শনিবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

বিদেশে চাহিদা দক্ষ কর্মীর

বাংলাদেশ থেকে বেশির ভাগই যাচ্ছে অদক্ষ কর্মী, প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকাই সংকট

জুলকার নাইন

কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ থেকে দক্ষ মৎস্যজীবী নেয় মালদ্বীপ। চুক্তি অনুসারে এজেন্সিগুলোর মাধ্যমে পাঠানো হয় শ’দুয়েক বাংলাদেশি। নদীমাতৃক বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জের সবাই মাছ ধরতে পারেন এমন বিশ্বাসে সবাই-ই নিজেদের পটু মাছ শিকারি দাবি করেন। এজেন্সিগুলোও তাদের দক্ষ দেখিয়েই পাঠায়। কিন্তু মালদ্বীপে মাছ মারতে পাঠানোর পর দেখা গেল বেশির ভাগই পানিতে নামতে ভয় পাচ্ছেন। কারণ সেখানে মাছ মারতে হবে মহাসাগরে। পুকুরে জাল দিয়ে মাছ মারা আর সাগরে উত্তাল ঢেউয়ের মধ্যে প্রযুক্তির ব্যবহার করে মাছ মারা এক নয়। এই জালিয়াতির কারণে বন্ধ হয়ে যায় জেলে হিসেবে বাংলাদেশিদের যাওয়া।

অন্যদিকে মানিকগঞ্জের আজাহারুল ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় ছয় বছর আগে ওমান যান। ফ্রি ভিসায় বিদেশে গিয়েছিলেন দালালের মাধ্যমে। কিন্তু এখন সেখানে তাকে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। অবৈধ হয়ে এখন কাজহীন জীবন কাটাচ্ছেন। কেউ কাজ দিলেও বেতন দিচ্ছে খুবই কম। কিন্তু আজাহারুলের দুই ভাগ্নে কামাল ও জামাল একই দেশে গেছেন দক্ষ শ্রমিক হিসেবে। তারা নির্মাণ শিল্পে কাজ করছেন অন্যদের চেয়ে উচ্চ বেতনে। জানা যায়, প্রতি বছর প্রায় ৭ থেকে ৮ লাখ মানুষ বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। এর মাত্র এক-তৃতীয়াংশ প্রশিক্ষিত। এদের মধ্যে অধিকাংশই মধ্যপ্রাচ্যে যাচ্ছেন। কেউ কেউ কোম্পানির ভিসায় গেলেও কাজ না জেনে অদক্ষ হয়ে যাওয়ার কারণে ভোগান্তিতে পড়ছেন পদে পদে। এভাবে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি মানুষ বিভিন্ন কাজ করছেন। তার বেশির ভাগই আধা দক্ষ ও অদক্ষ হিসেবে বিদেশে গেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক জরিপ অনুযায়ী- বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যাওয়া কর্মীদের ৬২ শতাংশ অদক্ষ, ৩৬ শতাংশ আধা দক্ষ ও দুই শতাংশ মাত্র অতি দক্ষ। যে কারণে এসব কর্মীর মজুরিও কম। বাংলাদেশের প্রতিযোগী ভারত, নেপালের মতো দেশগুলো যেখানে দক্ষ কর্মী পাঠানোর সংখ্যা প্রতিনিয়তই বাড়াচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশের দক্ষ কর্মী পাঠানোর সংখ্যা বাড়ছেই না বরং কমছে।

প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, রেকর্ড ১০ লাখ জনশক্তি রপ্তানি হওয়া ২০১৭ সালে বাংলাদেশ থেকে দক্ষ শ্রমিক বিদেশে গেছেন ৪ লাখ ৩৪ হাজার জন। স্বল্প দক্ষ শ্রমিক গেছেন ৪ লাখ। আধা দক্ষ শ্রমিক ছিল ১ লাখ ৫৫ হাজার। পরের বছর ২০১৮ সালে  ৭ লাখ বিদেশগামী শ্রমিকের মধ্যে দক্ষ ছিলেন ৩ লাখ ১৮ হাজার, স্বল্প দক্ষ ২ লাখ ৮৩ হাজার এবং আধা দক্ষ ১ লাখ ১৭ হাজার। ২০১৯ সালে যাওয়াদের মধ্যে দক্ষ ছিলেন ৩ লাখ ৪ হাজার, স্বল্প দক্ষ ১ লাখ ৯৭ হাজার এবং আধা দক্ষ ছিলেন ১ লাখ ৪২ হাজার।

জনশক্তি রপ্তানিকারকরাই বলছেন, পরিসংখ্যান যাই হোক আসলে দক্ষ কর্মীর সংখ্যা অনেক কম। কারণ বিদেশি নিয়োগকর্তারা বিগত কয়েক বছরে নিয়োগের শর্তের সঙ্গে দক্ষ, আধা দক্ষ, স্বল্প দক্ষের শর্ত দিচ্ছেন। তাই অনেক সময় সম্পূর্ণ অদক্ষ কর্মীকেও বিভিন্ন ট্যাগ দিয়ে পাঠানো হচ্ছে। এর জন্য দক্ষ কর্মী তৈরির সুযোগের অভাবকে দুষছেন রপ্তানিকারকরা। জনশক্তি সম্পৃক্ত উদ্যোক্তাদের নিজস্ব উদ্যোগে সৃষ্ট কিছু কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে ও সরকারের টিটিসি থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে যতটা সম্ভব দক্ষ কর্মীরা বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। কিন্তু অভিবাসন খাতের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট কেউই দক্ষ কর্মী গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সুবিধা, ট্রেনিং সেন্টার স্থাপনের জন্য বিশেষ অঞ্চল বা জমি বরাদ্দ, ব্যাংক ঋণ সুবিধা ইত্যাদি কোনো ধরনের সরকারি-বেসরকারি সুবিধা পায় না।

জনশক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারা বিশ্বে এখন দক্ষ জনশক্তি প্রেরণের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এই প্রতিযোগিতায় টিকতে হলে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী দক্ষ জনশক্তি প্রেরণের আর কোনো বিকল্প নেই।

তবে মানবসম্পদকে দক্ষ জনসম্পদের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান রক্ষা করা অতিজরুরি। তাই আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী সব ধরনের টেকনিক্যাল বা কারিগরি, ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেল ও নার্সিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষণ তথা সার্টিফিকেট যেন লেবার রিসিভিং কান্ট্রিগুলো আস্থায় নেয় তা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে কারিগরি জ্ঞানসমৃদ্ধ দক্ষ জনশক্তির বিপুল চাহিদা থাকলেও দেশগুলো এ ধরনের জনশক্তি নেবে না। তাই বিশ্ব চাহিদা ও মান অনুযায়ী প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি তৈরির অবকাঠামোসহ প্রশিক্ষক অতীব জরুরি।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সচিব আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন বলেন, বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের ফলে নতুন বাস্তবতায় উন্নয়নের ধারা ধরে রাখতে হলে আমাদের দক্ষতার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। এটিকে বিবেচনায় নিয়ে সরকার কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে নানা রকম পদক্ষেপ নিয়েছে। কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোকে চাঙা করতে জনবল কাঠামো বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

খরচ বেশি বেতন কম : বিশ্বব্যাংকের হিসাব মতে, বিদেশ যেতে পৃথিবীতে বাংলাদেশি শ্রমিকদেরই সবচেয়ে বেশি টাকা গুনতে হয়। অভিবাসনের সর্বোচ্চ ব্যয় ধরা আছে মাত্র ২০০ ডলার। ভারতীয় শ্রমিকদের বিদেশ যেতে খরচ হয় গড়ে ১ লাখ ৮০ থেকে ২ লাখ টাকা। নেপালের ক্ষেত্রে যেটা ১ লাখেরও নিচে। আর ফিলিপাইন সরকার তো ঘোষণাই দিয়েছে অভিবাসন ব্যয় শূন্যের কোটায় নিয়ে আসার। অথচ বিপরীত চিত্র বাংলাদেশের। এখানে একজন শ্রমিকের বাইরে যেতে সর্বোচ্চ সাড়ে ৭ লাখ টাকা পর্যন্ত গুনতে হচ্ছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, সর্বোচ্চ খরচ করে সর্বনিম্ন বেতন পাচ্ছে বাংলাদেশিরাই। বাংলাদেশের চেয়ে পাঁচ লাখ কর্মী কম পাঠিয়েও ভারত রেমিট্যান্স পেয়েছে বাংলাদেশের প্রায় চারগুণ। নেপাল বাংলাদেশের চার ভাগের এক ভাগ লোক বাইরে পাঠিয়ে উপার্জন করছে ৯ বিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশের অর্ধেক লোক পাঠিয়ে বাংলাদেশের দ্বিগুণ রেমিট্যান্স আয় করে ফিলিপাইন। দক্ষ জনশক্তি পাঠাতে না পারায় বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে বলে মনে করেন এই খাতের বিশেষজ্ঞরা।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর