাবিলায় সমন্বয়হীনতা

হাসপাতালে কিটের অভাবে ভোগান্তি, ঘাটে ঘাটে সংকট, মন্ত্রীদের বিভ্রান্তিকর বক্তব্য

জয়শ্রী ভাদুড়ী

ডেঙ্গু মোকাবিলায় সমন্বয়হীনতা

প্রতিদিন বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালেও গাদাগাদি করে রাখা হয়েছে রোগীদের -জয়ীতা রায়

দেশের ৬৪ জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু জ্বর। রাজধানী এবং জেলা-উপজেলার হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু শনাক্তের অপরিহার্য উপকরণ কিট সংকটে তৈরি হয়েছে ভোগান্তি। প্রতিদিন প্রায় দেড় হাজার মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হলেও নেই কোনো সমন্বিত উদ্যোগ। দায় এড়াতে দোষারোপ আর অসঙ্গতিপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে চলেছেন মন্ত্রী এবং মেয়ররা। এ সমন্বয়হীনতার সুযোগে মরণ কামড় বসাচ্ছে ডেঙ্গু।

এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, মশক নিধনে একযোগে উদ্যোগ নিতে হবে। এক দিন উত্তরে ওষুধ ছিটালে মশা দক্ষিণে যাবে আর দক্ষিণে ছিটালে উত্তরে যাবে। তাই একযোগে পুরো রাজধানীতে এডিস মশার উৎস এবং বসবাসের স্থান ধ্বংস করতে হবে। সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ না করলে কখনো ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন্স সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ বছর ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে ২১ হাজার ২৩৫ জন। গত ২০ বছরের রেকর্ড ভেঙে এবারই প্রথম এত মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে। বেসরকারি হিসাবে আক্রান্তের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়েছে। এর মধ্যেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ৫৫ জন মারা গেছেন। শুক্রবার ভোর রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত এক অন্তঃসত্ত্বা নারী  মারা গেছেন। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, তার নাম মালিহা মাহফুজ। তিনি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে প্রথমে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। পরে অবস্থার অবনতি হওয়ায় ২৫ জুলাই বিএসএমএমইউতে আনা হয়। শুক্রবার ভোর রাতে তিনি মারা যান। এ ছাড়া নোয়াখালীতে মোশারফ হোসেন নামে একজনের মৃত্যু হয়েছে।

এত বিপুলসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হওয়ায় হাসপাতাল-ডায়াগনোস্টিক সেন্টারগুলোতে দেখা দিয়েছে কিট সংকট। রাজধানীর ন্যাশনাল মেডিকেল ইনস্টিটিউট কলেজ হাসপাতালে কিট সংকটের কারণে ব্যাহত হচ্ছে ডেঙ্গু নির্ণয় টেস্ট। রোগীদের রক্ত সংগ্রহ করার পর দেখা যায় কিট সংকট। এ ব্যাপারে ঢাকা-৬ আসনের সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, আমাদের এলাকার এই হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের অনেক চাপ রয়েছে। কিন্তু এত রোগীর জন্য পর্যাপ্ত কিট পাওয়া যাচ্ছে না। পরবর্তীতে হাসপাতালের পাশের ডায়াগনোস্টিক সেন্টার পপুলারের সঙ্গে চুক্তি করা হয় রোগীদের ডেঙ্গু টেস্ট করে দেওয়ার ব্যাপারে। কিন্তু দুপুরে তারা জানায় কিট শেষ হওয়ায় তাদের পক্ষেও আর ডেঙ্গু টেস্ট করা সম্ভব নয়। এদিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য শিক্ষার্থী গায়ে জ্বর নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন কিনা টেস্ট করার জন্য। দ্রুত কিট আমদানি করে হাসপাতাল-ডায়াগনোস্টিক সেন্টারগুলোতে সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। রাজধানীর গি  পেরিয়ে জেলা-উপজেলাগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু। ডেঙ্গু জ্বরে গ্রামে-গঞ্জে মানুষ আক্রান্ত হলেও জেলা সদর হাসপাতালে পৌঁছেনি ডেঙ্গু টেস্টের কিট। পটুয়াখালীর নূর ইসলাম এবং হামিদা বেগম তিন দিন ধরে জ্বরে আক্রান্ত। শরীরে ব্যথার সঙ্গে ডেঙ্গুর উপসর্গগুলো দেখা দেওয়ায় পটুয়াখালী সদর হাসপাতালে গিয়েছিলেন টেস্ট করার জন্য। কিন্তু কিট না থাকায় তাদের ফেরত পাঠানো হয়েছে। তাই চিকিৎসার জন্য অসুস্থ শরীরে এখন ঢাকায় ছেলের বাসায় আসতে হচ্ছে তাদের। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, সারা দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পাওয়ায় রোগ শনাক্তকরণে কিট আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সাতটি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ১ কোটি ৬১ লাখ পিস কিট আমদানির পূর্বানুমোদন দিয়েছে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। গত বৃহস্পতিবার মেসার্স এসটিপি নামে ৬৫ হাজার পিস, মেসার্স সোহাগ সার্জিক্যালের নামে ৬ হাজার ৫০০ পিস আমদানিকৃত কিট দেশে এসে পৌঁছেছে। গতকাল মেসার্স হেলথ কেয়ার ডায়াগনোস্টিক সলিউশন লিমিটেডের নামে ২ লাখ ২৫ হাজার পিস, মেসার্স অরবিটাল ইন্টারন্যাশনাল করপোরেশনের নামে ২ লাখ পিস কিট দেশে এসে পৌঁছানোর কথা রয়েছে। এর মধ্যেই ডেঙ্গু জ্বরে রাজধানীর বাইরে রোগী মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। কিট না থাকায় অনেকেই ডেঙ্গু নির্ণয়ের আওতায় আসছেন না। ফলে সঠিক চিকিৎসা না হওয়ায় বাড়ছে মৃত্যু ঝুঁকি।

মশক নিধনের ওষুধ কবে পৌঁছাবে : মশক নিধনে বছরব্যাপী যে ওষুধ ছিটানো হয়েছে তা গবেষণায় অকার্যকর প্রমাণ হওয়ার পরে ওষুধ আমদানি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। কিন্তু আমদানি প্রক্রিয়ার জটিলতায় পিছিয়ে পড়ে কার্যক্রম। পরবর্তীতে সরাসরি আমদানির ঘোষণা দেন ঢাকা উত্তর সিটি মেয়র আতিকুল ইসলাম। এরপর নতুন ওষুধ আমদানিতে তৎপরতা শুরু করে দুই সিটি করপোরেশন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. শরীফ আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ওষুধ আমদানির প্রক্রিয়া চলছে। দুই সিটি করপোরেশন মিলে টেকনিক্যাল কমিটির মাধ্যমে দেশের বাইরে থেকে নমুনা সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরপর এসব নমুনা দেশে পৌঁছালে তার কার্যকারিতা যাচাই করে আমদানি করা হবে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সহকারী ভা ার ও ক্রয় কর্মকর্তা লিয়াকত হোসেন বলেন, চারটি কোম্পানির ওষুধ টেস্টের জন্য বিদেশ থেকে আনা হচ্ছে। আজ সেগুলো এসে পৌঁছাবে। এখনো ওষুধ কোনটি আনা হবে সেই সিদ্ধান্তই নেওয়া হয়নি। তাই কখন ওষুধ আসবে তারপর মশা মরবে- এ নিয়ে ক্ষুব্ধ নগরবাসী। কলাবাগান এলাকার বাসিন্দা মীর রিয়াজ আলী বলেন, আমার পরিবারের পাঁচজন সদস্যের মধ্যে চারজনই ইতিমধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে। শুধু আমিই এখনো বাকি আছি। আমি আক্রান্ত হওয়ার পর কি ওষুধ আনবে সিটি করপোরেশন? তাহলে এখন যেসব ওষুধ ছিটাচ্ছে সেগুলো কি কাজের? ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নেই কোনো কেন্দ্রীয় উদ্যোগ। এর মধ্যেই দূরপাল্লার বাস, ট্রেন, উড়োজাহাজে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে এডিস মশা। ঢাকা থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ায় উদ্বেগ আরও বেড়েছে। সারা দেশে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়লেও প্রতিরোধে নেই উদ্যোগ। ফলে প্রতিটি জেলায় প্রতিদিন বাড়ছে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা।

মন্ত্রী মেয়রের বিভ্রান্তকর বক্তব্য : গত ২৫ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজে এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘এডিস মশার প্রজনন ক্ষমতা রোহিঙ্গাদের মতো, যে কারণে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে ডেঙ্গু হঠাৎ করেই বেশি হওয়ার কারণ এডিস মশা বেশি বেড়ে গেছে। এই মশাগুলো অনেক হেলদি ও সফিস্টিকেটেড, তারা বাসাবাড়িতে বেশি থাকে।’ মন্ত্রী আরও বলেন, এডিস মশার প্রোডাকশন অনেক বেশি। যেভাবে রোহিঙ্গা পপুলেশন আমাদের দেশে এসে বেড়েছে, সেভাবেই এই মসকিউটো পপুলেশনও বেড়েছে। আমরা তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিদিন দুর্ঘটনায় ১৫ জন মারা যায়। প্রায় ১০ জন লোক রোজ সাপের কামড়ে মারা যায়। আর কয়েক মাসে মাত্র ৮ জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে। প্রতিদিন শত শত মানুষ হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়। আমরা এসব খবর রাখি না।’  ২৫ জুলাই এক অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, আমরা এটিকে (ডেঙ্গু) একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। এখন এটি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে। কেননা, সব প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে কাজ করছে। এসময় মন্ত্রীর আরও দাবি, মশা নিয়ন্ত্রণে যে ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে তা কার্যকর। আমরা পরীক্ষার পর তা নিশ্চিত হয়েছি।” গত ১ আগস্ট জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক আলোচনা সভায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রী বলেন, ‘ডেঙ্গু রোগ বৈশ্বিক সমস্যা, পৃথিবীর অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ কম। এটি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।’ এদিকে আইসিডিডিআর,বি পরীক্ষা করে বলেছে, “সিটি করপোরেশনের মশার ওষুধের কার্যকারিতা নেই।” আবারও দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে এসে দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন বলেছেন, “পুরোপুরি না হলেও ওষুধের কার্যকারিতা আছে।” গত ২৫ জুলাই রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউয়ে এক অনুষ্ঠানে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেন, ছেলেধরা নিয়ে যে গুজব রটেছে, এটিও সে রকম। সরকার এটি কঠিনভাবে মোকাবিলা করবে। সাড়ে তিন লাখ মানুষের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার ওই তথ্য কাল্পনিক।

সর্বশেষ খবর