মঙ্গলবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

সংকটের শেষ নেই চিকিৎসকদের

বিশেষ প্রতিনিধি

সংকটের শেষ নেই চিকিৎসকদের

দেশে তীব্র হয়ে ওঠা করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলার সম্মুখ যোদ্ধা চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের সংকটের শেষ নেই। অপর্যাপ্ত পারসোনাল প্রটেকশন ইকুইপমেন্ট (পিপিই) নিয়েই করোনাযুদ্ধে নামা স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রতিনিয়তই নতুন নতুন সংকটে পড়ছেন। স্বল্প জনবলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে থাকা-খাওয়ার সংকট।

এর বাইরে বিভিন্ন স্থানে মানসিকভাবে নানা পীড়নের শিকার হচ্ছেন চিকিৎসকরা। দেশে সবচেয়ে বেশি করোনা রোগী যে হাসপাতালে সেই কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে কাজ করছেন মাত্র একজন আয়া। সেখানকার ডাক্তারদের বাস্থস্থানে খাবার রান্না করার লোকও নেই। অথচ পাশের দেশ ভারতের রাজধানী দিল্লিতে করোনাযুদ্ধের চিকিৎসকদের জন্য খাবার দেওয়া হচ্ছে ফাইভ স্টার হোটেল থেকে।

চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত পেশাজীবীদের সংগঠনগুলো জানিয়েছে, নিজের জীবন ঝুঁকিতে রেখে অন্যের জীবন বাঁচাতে কাজ করতে গিয়ে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর বাড়ছে অবর্ণনীয় চাপ। দেশে সেবা দিতে গিয়ে এ পর্যন্ত ২২ জন চিকিৎসক, পাঁচজন নার্স ও চারজন টেকনিশিয়ান করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। চিকিৎসক, নার্সসহ অর্ধশতাধিক স্বাস্থ্যকর্মী বর্তমানে কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন।

জানা গেছে, দেশের সব হাসপাতালে চিকিৎসক, নার্স ও অন্য চিকিৎসাকর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষার পর্যাপ্ত সরঞ্জাম দেওয়া হয়নি। উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো থেকে শুরু করে জেলা সদরের হাসপাতালগুলোয় প্রতিদিন শত শত মানুষ চিকিৎসাসেবা নিতে আসছেন, তাদের কেউ কেউ দেহে বহন করছেন প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। যেসব চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়েই তারা দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। বারবার ধরনা দিলেও কর্তৃপক্ষ চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মাঝে পিপিই সরবরাহ করেনি। নিজেদের টাকায় কেনা মাস্ক ব্যবহার করে স্বাভাবিক পোশাক পরেই ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়েই অনেকে রোগী দেখছেন। অভিযোগ জোরালো হয়ে উঠেছে, চিকিৎসাসেবায় নিবেদিত ব্যক্তিদের শারীরিক সুস্থতার বিষয়টি যতটা গুরুত্ব পাওয়া দরকার ততটা পাচ্ছে না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন চিকিৎসক জানান, ঝুঁকির মুখে মারাত্মক ভাইরাসটির সবচেয়ে কাছে যাচ্ছেন চিকিৎসকরা, জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছেন তারাই। তাদের সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ও প্রাপ্য সম্মান নিশ্চিত করতে হবে। করোনার বিরুদ্ধে সম্মুখ যোদ্ধাদের মনোবল চাঙ্গা রাখাটা জরুরি। বিশ্বের কয়েকটি দেশ চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের বীরের মর্যাদা দিয়ে তাদের থাকা-খাওয়া ও যাতায়াতের ব্যবস্থা করেছে। ঢাকায় অনেক চিকিৎসক নিজ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজের পেশা গোপন করে আবাসিক হোটেলে উঠেছেন। সেখান থেকেই তারা বিভিন্ন হাসপাতালে গিয়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর এমন বেশ কয়েকজন চিকিৎসককে আবাসিক হোটেলে আর থাকতেই দেওয়া হয়নি। শুধু তাই নয়, যে খাবার দোকানে তারা খাবার খেতেন সেখান থেকেও তাদের খাবার সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ বলেন, ‘করোনা চিকিৎসায় যেসব হাসপাতালকে কাজে লাগানো হয়েছে, সেগুলোয় চিকিৎসক-নার্স থেকে শুরু করে সবাইকে রোটেশনে দায়িত্ব বণ্টন করতে হবে। একাধিক গ্রুপকে কাজে লাগাতে হবে। তাদের থাকা-খাওয়ার নিশ্চয়তা দিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে এখানে ব্যবস্থাপনার সমস্যা রয়েছে। তাই কোনো কাজে সমন্বয় হচ্ছে না।’ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেবা দিতে গিয়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন চিকিৎসক, নার্স ও টেকনিশিয়ানরা। ইতালিতে মোট আক্রান্তের ৮ দশমিক ৩ শতাংশ চিকিৎসা-কর্মী। চীনে চিকিৎসা-কর্মীদের আক্রান্ত হওয়ার হার মোট আক্রান্তের ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। ইতালি ও চীন দুটি দেশই চিকিৎসাবিজ্ঞানে অনেক এগিয়ে। তারা তাদের চিকিৎসা-কর্মীদের উন্নতমানের সব ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম দিয়েছে। এর পরও উন্নত বিশ্বে চিকিৎসা-কর্মীদের আক্রান্তের সংখ্যা এত বেশি। ইতালিতে চিকিৎসা-কর্মীরা এত বেশি আক্রান্ত হয়েছেন যে সেখানে চিকিৎসক সংকট দেখা দিয়েছে। করোনা মহামারীতে সারা বিশ্বে এখন স্বাস্থ্যকর্মীদের ঝুঁকির বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে আসছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সম্প্রতি সংস্থাটির প্রধান বলেছেন, ‘আমরা বিশেষত স্বাস্থ্যকর্মীদের আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন। কিছু দেশে ১০ শতাংশের বেশি স্বাস্থ্যকর্মী সংক্রমিত হয়েছেন। কিন্তু স্বাস্থ্যকর্মীরা যখন ঝুঁকিতে থাকেন, আমরা সবাই তখন ঝুঁকিতে।’ তিনি বলেন, স্বাস্থ্যকর্মীদের যদি যথাযথ ও পর্যাপ্ত সুরক্ষামূলক সামগ্রী সরবরাহ করা যায়, তাহলে তাদের মধ্যে সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বাস্থ্যকর্মীদের ১৬টি অধিকারের কথা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এসব অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, স্বাস্থ্যকর্মীরা ঝুঁকিতে থাকলে সবাই ঝুঁকিতে থাকে। তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত হলে সংক্রমণ প্রতিরোধ সম্ভব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, স্বাস্থ্যকর্মীদের তথ্য জানাতে হবে, নির্দেশনা দিতে হবে, পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সন্দেহভাজন বা শনাক্ত হওয়া কভিড-১৯ রোগীর সেবায় নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মীকে পর্যাপ্ত সংক্রমণ প্রতিরোধ ও ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী (মাস্ক, গ্লাভস, গাউন, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, সাবান, পানি ও পরিষ্কার করার সামগ্রী) সরবরাহ করতে হবে। নির্দেশিকায় আরও বলা আছে, দোষারোপহীন পরিবেশে তাদের কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। দৈনিক কাজের মধ্যে ছুটিসহ যথাযথ কর্মঘণ্টা বজায় রাখতে হবে। তাদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর