সোমবার, ১১ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

মাহে রমজানে বদরের যুদ্ধ

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

মাহে রমজানে বদরের যুদ্ধ

হিজরি দ্বিতীয় সনের ১৭ রমজান মদিনার অদূরে ৮০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে বদর নামক স্থানে নবদীক্ষাপ্রাপ্ত মুসলমানদের সঙ্গে কাফেরদের প্রথম সম্মুখ যুদ্ধ হয়। মাহে রমজানে সংঘটিত এ যুদ্ধ যা ইতিহাসে বদরের যুদ্ধ নামে খ্যাত, তা ছিল নবীন ইসলামী রাষ্ট্রের অস্তিত্বের প্রশ্নে অতীব তাৎপর্যপূর্ণ। কোরআনুল করিমে এই যুদ্ধের বিবরণ ও বিশেষত্ব সম্পর্কে বহু আয়াতে সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য কিছু আয়াত হলো- “দুটি দলের পরস্পর সম্মুখীন হওয়ার মধ্যে তোমাদের জন্য নিদর্শন রয়েছে। একদল আল্লাহর পথে সংগ্রাম করছিল, অন্য দল কাফির ছিল, তারা তাদেরকে চোখের দেখায় দ্বিগুণ দেখছিল। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা নিজ সাহায্য দ্বারা শক্তিশালী করেন। নিশ্চয়ই এতে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন লোকের জন্য শিক্ষা রয়েছে। (৩ সংখ্যক সুরা আল ইম-রান, আয়াত ১৩)। এবং বদরের যুদ্ধে যখন তোমরা হীনবল ছিলে আল্লাহ তো তোমাদেরকে সাহায্য করেছিলেন। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। স্মরণ কর, যখন তুমি মুমিনগণকে বলছিলে, ‘এটা কি তোমাদের জন্য যথেষ্ট নয় যে, তোমাদের প্রতিপালক প্রেরিত তিন সহস্র ফেরেশতা দ্বারা তোমাদেরকে সহায়তা করবেন?’ হ্যাঁ, নিশ্চয়, যদি তোমরা ধৈর্যধারণ কর এবং সাবধান হয়ে চল তবে তারা দ্রুতগতিতে তোমাদের ওপর আক্রমণ করলে আল্লাহ পাঁচ সহস্র চিহ্নিত ফেরেশতা দ্বারা তোমাদের সাহায্য করবেন। এটা তো কেবল তোমাদের জন্য সুসংবাদ ও তোমাদের চিত্ত-প্রশান্তি-হেতু আল্লাহ করেছেন। এবং সাহায্য শুধু পরাক্রান্ত প্রজ্ঞাময় আল্লাহর নিকট থেকে হয়।” (ঐ। আয়াত ১২৩-১২৬)। মুসলমানদের হাতে বন্দী শক্র সৈন্যরা পরবর্তীকালে সাক্ষ্য দেয় যে, যুদ্ধের সময় তারা মুসলমান বাহিনীকে দ্বিগুণ অবস্থায় দেখে। মহানবী (সা.)-এর সমর কৌশলে এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সাহায্যে তা সম্ভবপর হয়েছিল। যুদ্ধের প্রাক্কালে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন, ‘...আমি তোমাদেরকে সাহায্য করব এক সহস্র ফেরেশতা দ্বারা যারা একের পর এক আসবে। আল্লাহ তা করেন কেবল শুভ সংবাদ দেওয়ার জন্য এবং এ উদ্দেশ্যে যাতে তোমাদের চিত্ত প্রশান্তি লাভ করে; এবং সাহায্য তো শুধু আল্লাহর নিকট হতেই আসে। আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ (৮ সংখ্যক সুরা আনফাল, আয়াত ৯-১০)। “হে মুমিনগণ! তোমরা যখন কাফির বাহিনীর সম্মুখীন হবে তখন তোমরা তাদেরকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে না; সেদিন যুদ্ধ কৌশল অবলম্বন কিংবা দলে স্থান লওয়া ব্যতীত কেহ পৃষ্ঠ প্রদর্শন করলে সে তো আল্লাহর বিরাগভাজন হবে এবং তার আশ্রয় জাহান্নাম, আর উহা কত নিকৃষ্ট! তোমরা তাদেরকে বধ কর নাই, আল্লাহই তাদেরকে বধ করেছেন, এবং তুমি যখন নিক্ষেপ করেছিলে তখন তুমি নিক্ষেপ কর নাই, আল্লাহই নিক্ষেপ করেছিলেন, এবং ইহা মুমিনগণকে আল্লাহর পক্ষ থেকে উত্তম পুরস্কার দান করার জন্য; আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। এটাই তোমাদের জন্য, আল্লাহ কাফিরদিগের ষড়যন্ত্র দুর্বল করেন।” (ঐ। আয়াত ১৫-১৮)। মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের পর ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণকারীর সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ইসলামের প্রসার প্রয়াসকে অংকুরেই সমূলে ধ্বংস করার লক্ষ্যে মক্কায় কোরাইশ বংশের অধিপতিরা বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করে। তাদের এই ষড়যন্ত্রে যোগ দেয় স্থানীয় ইহুদি ও অদূরবর্তী কিছু খ্রিস্টান। আবু সুফিয়ান ছিলেন মস্তবড় ব্যবসায়ী। তার ব্যবসা কাফেলা সিরিয়ার পথে যাতায়াত করত। আবু সুফিয়ানের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় এবং বিখ্যাত কোরাইশ নেতা ও যোদ্ধা আবু জেহেলের সক্রিয় অংশগ্রহণে বদর প্রান্তরে এ যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। ইসলামের প্রতিষ্ঠালগ্নে, যখন এর শত্র“রা ছিল প্রবল ও পরাক্রমশালী, তখন সংখ্যায় স্বল্পতা হেতু মুসলমানরা ছিল স্বাভাবিকভাবেই হীনবল। সে সময় আল্লাহর সাহায্য ছিল অপরিহার্য। মুসলমানদের মনোবল বৃদ্ধির জন্য আল্লাহর তরফ থেকে প্রকাশ্যে অভয়বাণী আসায় সংখ্যায় ও সামর্থ্যে তিনগুণ শক্তিশালী শত্র“পক্ষের মোকাবিলায় শামিল হওয়া সম্ভব হয়েছিল। স্বাভাবিক বিশাল ও সুসংগঠিত শক্রপক্ষের মোকাবিলায় নবদীক্ষাপ্রাপ্ত মুসলমানদের সংখ্যাগত দৈন্যতা তো ছিলই, তাদের ছিল না কোনো প্রকৃত প্রস্তুতিও। বদরের যুদ্ধে  নবদীক্ষাপ্রাপ্ত মুসলমানদের আল্লাহর সাহায্যে সূচিত বিজয় প্রসঙ্গে সুরা আনফালে উল্লেখ করা হয়েছে ‘(আল্লাহ) সত্যকে সত্য, অসত্যকে অসত্য প্রতিপন্ন করেন’ (৮ সুরা আনফাল । আয়াত ৮)। হিজরি দ্বিতীয় সনে সুরা আল বাকারার ১৮৩-১৮৫ ও ১৮৭ আয়াতসমূহ অবতীর্ণ হলে মুসলমানদের জন্য রোজা পালন আবশ্যকীয় (ফরজ) ঘোষণা করা হয়। সে বছরই বদর যুদ্ধের সময় মুসলমানগণ প্রথমবারের মতো রমজান মাসে রোজা পালন করছিলেন। রমজান মাসে বদরের যুদ্ধে মুসলমানরা শৈর্য্য, বীর্য, ত্যাগ ও তিতিক্ষার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছিল। বিপদে আপদে সমরে ষড়যন্ত্রে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা ও তা পাওয়ার মতো গৌরবের কিছু নেই। তাকওয়া বা খোদাভীতি এ সাহায্য প্রার্থনা ও প্রাপ্তিতে এক অনুপম প্রেরণার উপলক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। খোদার মহান অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশের তাগিদও খোদাভীতিরই পর্যায়ভুক্ত। সাচ্চা খোদাপ্রেমিক বা মুমিন বান্দার জন্য খোদার সাহায্য কীভাবে আসতে পারে বদর যুদ্ধে তার কিছু উদাহরণও প্রতিফলিত হয়েছে। এর মধ্যে উপলব্ধির বিষয় এই যে, আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দার ‘চিত্ত-প্রশান্তি-হেতু’ অনেক নিদর্শনই রেখেছেন এবং তিনি তা নিজ হাতে দান করে থাকেন। মাহে রমজানে সিয়াম সাধনার মধ্যে বদরের যুদ্ধের ঘটনা নবীন ইসলামের অস্তিত্ব রক্ষার প্রেক্ষাপটে এক অবিনাসী প্রত্যয় ও প্রতীতি দান করেছিল। ইতিহাসের সাক্ষ্য এই ইসলামের চরমতম সংকটকাল অতিক্রমে রমজানের মহিমা বিশেষ শক্তি জোগায়। [ সাবেক সচিব ও এনবিআরের প্রাক্তন চেয়ারম্যান]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর