না-ফেরার দেশে চলে গেলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রবীণ সাংবাদিক ও বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক রাহাত খান। গত রাত সাড়ে ৮টায় রাজধানীর ইস্কাটনে নিজ বাসবভনে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তাঁর স্ত্রী অপর্ণা খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে স্বামীর মৃত্যুর খবর জানিয়েছেন। তিনি ডায়াবেটিসসহ বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। এর আগে অসুস্থ হয়ে বেশ কিছুদিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। তাঁর বয়স হয়েছিল প্রায় ৮০ বছর। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, তিন ছেলে, এক মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তাঁর লাশ বারডেম হিমঘরে রাখা হয়েছে। আজ বেলা ১১টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে নামাজে জানাজা হবে।
রাহাত খানের পারিবারিক সূত্র জানান, তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী আজই মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হবে। প্রবীণ এ সাংবাদিকের মৃত্যুতে গভীর শোক ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাহাত খানের মৃত্যুর খবরে সহকর্মীদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও মন্ত্রিসভার সদস্যরাও শোক প্রকাশ করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে তাঁর স্মৃতি স্মরণ করে শোক প্রকাশ করেন। তাঁর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা জি এম কাদের, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম, দক্ষিণের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম। গভীর শোক প্রকাশ করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি সাইফুল আলম, সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মোল্লা জালাল, মহাসচিব শাবান মাহমুদ, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি কুদ্দুস আফ্রাদ, সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান তপু প্রমুখ।
গত ২০ জুলাই রাহাত খানকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর আগের দিন বাসায় খাট থেকে নামতে গিয়ে কোমরে ব্যথা পান তিনি। এরপর চিকিৎসকের পরামর্শে এক্স-রে করা হলে পাঁজরে গভীর ক্ষত ধরা পড়ে। এর পাশাপাশি তাঁর শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে জরুরি ভিত্তিতে বারডেম হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগ, কিডনি, ডায়াবেটিসসহ বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন তিনি। এসব কারণে তাঁর চিকিৎসা প্রক্রিয়া জটিল হয়ে পড়ায় সার্জারি করা যাচ্ছিল না বলে বাসাতেই অবস্থান করছিলেন। রাহাত খানের জন্ম ১৯৪০ সালের ১৯ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার জাওয়ার গ্রামে। তিনি ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। শিক্ষা জীবন শেষ করে রাহাত খান কিছুদিন জোট পারচেজ ও বিমা কোম্পানিতে চাকরি করে ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজে যোগদান করেন। তারপর একে একে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, চট্টগ্রাম সরকারি কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা করেছেন। ১৯৬৯ সালে দৈনিক সংবাদে তাঁর সাংবাদিকতা জীবনের হাতেখড়ি। পরে তিনি ইত্তেফাকে যোগদান করেন। ২০০৯ সাল থেকে তিনি ইত্তেফাকের সহকারী ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৩ সালে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় দৈনিক বর্তমান। সবশেষ তিনি দৈনিক প্রতিদিনের সংবাদ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।রাহাত খান ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত হন। বর্ণাঢ্য সাংবাদিকতা জীবনে রাহাত খান, ছোটগল্প, প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও উপন্যাসের নিপুণ কারিগর হয়ে ওঠেন। ১৯৭২ সালে তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘অনিশ্চিত লোকালয়’ প্রকাশিত হয়। তাঁর উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘অমল ধবল চাকরি’, ‘ছায়াদম্পতি’, ‘শহর’, ‘হে শূন্যতা’, ‘হে অনন্তের পাখি’, ‘মধ্যমাঠের খেলোয়াড়’, ‘এক প্রিয়দর্শিনী’, ‘মন্ত্রিসভার পতন’, ‘দুই নারী’, ‘কোলাহল’ ইত্যাদি।
রাহাত খান বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭৩), সুহৃদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭৫), সুফী মোতাহার হোসেন পুরস্কার (১৯৭৯), আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮০), হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮২), ত্রয়ী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৮) এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় একুশে পদক (১৯৯৬) লাভ করেন।