সড়ক পরিবহনে চাঁদার জাল বিছিয়ে রয়েছে রাজধানী ঢাকা থেকে প্রত্যন্ত ইউনিয়ন কেন্দ্র পর্যন্ত। গত ১০ বছরে সারা দেশে সড়ক নেটওয়ার্ক বিস্তৃত হওয়ার সুযোগে বাস-ট্রাক, কাভার্ড ভ্যানের পাশাপাশি নিবন্ধনহীন ১২ লাখের বেশি ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক থেকে চাঁদা তুলছে স্থানীয় শ্রমিক ইউনিয়ন, রাজনৈতিক সংগঠন, পুলিশসহ বিভিন্ন গোষ্ঠী। রাজধানী থেকে উপজেলা সদর এমনকি ইউনিয়নের কেন্দ্রস্থল পর্যন্ত চলছে চাঁদার হাতবদল। চাঁদা না দিলে গাড়ির চাকা ঘুরে না। চাঁদাই এখন সড়ক পরিবহনের প্রধান চালিকাশক্তি। এক সময় যারা চাঁদা আদায়ের নেতৃত্ব দিতেন ক্ষমতার পালাবদলে তাদের গাড়িই এখন চাঁদাবাজির শিকার।
লালমনিরহাটের বুড়িমারী বর্ডার থেকে বাস ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি বিএনপির এমপি জিএম সিরাজের এস আর পরিবহনকে প্রতি ট্রিপে হাজার টাকার বেশি চাঁদা দিতে হয়। এক সময় তার সংগঠন গাবতলী থেকে উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের ৩৬ জেলার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করত। অনুসন্ধানে জানা গেছে, জাতীয় মহাসড়ক, আঞ্চলিক মহাসড়ক, পৌর এবং উপজেলা সড়ক, ফেরিঘাট, বাস ও ট্রাক টার্মিনাল, মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়ন নিয়ন্ত্রিত এলাকায় এখন প্রতিদিন ৪ কোটি টাকার বেশি চাঁদা আদায় হচ্ছে। পরিবহন মালিকদের পরিচালন ব্যয়ের একটি বড় খাত এখন অবৈধ চাঁদার টাকা। এটি কোনো কোনো রুটে জ্বালানি খরচের চেয়েও বেশি হয়ে যায়।
ঢাকার চারটি আন্তজেলা বাস টার্মিনাল ছাড়াও বিভিন্ন পরিবহন কাউন্টার, টঙ্গী, গাজীপুর, সাভার, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জসহ শহরতলির পরিবহন সার্ভিসগুলোতে নিয়মিত চাঁদাবাজি হচ্ছে। এ ছাড়া প্রতিটি জেলা শহরের বাস টার্মিনাল, ফেরিঘাট, জেলা সড়কের প্রবেশ ও বহির্গমন পথে নিয়মিত চাঁদার টাকা দিতে হয়। রাজধানীতে বর্তমানে পার্শ্ববর্তী টঙ্গী, গাজীপুর, সাভার, নারায়ণগঞ্জে মোট ছয় হাজারের কিছু বেশি বাস-মিনিবাস চলাচল করছে। এসব বাস থেকে পরিবহন মালিক সমিতি, শ্রমিক ইউনিয়ন, শ্রমিক ফেডারেশনের নির্ধারিত চাঁদা ছাড়াও পুলিশ ও রাজনৈতিক চাঁদা মিলিয়ে দিনে গড়ে ৬০০ টাকা হিসাবে ন্যূনতম ৩৬ লাখ টাকার বেশি চাঁদা তোলা হচ্ছে। মাসে চাঁদা উঠছে প্রায় ১১ কোটি টাকা। চারটি আন্তজেলা বাস টার্মিনাল এবং সিটি সার্ভিসের বাস মিনিবাস থেকে রাজধানীতে দিনে চাঁদা তোলা হচ্ছে আরও প্রায় ৬০ লাখ টাকা। এর সঙ্গে ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, ট্যাংকলরি, হিউম্যান হলার এবং সিএনজি অটোরিকশার চাঁদা যোগ করলে প্রতিদিন রাজধানীতেই চাঁদার পরিমাণ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। এদিকে হাইওয়ে পুলিশ ২০১৮ সালের যে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে বলা হয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা ২১৫টি সংস্থা ও সংগঠন মহাসড়কে চলাচলকারী ৫৮ হাজার ৭১৯টি যানবাহন থেকে দিনে গড়ে ২৪ লাখ টাকা চাঁদা তুলছে। বছরে সেই টাকার পরিমাণ ৮৭ কোটি টাকা। কিন্তু বাস্তবে এই অঙ্ক অনেক বেশি। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাব অনুযায়ী, সারা দেশে প্রায় ৭৮ হাজার বাস-মিনিবাস এবং প্রায় ৮১ হাজার ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান রয়েছে। এসব গাড়ির কাছ থেকে পরিবহন খাতের মালিক, শ্রমিক, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, পুলিশ, রাজনৈতিক নেতা নিয়মিত চাঁদা আদায় করে। এই দেড় লাখের মধ্যে সড়কে সচল প্রায় এক লাখ গাড়ি থেকে গড়ে দিনে ন্যূনতম ৪০০ টাকা হারে চাঁদা আদায় হয়। মালিক সমিতি এবং শ্রমিক ইউনিয়নের নামে চাঁদা আদায়ের পাশাপাশি ঢাকায় চারটি টার্মিনাল থেকে ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি) দিনে বাসপ্রতি ৪০ টাকা হারে টার্মিনাল ফি আদায় করে। এই টাকা তারা ইজারাদারের মাধ্যমে দৈনিক চুক্তিতে আদায় করে। এর ফলে ইজারাদাররা টার্মিনালের ফি আদায়ের নামে বিভিন্ন রকম সার্ভিস চার্জও যুক্ত করে। এতে চাঁদা দিতে হয় নির্ধারিত টার্মিনাল ফির কয়েকগুণ বেশি। সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের এক নেতা বললেন, সারা দেশে বাস-ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান থেকে মালিক সমিতি ৪০ টাকা, শ্রমিক ইউনিয়ন ২০ টাকা এবং শ্রমিক ফেডারেশন ১০ টাকাসহ ৭০ টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। কোথাও তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি টাকা জোর করে তোলা হয়। এটাকে আমরা চাঁদাবাজি বলি। এটা নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। রাজধানীর টার্মিনালগুলো থেকে ছেড়ে যাওয়া একাধিক রুটের বাস মালিক ও চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পরিবহন মালিকদের চাঁদা দিতে হচ্ছে পদে পদে। টার্মিনাল থেকে গাড়ি ছাড়ার আগেই দিতে হচ্ছে জিপির নামে মোটা অঙ্কের টাকা। সেটা সর্বনিম্ন ৩০০ থেকে সর্বোচ্চ ৬০০ টাকা পর্যন্ত। জিপি ছাড়াও টার্মিনাল থেকে গাড়ি বের হওয়ার সময় যানজট নিয়ন্ত্রণের লোকজনকে দিতে হয় গাড়িপ্রতি ২০ টাকা, লাইনম্যানকে ২০ টাকা, টার্মিনালের গেট পেরোলেই চাঁদার দাবিতে হাত বাড়িয়ে দেয় পুলিশ সার্জেন্ট। তাকে দিতে হয় ৫০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত।চাঁদার টাকা শুধু টার্মিনালেই নয়, দিতে হয় পথে পথে। ঢাকা-খুলনা রুটের একজন পরিবহন মালিক বললেন, এখন পরিবহন চাঁদার বিকেন্দ্রীকরণ হয়েছে। মালিক সমিতিগুলোও শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চাঁদাবাজিতে নেমে পড়েছে। প্রতিটি জেলা মালিক সমিতিকে টাকা দিয়ে এলাকা পার হতে হয়। এমনকি পৌরসভাকেও প্রতিদিন টোল দিতে হয় প্রতিটি বাসকে। এ ছাড়া কয়েক হাজার টাকার ব্রিজ টোল তো রয়েছেই। সব মিলিয়ে চাঁদার টাকা দিতে দিতে আমাদের জানের বারোটা বেজে যায়। চাঁদাবাজির তাড়নায় সড়কে এখন অনেক সংগঠন। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে অফিস নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে রিকশা শ্রমিক লীগের নেতৃত্ব দিতেন আর এ জামান ও ইনসুর আলীরা। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তারাই বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগ নামে একটি সংগঠন করেছে। বছরখানেক ধরে ডিজিটাল সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগ নামেও একটি সংগঠনের সাইনবোর্ড ঝুলছে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে। দক্ষিণাঞ্চলের ২২ জেলার সংযোগ রক্ষাকারী পাটুরিয়া ও দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকার চাঁদাবাজি হয়। এই ফেরিঘাট দিয়ে দিনে প্রায় ২৫০০ বাস, মিনিবাস, পণ্যবাহী ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, পিকআপ, মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কারসহ বিভিন্ন যানবাহন পার হয়। দালাল চক্র কৃত্রিম যানজট সৃষ্টি করে পণ্যবাহী ট্রাক থেকে ১০০০/১৫০০ টাকা করে চাঁদা নিয়ে আগে পার করিয়ে দেয়। এসব চাঁদা পুলিশ, বিআইডব্লিউটিএ এবং স্থানীয় ক্যাডাররা ভাগ পায়। শুধু এখানেই নয়, দেশের ১৩টি ফেরিঘাটেই কমবেশি চাঁদাবাজির দৌরাত্ম্য রয়েছে। এদিকে চাঁদাবাজির অভিযোগ আছে হাইওয়ে পুলিশের বিরুদ্ধেও। সড়ক পরিবহনে নিরাপত্তার জন্য ব্যবসায়ীদের দাবিতে সারা দেশের মহাসড়কগুলোকে ২৪টি হাইওয়ে থানার অধীনে এনে ২০০৫ সালের জুনে এটি গঠিত হয়। হাইওয়ে পুলিশ গঠনের উদ্দেশ্য ছিল মহাসড়কগুলোতে ডাকাতি, ছিনতাই রোধ এবং মাদক ও চোরাচালানের পণ্য পরিবহন বন্ধ করা। কিন্তু পুলিশের একাংশের সঙ্গে অপরাধীদের অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠায় হাইওয়ে পুলিশ গঠনের উল্টো ফল হচ্ছে। বাংলাদেশ ট্রাক কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির নেতারা বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম, খুলনা-যশোর, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-বরিশালসহ বিভিন্ন রুটে হাইওয়ে পুলিশ চাঁদাবাজি করছে। বাংলাদেশ ট্রাক কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী খান শুক্রবার রাতে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, চাঁদাবাজির পরিস্থিতি আগের মতোই আছে। কোথাও কিছু পরিবর্তন হয়নি।
বাস মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব ও এনা পরিবহনের স্বত্বাধিকারী খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরকার কঠোর হলে চাঁদাবাজি বন্ধ করা সম্ভব। আমরা মালিক সমিতি মনে করি, সড়ক মহাসড়কে পেশিশক্তির মাধ্যমে চাঁদাবাজির অরাজকতা বন্ধ করা উচিত। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আমরা অভিযোগ পাই, মালিক সমিতির নামে, শ্রমিক ইউনিয়নের নামে অনেক পেশিশক্তি চাঁদাবাজিতে যুক্ত হয়। সম্প্রতি বগুড়া হাইওয়েতে চাঁদাবাজির ঘটনায় আমরা উদ্যোগ নিয়ে তা বন্ধ করি। তিনি বলেন, বাস টার্মিনালে, সড়ক মহাসড়কে বেপরোয়া চাঁদাবাজি বন্ধে আমরা গাড়ির স্টার্টিং ও এন্ডিং পয়েন্টে মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়নের নির্ধারিত চাঁদা নেওয়ার পক্ষে। আমরা চাই মহাসড়কে, টার্মিনালে চাঁদা তোলা বন্ধ করে পরিবহনগুলোর অফিস থেকে প্রতি মাসে নির্ধারিত চাঁদা নেওয়া হোক। তাহলে ঢালাও চাঁদাবাজির অরাজকতা বন্ধ হবে। গাবতলীকেন্দ্রিক বাস ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি বিএনপির বগুড়ার এমপি ও এস আর পরিবহনের স্বত্বাধিকারী জিএম সিরাজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের বিএনপি সরকারের সময়েও চাঁদাবাজি ছিল। কিন্তু এতটা ব্যাপকতা ছিল না। এখন তো চাঁদাবাজি সীমার বাইরে, অনেকটা প্রতিষ্ঠিত বিষয় হয়ে গেছে। তিনি বলেন, আমরা পরিবহন ব্যবসায় ভ্যাট-ট্যাক্সের চাপে অস্থির। তার ওপর এই চাঁদাবাজি। এভাবেই যদি সব টাকা চলে যায় তাহলে এখানে কে বিনিয়োগ করতে আসবে? তার মধ্যে একেকটা রুটে ঢুকতে গেলে লাখ লাখ টাকা চাঁদা দিতে হয়। মোটা অঙ্কের চাঁদা দেওয়া ছাড়া কোনো রুটে ঢোকা যায় না। তিনি বলেন, যারা জীবনে গাড়ি চালাননি তারাই এখন শ্রমিক নেতা। চারজন মিলে এক বাসের মালিক। তারাই এখন মালিক সমিতির নেতা। তারাই সড়ক পরিবহনের সবকিছুর নিয়ন্ত্রক।