মঙ্গলবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

মামলা বাড়ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে

পুলিশ সদর দফতরে বছরে ১৮ হাজার নারীর অভিযোগ

আলাউদ্দিন আরিফ

ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপ্রতিরোধ্য অপব্যবহার করে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে হয়রানি, ব্ল্যাকমেলিং, চাঁদাবাজির ঘটনা ভয়ানক হারে বাড়ছে। অনলাইন প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে এসব অপরাধ বৃদ্ধি পাওয়ায় বাড়ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে থানা ও আদালতে দায়ের করা মামলার সংখ্যা।

পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, সাইবার অপরাধের শিকার বেশি হচ্ছেন নারীরা। সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো দায় এড়াতে পারে না- উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফেসবুক-ইউটিউবসহ যারাই এ দেশে ব্যবসা করবে, তাদের দফতর বাংলাদেশে থাকতে হবে। তাহলে ওসব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকেও সহজেই জবাবদিহিতার আওতায় আনা যাবে। সাইবার স্পেসে নারীদের হয়রানি রোধে কাজ করছে পুলিশ সদর দফতরের এলআইসি (ল’ফুল ইন্টারসেপশন সেল) শাখা পরিচালিত পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন। তারা এক বছরে ১৮ হাজার ভুক্তভোগীর কাছ থেকে অভিযোগ পেয়েছে। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, সাইবার স্পেসে হয়রানির শিকার নারীদের ৫৮ শতাংশই তরুণী। যাদের বয়স ১৮ থেকে ২৪ বছর। ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী নারী শতকরা ২০ শতাংশ। জানা গেছে, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন মহলের আপত্তি সত্ত্বেও ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হয়। পাসের তিন বছরের মধ্যে এই আইনে মামলার সংখ্যা ৩ হাজার ছাড়িয়েছে। প্রায় দেড় হাজারের মতো মামলা সরাসরি সাইবার ট্রাইব্যুনালে হয়েছে। অন্য মামলাগুলো থানা পুলিশ বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনালে পাঠিয়েছে। ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সাইবার ট্রাইব্যুনালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা প্রতিয়িত বেড়েই চলেছে। বর্তমানে এই ট্রাইব্যুনালে মামলার সংখ্যা ২ হাজারের বেশি। তবে কিছু ক্ষেত্রে মামলার সত্যতা পাওয়া যায় না। সঠিক প্রমাণ উপস্থাপন করা হয় না। ফলে অনেক খারিজ হয়ে যায়।’ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় ফাইনাল রিপোর্ট হওয়া বা খারিজ হওয়ার বিষয়ে আইনজীবীরা বলেন, দেখা গেল ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানহানিকর স্ট্যাটাস দেওয়ার জন্য একজন মামলা করছেন। কিন্তু মামলায় তিনি কোনো লিংক, স্ক্রিন শর্টসহ প্রয়োজনীয় তথ্য উল্লেখ করেননি। পরে দেখা যায় আসামি ওই স্ট্যাটাস মুছে ফেলেন। ফেসবুক থেকেও তথ্য পাওয়া যায় না। পর্যাপ্ত প্রমাণ না পাওয়ায় মামলাগুলো নষ্ট হয়। আবার অনেকে আপস করে ফেলেন। তাই কিছু মামলায় ফাইনাল রিপোর্ট বা খারিজ হয়ে যায়। তারা আরও বলেন, ঢাকায় সাইবার ট্রাইব্যুনাল গঠন হওয়ার পর ২০১৩ সালে তিনটি মামলা বিচারের জন্য পাঠানো হয়েছিল। ২০১৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩টি। পরের বছর মামলা আসে ১৫২টি। ২০১৬ সালে আসে ২৩৩টি। এই সংখ্যা পরের বছর দ্বিগুণের বেশি, ৫৬৮টি। ২০১৮ সালে ৬৭৬টি, ২০১৯ সালে ৭২১টি ও ২০২০ ও ২০২১ সালে এই মামলার সংখ্যা গড়ে ১ হাজারের বেশি হয়েছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কী ধরনের মামলা বেশি হয়- জানতে চাইলে ট্রাইব্যুনাল সংশ্লিষ্ট একজন আইনজীবী জানান, ‘সাধারণত পেশাগতভাবে হয়রানি করা, ব্ল্যাকমেল করা, দুর্নাম ছড়ানো, যৌন হয়রানি, চাঁদাবাজি, কুৎসা রটানো- এসব অপকর্মে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় প্রবাসে থাকা কিছু বাংলাদেশিও এসব সাইবার অপরাধে যুক্ত। দেশ থেকে যারা ছদ্মনাম ব্যবহার করছে তাদের আইনের আওতায় আনা গেলেও প্রবাসে থাকা ব্যক্তিদের সহজে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয় না। ফলে তারা বেপরোয়াভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার করে। পুলিশ সদর দফতরের এলআইসি শাখার পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ১৬ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত ১৭ হাজার ৭৭০ জনকে সেবা দেওয়ার জন্য তালিকাভুক্ত করে। সেবাপ্রত্যাশীদের মধ্যে ১২ হাজার ৯৪১ জন নারী সাইবার স্পেসে হয়রানির বিষয়ে অভিযোগ দেন। তাদের মধ্যে ৩৮৭৯ জন পরে পূর্ণাঙ্গ তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। পুলিশ ৮ হাজার ৩৩১ জনের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়। সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের হিসাবে, তাদের কাছে সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত যেসব অভিযোগ আসে তার মধ্যে ৪৩ শতাংশ বা ৫৬০৬টি ফেক আইডি সংক্রান্ত, ১০ শতাংশ বা ১৩৫২টি আইডি হ্যাক সংক্রান্ত, ১৫ শতাংশ বা ১৯২৮টি ব্ল্যাকমেল সংক্রান্ত, ১২ শতাংশ বা ১৪৮৫টি মোবাইল হ্যারেসমেন্ট সংক্রান্ত, ৮ শতাংশ বা ১০১৬টি আপত্তিকর কন্টেন্ট ছড়ানো সংক্রান্ত। পুলিশ সদর দফতরের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, নারীরা শিকার হওয়া সাইবার অপরাধগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, হয়রানির উদ্দেশে ভিকটিমের ছবি ও পরিচয় ব্যবহার করে ফেক আইডি বা বেনামে আইডি খুলে ভিকটিমের ছবি, ভিডিও বা অন্য কোনো তথ্য প্রচার করা হয়। আবার পাসওয়ার্ড চুরি বা হ্যাক করা, পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে বা সম্পর্কের কারণে ছবি, ভিডিও বা তথ্য ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে কোনো সুবিধা আদায় বা টাকা দাবি করা বা ব্ল্যাকমেল করা সংক্রান্ত। সাইবার অপরাধ বৃদ্ধির বিষয়টি জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (এলআইসি) মীর আবু তৌহিদ বলেন, ‘আমরা প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক অভিযোগ পাচ্ছি। এর মধ্যে কিছু অভিযোগ থাকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ সরাসরি ফৌজদারি অপরাধ সংক্রান্ত। আমরা সেগুলো গুরুত্ব সহকারে নিয়ে সংশ্লিষ্ট থানার হেল্প ডেস্কের সহযোগিতায় ভুক্তভোগীদের যোগাযোগ করিয়ে দিই। থানা পুলিশ বা পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট তদন্ত করে অভিযোগগুলোর বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, অভিযোগকারীর কারিগরি সহযোগিতা প্রয়োজন হয়। যেমন ফেক আইডি খোলা বা আইডি হ্যাক হয়ে যাওয়া। এ ধরনের ইস্যুতে আমরা প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিই অথবা আমরা ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে ওসব আইডি উদ্ধার বা বন্ধ করার ব্যবস্থা করে থাকি। তিনি বলেন, সাইবার অপরাধের বিষয়ে আইজিপি অত্যন্ত কঠোর। নারীরা এসবের শিকার হওয়ার বিষয়টি প্রতিকারের লক্ষ্যে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন চালু করেছে। এতে আমরা ভালো সেবা দিতে পারছি। এ ছাড়াও পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, কিছু লোক দেশ-বিদেশ থেকে ইউটিউব-ফেসবুকে নানা ধরনের অপপ্রচার, কুৎসা ও গুজব ছড়িয়ে যাচ্ছে। কুচক্রী মহল নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠিত নাগরিকদের বিরুদ্ধেও কুৎসা রটনা করছে। বিষয়টি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপরাধ হওয়ায় এ আইনে মামলা বাড়ছে। মামলা হলেও দুঃখজনক হচ্ছে আমরা অপপ্রচারমূলক কন্টেন্টগুলো সরাতে পারছি না। আমাদের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা যেন হাত-পা গুটিয়ে বসে আছেন। তাদের এই আচরণ নৈরাশ্যজনক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো বাংলাদেশে ব্যবসা করতে হলে তাদের অফিস স্থাপনে বাধ্য করতে হবে। এতে তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা সম্ভব হবে।

সর্বশেষ খবর