মঙ্গলবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে রোগী

দেশে নতুন শনাক্ত ১৮২, মৃত্যু ৫, চলছে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন

নিজস্ব প্রতিবেদক

লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে রোগী

লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন আরও ১৮২ জন। দেশে করোনায় এক দিনে শনাক্তের এ সংখ্যা সর্বোচ্চ। আগের দিনের তুলনায় গতকাল প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে। গতকাল এক দিনে মৃত্যুও হয়েছে আরও পাঁচজনের। এ নিয়ে দেশে করোনায় মৃত্যু হলো ৩৯ জনের। গত ৮ মার্চ প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার পর গতকাল পর্যন্ত মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ৮০৩-এ। আক্রান্তের মধ্যে নতুন করে সুস্থ হয়ে উঠেছেন আরও তিনজন। এ নিয়ে মোট সুস্থ হলেন ৪২ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় ১ হাজার ৫৭০টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৮২ জনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। গতকাল দুপুরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এক অনলাইন ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানিয়ে বলেন, ইতিমধ্যে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বা সামাজিকভাবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়ে গেছে। এজন্য সংক্রমণ থেকে মুক্তি পেতে ঘরে অবস্থানের বিকল্প নেই।

গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর চীনের উহান শহরে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। দেশে প্রথম কভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হন ৮ মার্চ এবং দেশে এ রোগে আক্রান্ত প্রথম রোগীর মৃত্যু হয় ১৮ মার্চ। ২৫ মার্চ প্রথমবারের মতো রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট-আইইডিসিআর জানায়, বাংলাদেশে সীমিত পরিসরে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বা সামাজিকভাবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হচ্ছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. জাহিদ মালেক বলেছেন, ইউরোপ-আমেরিকায় প্রতিদিন যেভাবে মানুষ মারা যাচ্ছে আর সংক্রমিত হচ্ছে সে তুলনায় বাংলাদেশ অনেক ভালো আছে। আমরা এই ভালোটা ধরে রাখতে চাই।

জাহিদ মালেক বলেন, যেহেতু আমাদের ইতিমধ্যে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়ে গেছে, সেহেতু এটা যেন না বাড়ে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আমাদের হাসপাতালব্যবস্থা আরও মজবুত করতে হবে। তবে বুঝতে হবে যে, হাসপাতালে লাখ লাখ রোগীর চিকিৎসা কোনো দেশই দিতে পারে না। এজন্য আমাদের মূল লক্ষ্য ঘরে থাকা এবং টেস্ট করা। সরকারের উদ্যোগের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমরা নতুন তিনটি কোয়ারেন্টাইন সেন্টার বা ফিল্ড হাসপাতাল তৈরি করছি। একটি বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টার, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের একটি পুরানো মার্কেট এবং উত্তরার দিয়াবাড়ীতে চারটি ভবন। এসব হাসপাতালের কাজ এগিয়ে চলছে। আশা করি অল্প সময়ের মধ্যে আমরা এগুলো প্রস্তুত করতে পারব। এ ছাড়া আমরা বেশ কয়েকটি হাসপাতাল প্রস্তুত করার ব্যবস্থা নিয়েছি। এর মধ্যে মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, পঙ্গু হাসপাতালের পুরানো অংশটুকু এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুরনো বার্ন ইউনিট রয়েছে। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের একটি ভবনকে আমরা তৈরি করতে বলেছি। তিনি আরও বলেন, বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে আমরা প্রথমেই শাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৫০০ বেড ও আনোয়ার খান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৭০০ বেড নেব। এগুলো ভালো হাসপাতাল এবং সেখানে আইসিউ রয়েছে। প্রতিটি জেলায় যেসব বেসরকারি হাসপাতাল এগিয়ে আসছে তাদেরও আমরা তালিকাভুক্ত করে নিচ্ছি। মন্ত্রী বলেন, নারায়ণগঞ্জ, বাসাবোসহ বেশ কয়েকটি এলাকা বেশি সংক্রমিত হয়েছে। আমি রবিবার সারা দেশের হাসপাতালের পরিচালকদের সঙ্গে কথা বলেছি। যেসব এলাকা সংক্রমিত হয়েছে তার বেশির ভাগই ঢাকা থেকে কিংবা নারায়ণগঞ্জ থেকে সেখানে গিয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের আরও বেশি কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। লকডাউন জোরদার করতে হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে লকডাউন মানুষ পুরোপুরি মানছে না। বাজারে অনেকে একত্রিত হচ্ছে, বাইরেও অনেক লোক অযথা ঘোরাফেরা করছে। এ বিষয়টি পরিহার করতে হবে। বাইরে যেখানে ঘোরাফেরা করবে সেখানেই সংক্রমিত হবে।

নরসিংদীতে চিকিৎসক, সাংবাদিকসহ এক দিনে আক্রান্ত ১৬ : নরসিংদীতে চিকিৎসক, সাংবাদিকসহ এক দিনে ১৬ জন নতুন করে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে জেলা হাসপাতালের চিকিৎসা কর্মকর্তা, বেসরকারি একটি টিভি চ্যানেলের জেলা প্রতিনিধি ও সিভিল সার্জন কার্যালয়েরই সাতজন রয়েছেন। জেলা করোনা প্রতিরোধ জরুরি সেলের প্রধান ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) ইমরুল কায়েস বলেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে ২৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করে রবিবার দুপুরে রাজধানীর একটি হাসপাতালে পাঠানো হয়। গতকাল সকালে সেখান থেকে জানানো হয়, ১৬ জন করোনায় আক্রান্ত। এর আগে শনাক্ত হওয়া চারজনসহ পুরো জেলায় মোট করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ২০। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বেসরকারি টিভি চ্যানেলের ওই জেলা প্রতিনিধি বলেন, ‘গত রবিবার সকালে জেলার সর্বশেষ করোনা পরিস্থিতি টিভি লাইভে জানাতে আরও এক সাংবাদিককে সঙ্গে নিয়ে সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে যাই। কাজ শেষে সিভিল সার্জন মো. ইব্রাহীম বলেন আপনাদের তো সংবাদের প্রয়োজনে কত জায়গায় যেতে হয়। চাইলে নমুনা পরীক্ষা করিয়ে নিতে পারেন। এর পরই আমরা দুজন নমুনা পরীক্ষা করতে দিই। আজকে পাওয়া ফলে আমার পজিটিভ এলেও, অন্য সাংবাদিকের নেগেটিভ এসেছে। কীভাবে বা কার সংস্পর্শ থেকে আমি আক্রান্ত হলাম, তা বুঝতে পারছি না। তবে আমার শরীরে করোনাভাইরাসের কোনো উপসর্গ এখনো দেখা দেয়নি।’ সিভিল সার্জন মো. ইব্রাহীম জানান, নতুন আক্রান্তের অধিকাংশেরই শরীরে করোনাভাইরাসের তেমন কোনো উপসর্গ দেখা দেয়নি। তবু ঝুঁকি কমাতে তাদের সবাইকে ১০০ শয্যাবিশিষ্ট নরসিংদী জেলা হাসপাতালের আইসোলেশন ইউনিটে ভর্তি রাখা হবে। যারা আক্রান্তদের সংস্পর্শে এসেছেন, তাদের হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

টাঙ্গাইলে নতুন করে পাঁচজন আক্রান্ত : টাঙ্গাইলে নতুন করে আরও পাঁচজনের দেহে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে জেলায় সাতজনের দেহে করোনার জীবাণু শনাক্ত হলো। নতুন সংক্রমণের মধ্যে ভুঞাপুরে তিনজন, মধুপুরে একজন ও নাগরপুরে একজন। টাঙ্গাইলের সিভিল সার্জন ডা. ওয়াহিদুজ্জামান জানান, আক্রান্ত পাঁচজনের মধ্যে তিনজনকে ময়মনসিংহ পাঠানো হয়েছে। বাকি দুজনকে কোথায় রাখা হবে এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। তারা সবাই মোটামুটি সুস্থ আছেন। রবিবার দুপুরে এ পাঁচজনসহ মোট ৭০ জনের নমুনা জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে সংগ্রহ করে আইইডিসিআরে পাঠানো হয়েছিল।

ফরিদপুরে প্রথম দুই রোগী শনাক্ত : ফরিদপুরে করোনাভাইরাস আক্রান্ত দুজন শনাক্ত হয়েছেন। দুজনই জেলার নগরকান্দা উপজেলার ডাঙ্গী ইউনিয়নের বাসিন্দা। একজনের বয়স ৬২, অন্যজনের ৪৮ বছর। ফরিদপুরে এই প্রথম করোনায় আক্রান্ত রোগীর সন্ধান পাওয়া গেল। ফরিদপুরের সিভিল সার্জন ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, ওই দুই ব্যক্তির উপাত্ত সংগ্রহ করে ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল। গতকাল বিকালে প্রতিবেদন পাওয়া গেছে। দুজনের ফল পজিটিভ এসেছে। ওই দুই ব্যক্তির মধ্যে একজন ঢাকা থেকে এবং অন্যজন নারায়ণগঞ্জ থেকে এসেছেন। পাঁচ থেকে ছয় দিন আগে ওই দুই ব্যক্তি বাড়িতে আসেন। এ ঘটনার পর নগরকান্দা উপজেলা লকডাউন করার উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন।

সুনামগঞ্জে প্রসূতি আক্রান্ত : সুনামগঞ্জে প্রবাসীর স্কুলশিক্ষিকা স্ত্রী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার এক দিনের মাথায় এবার নারায়ণগঞ্জ-ফেরত এক শ্রমিকের প্রসূতি স্ত্রীর শরীরে ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। আক্রান্ত ওই প্রসূতি নারী সদর উপজেলার বেরীগাঁও গ্রামের বাসিন্দা। গত বুধবার তিনি সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন। পরে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে তার রক্ত পরীক্ষা করা হলে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের বিষয়টি ধরা পড়ে। ওই পরিবারের সাত সদস্যকে হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। এ নিয়ে জেলায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ২-এ। গতকাল দুপুরে সিভিল সার্জন ডা. শামস উদ্দিন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

সিএমপির ট্রাফিক ব্যারাক লকডাউন : চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ (সিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের এক সদস্য করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর মাঠ পর্যায়ে পুলিশ সদস্যদের সতর্কভাবে কাজ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে আক্রান্ত ওই পুলিশ সদস্যের সংস্পর্শে আসায় চিকিৎসক, নার্স, পুলিশ সদস্যসহ ২ শতাধিক ব্যক্তিকে হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়েছে। সেইসঙ্গে লকডাউন করা হয়েছে সিএমপির ট্রাফিক বিভাগ উত্তরের ব্যারাক। সিএমপি কমিশনার মাহাবুবর রহমান জানান, এরই মধ্যে সিএমপির সব ইউনিটকে সতর্কতা অবলম্বন করে দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পুলিশ সদস্যদের বাইরে বের হলে মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস পরতে বলা হয়েছে। সিএমপি সূত্রে জানা যায়, ওই পুলিশ সদস্যের সংস্পর্শে আসা তিন চিকিৎসক, তিন নার্স, সাত মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ও ২১২ পুলিশ সদস্যকে হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়েছে। আক্রান্ত পুলিশ সদস্যকে নগরের জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

করোনায় আক্রান্ত ঢাবি ছাত্র ভালোর দিকে : পরিবারের সঙ্গে ঢাকার মানিকদি এলাকায় বসবাস করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র ৭ এপ্রিল অসুস্থতা নিয়ে হাসপাতালে যান। তার নমুনা পরীক্ষার পর ৮ এপ্রিল নিশ্চিত করা হয় যে, তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত? এই শিক্ষার্থীর শারীরিক অবস্থা এখন ভালোর দিকে বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী। প্রক্টর বলেন, আইইডিসিআরের তত্ত্বাবধানে ওই ছাত্রকে তার বাড়িতে আইসোলেশনে রাখা হয়েছে। গত রবিবার আমরা এ ব্যাপারে জানতে পেরেছি। ওই ছাত্রের শারীরিক অবস্থা ভালোর দিকে। তার জ্বর সেরে গেছে। আমাদের সে বলেছে, আগের চেয়ে এখন ভালো বোধ করছে। আক্রান্ত ওই শিক্ষার্থী ও তার পরিবারের সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন।

সর্বশেষ খবর