সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

ইসির নিয়ন্ত্রণ কার হাতে?

সচিবালয়ের কর্তৃত্ব নিয়ে সিইসির কাছে চার কমিশনারের লিখিত অভিযোগ

গোলাম রাব্বানী

ইসির নিয়ন্ত্রণ কার হাতে?

নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে- এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন চার নির্বাচন কমিশনার। নির্বাচন প্রশিক্ষণ-সংক্রান্ত ব্যয় ছাড়া অন্য কোনো আর্থিক বিষয়ে কমিশনকে অবগত করছে না সচিবালয়। এ ছাড়া নিয়োগ ও বিভিন্ন কর্মকান্ডে সচিবালয় একক কর্তৃত্ব দেখাচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। তবে নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও সচিবালয়ের দ্বন্দ্ব দিন দিন বেড়েই চলেছে। সম্প্রতি ইসি সচিবালয় ও মাঠপর্যায়ের ১২তম, ২০তম গ্রেডের শূন্যপদের নিয়োগে অনিয়ম নিয়ে এই দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। ১৪ নভেম্বরের কমিশন সভায় নিয়োগের অনিয়ম বিষয়ে কমিশন জানতে চাইলে ইসির সিনিয়র সচিব জানান, নিয়োগ ও তৎসংক্রান্ত ব্যয় নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারবহির্ভূত। বিষয়টি প্রধান নির্বাচন কমিশনারও (সিইসি) সমর্থন করেন। মূলত সচিবের এমন বক্তব্য ও সচিবালয়ের কর্মকান্ডে সিইসির সমর্থনে অসন্তোষ প্রকাশ করেন চার নির্বাচন কমিশনার। তারা মনে করছেন, ইসির সিনিয়র সচিবের বক্তব্যে সচিবালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ওপর নির্বাচন কমিশনের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ অনুপস্থিত। তারা শুধু সচিব ও প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন। কমিশনের নিয়ন্ত্রণের কোনো মেকানিজম বা সুযোগ থাকছে না। চার কমিশনার মনে করেন, সচিবালয়ের এমন কর্তৃত্ব সংবিধান, আরপিও ও নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এ বিষয়ে গতকাল চারজন নির্বাচন কমিশনার প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ইউও নোট দিয়েছেন। সম্প্রতি কমিশনের ৩৩৯ জন কর্মচারী নিয়োগ, আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও সচিবালয়ের কার্যক্রম সম্পর্কে চার কমিশনারকে অবহিত না করার অভিযোগ করেছেন তারা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইসির সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী নিয়োগ হয়েছে। ৯০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষার জন্য ইসি, পিএসসি, জনপ্রশাসন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থেকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করেছেন।  নিয়োগের বিষয়ে কোনো অভিযোগ পাইনি। তবে ভুলত্রুটি হলে তা তদন্তের বিষয়।’ তিনি বলেন, ‘কমিটির সুপারিশ কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী আমি সিইসির কাছে উপস্থাপন করেছি। ২০০৯-২০১০ সাল থেকে নিয়োগ ও প্রশাসনিক কার্যক্রম যেভাবে হয়ে আসছে, সেভাবেই করছি।’ চার নির্বাচন কমিশনারের লিখিত অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি বিষয়টি জানি না।’ সচিবালয়ের বিষয়ে এমন লিখিত দ্বন্দ্বের প্রকাশ কিনা- জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে এ বিষয়ে চার নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। জানা গেছে, সম্প্রতি এক সভায় নিয়োগে অনিয়ম-সংক্রান্ত বিষয়ে একজন নির্বাচন কমিশনারের প্রশ্নের উত্তরে ইসি সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব কমিশনকে জানান, নিয়োগের বিষয় ও তৎসংক্রান্ত ব্যয় নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারবহির্ভূত। বিষয়টি প্রধান নির্বাচন কমিশনারও (সিইসি) সমর্থন করেন। সিনিয়র সচিব আরও অবহিত করেন, বিদ্যমান আইন অনুযায়ী শুধু নির্বাচন-সংক্রান্ত বিষয়াদিতে কমিশনের অনুমোদনের প্রয়োজন আছে; নির্বাচন কমিশনের অন্যান্য বিষয়ে সিইসির অনুমোদন সাপেক্ষে সচিবালয় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। কিন্তু ইসি সচিবালয়ের এমন কর্তৃত্বের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন চার নির্বাচন কমিশনার। তারা প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে এসব বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। চার নির্বাচন কমিশনার মনে করছেন, সচিবালয়ের এমন কর্তৃত্ব সংবিধান, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ও নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। চার নির্বাচন কমিশনারের ইউও নোটে উল্লেখ করা হয়, (ক) নির্বাচন কমিশনের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় গঠিত। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সব কর্মকর্তা ও কর্মচারী নির্বাচন কমিশনের সার্বিক নিয়ন্ত্রণে অর্পিত সব দায়িত্ব পালন করবে এবং সচিব প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের কাছে দায়ী থাকবেন। এ ক্ষেত্রে সিনিয়র সচিবের বক্তব্য ও বর্তমান অবস্থায় ১৪(২) উপধারা অনুযায়ী সচিবালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীর ওপর নির্বাচন কমিশনের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ অনুপস্থিত। তারা শুধু সচিব ও প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন। কমিশনের নিয়ন্ত্রণের কোনো মেকানিজম বা সুযোগ থাকছে না। (খ) নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের জন্য অনুমোদিত বাজেট নির্ধারিত খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় অনুমোদনের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনই চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ হবেন; বরাদ্দকৃত অর্থ যেসব খাতে ব্যয় হবে, এ-সংক্রান্ত বিষয় কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত এবং কমিশন কর্তৃক অনুমোদন আবশ্যক। মাঝেমধ্যে নির্বাচন প্রশিক্ষণ-সংক্রান্ত কোনো কোনো বিষয় উপস্থাপন করা হলেও অন্য কোনো আর্থিক বিষয়ে কমিশনকে অবগতও করা হয় না, যা নির্বাচন কমিশন আইন, ২০০৯-এর ১৬ ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। (গ) নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন, ২০০৯-এর ধারা-৪ সহ অন্যান্য ধারায় বর্ণিত কমিশনের ওপর অর্পিত সব কাজে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে কমিশনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তদুপরি সচিবালয় এককভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে, তা ১৪ নভেম্বরের কমিশন সভায় সিনিয়র সচিব তুলেও ধরেছেন, যা সংবিধান, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ও নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন, ২০০৯ ও সংশ্লিষ্ট বিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। (ঘ) নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ও নির্বাচন কমিশনের সব বিষয়ে সংবিধানসহ বিদ্যমান সব আইন ও বিধি অনুযায়ী পরিচালিত হওয়া প্রয়োজন। তা না হলে নির্বাচন কমিশনের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ বিঘিœত হবে। একই সঙ্গে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিও নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না।  “নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের ওপর কার্যাদির বিষয়ে ‘নির্বাচন কমিশন’-এর  এখতিয়ার প্রসঙ্গে” শীর্ষক ইউও নোট সিইসির কাছে গতকাল দিয়েছেন চার নির্বাচন কমিশনার। এতে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার, মো. রফিকুল ইসলাম, বেগম কবিতা খানম ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী যৌথভাবে স্বাক্ষর করেছেন। তারা এসব বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছেন। ইউও নোটে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন, ২০১০-এর ৫(১) ধারায় ‘নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ওপর ন্যস্ত থাকবে’ মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে; এবং একই আইনে ১৪(১) ধারায় উল্লেখ রয়েছে যে, ‘নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের যাবতীয় দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য সচিব প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের নিকট দায়ী থাকবেন।’ আইনের ১৪(২) উপধারা মোতাবেক ‘নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারী, নির্বাচন কমিশনের সার্বিক নিয়ন্ত্রণে সচিবের নিকট দায়ী থাকবেন...।’ বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন, ২০০১-এর ১৬ ধারায় বর্ণিত আছে, ‘নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের জন্য অনুমোদিত বাজেট নির্ধারিত খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় অনুমোদন ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনই চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ হবেন।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর