বুধবার, ২২ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

বিপর্যস্ত হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা

যথাযথ মনিটরিংয়ের ও সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাব মূল কারণ

নিজস্ব প্রতিবেদক

কুমিল্লার আব্দুল কাইয়ুম। নিউমোনিয়া আক্রান্ত হওয়ায় তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে। করোনা সন্দেহে তাকে রাখা হয় আইসোলেশন ইউনিটে। দুই দিনে তাকে দেখতে আসেনি ডাক্তার বা নার্স। পাওয়া যায়নি তেমন কোনো খাবারও। দুদিনের মাথায় সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন কাইয়ুম। তার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত করোনা পজেটিভ না নেগেটিভ তা জানা যায়নি। তাই লাশ দেওয়া হয়নি স্বজনদের। রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত লাশ পড়ে থাকে সেখানেই। দুদিন না খেয়ে হাসপাতালেই অবস্থান করার পর স্বজনরা জানতে পারেন কাইয়ুম নেগেটিভ ছিলেন।

শুধু আব্দুল কাইয়ুমের ক্ষেত্রেই নয়, বুয়েটের একজন প্রকৌশলী শিক্ষক তার বাবাকে নিয়ে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরেও ভর্তি করাতে পারেননি। পরে তাকে ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল। পরে হাসপাতালে আইসোলেশন থাকা অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজের আইসোলেশন ইউনিটের দশাও বেহাল। বর্তমানে সেখানে অল্প কয়েকটি সিটের বিপরীতে আইসোলেশনে আছেন ২২ জন। তাদেরকে রাখা হয়েছে গাদাগাদি করে। ফলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের আইসোলেশন রুম যেন এখন করোনাভাইরাসের উর্বর ভূমি। সর্দি-জ্বর-কাশি-গলা ব্যথা নিয়ে কেউ ঢামেক হাসপাতালে আসলেই তাকে জরুরি বিভাগের আইসোলেশন রুমে রাখা হচ্ছে।  গরম এবং যন্ত্রণায় অনেকে বসার সিটে এবং ফ্লোরে শুয়ে পড়ছেন। এর মধ্যে কারো অবস্থা বেগতিক খারাপ হলে কিংবা করোনা পজেটিভ আসলে তাকে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ভুক্তোভোগীরা বলছেন, শুধু আইসোলেশন ইউনিটেই নয় করোনা প্রাদুর্ভাবের মধ্যে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে হাসপাতালের চিকিৎসাসেবাই। এমনকি অন্তঃসত্ত্বা নারীদেরও ছুঁয়ে দেখছেন না চিকিৎসক ও নার্সরা। আগে প্রতিদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার রোগী এলেও এখন রোগী আসছে মাত্র ৫০০’র কাছাকাছি। তারপরও সংকট দেখা দিয়েছে চিকিৎসকদের। অনেক সিনিয়র ডাক্তারই সকালে শুধু একটি মিটিং করেই চলে যাচ্ছেন। কেউই রোগী দেখতে যাচ্ছেন না। বিভিন্ন ইউনিটের ডাক্তারদের এই রোগী শূন্যতা থাকলেও তাদের করোনা রোগীদের চিকিৎসায় লাগানো হচ্ছে না। অবশ্য চিকিৎসকরা বলছেন, পর্যাপ্ত পারসোনাল প্রটেকশন ইক্যুইপমেন্ট বা পিপিই না থাকায় একবারের বেশি রোগী দেখা সম্ভব হচ্ছে না। অভাব আছে মানসম্মত মাস্কেরও।

করোনা উপসর্গ থাকা রোগীদের বিপত্তি যেন আরও বেশি। বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরলেও মেলেনা চিকিৎসা। সিট পাওয়া যায়না কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল যেন আতঙ্কের অপর নাম। অন্য কোনো হাসপাতালে ভর্তি হতে পারলেও প্রথম দুই-একদিন একেবারেই মেলেনা চিকিৎসা। খেয়ে না খেয়ে থাকতে হয় হাসপাতালে। টেস্টের রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করতে হয় দুই থেকে তিন দিন। রিপোর্ট হারিয়ে ফেলার ঘটনাও আছে। বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসার কথা বললেও সেগুলো প্রস্তুতি একেবারেই নেই। করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ও কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের পরই সবচেয়ে বেশি সময় ধরে আলোচনায় রয়েছে মহাখালীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল। গত দেড় মাস ধরে এই হাসপাতাল প্রস্তুত বলে দাবি করছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর। কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কাছে পরাস্ত হয়েছে শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ফলে চেষ্টা করেও প্রস্তুত হতে পারছে না হাসপাতালটি। মাত্র কয়েকটি ভেন্টিলেটর মেশিন, আইসিইউ বেড দিয়েই দায় সেরেছে স্বাস্থ্য প্রশাসন। অথচ আইসিইউতে অক্সিজেন সাপ্লাইয়ের জন্য যে আলাদা অক্সিজেন প্ল্যান্ট প্রয়োজন তার কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। আইসিইউতে এয়ার ফ্লো কন্ট্রোলের জন্য যে স্পেশাল ভেন্টিলেটর সিস্টেম প্রয়োজন তা নেই গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে। করোনো চিকিৎসার ক্ষেত্রে সুরক্ষা নিশ্চিতে বিশেষভাবে প্রয়োজনীয় আবর্জনা ব্যবস্থাপনার কোনো ব্যবস্থাই নিশ্চিত করা হয়নি এই হাসপাতালে। দেওয়া হয়নি কোনো ওয়াশিং মেশিনও। করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের থাকার জন্য ডরমিটরি প্রস্তুতির জন্যও কোনো বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। ডরমেটরিতে লাগানো হয়নি পানির কল, ব্যবস্থা নেই হ্যান্ডওয়াশের। নেই স্যানিটাইজারও। হাসপাতালের ক্যান্টিন বন্ধ করে বাবুর্চিরা ভেগেছেন আগেই। বর্তমানে থাকা মাত্র দুই জনের দ্বারা হাসপাতালের রোগী বা স্বাস্থ্যকর্মীদের খাবার তৈরি বা বন্টন কোনোটাই সম্ভব নয়।  ডাক্তারদের থাকার জন্য হোটেলের কথা বিভিন্ন মাধ্যমে বলা হলেও শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের কেউ এর কিছুই জানে না। ঢামেক হাসপাতালের চিকিৎসক নার্সসহ করোনায় আক্রান্ত অর্ধশত : ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স, কর্মচারীসহ অর্ধশত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। তাদেরকে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কয়েকজনকে হোম কোয়ারেন্টাইনেও রাখা হয়েছে। গতকালও আব্দুল হাই (৪৫) নামে ৪র্থ শ্রেণির এক কর্মচারী এবং ২১৬ নং ওয়ার্ডের চন্দন সরকার (৩০) নামে আরেকজনের করোনা নমুনায় পজেটিভ হয়। ঢামেক হাসপাতালের জেনারেল স্টোরটিকে লকডাউন করা হয়েছে। এই স্টোরের কর্মচারী ছিলেন আব্দুল হাই। ঢামেক হাসপাতালের সহকারী পরিচালক আলাউদ্দিন আল আজাদ বলেন, কোনো লকডাউন করা হয়নি। করোনা পজিটিভের সঠিক পরিসংখ্যান বলতে পারব না। তবে যতোটুকু জানতে পেরেছি তা হলো হাসপাতালে ২০-২৫ জন চিকিৎসক, ১৫-২০ জন নার্স, দুজন ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীর করোনা পজিটিভ পাওয়া গেছে। তাদেরকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, মিরপুরের লালকুটি হাসপাতালসহ কয়েকটি হাসপাতালে রাখা হয়েছে। এছাড়াও কয়েকজনকে হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর