মঙ্গলবার, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা
গ্যাস সংকট

ভুগছে শিল্প খাত জ্বলে না চুলা

জিন্নাতুন নূর

তীব্র গ্যাস সংকটে দেশের শিল্প খাত ভুগছে, জ্বলছে না গ্রাহকদের চুলা। রাজধানীর বেশির ভাগ এলাকার মানুষ বেশ কিছুদিন ধরে তীব্র গ্যাস সংকটে চরম ভোগান্তিতে রয়েছেন। অনেক এলাকায় ভোর হওয়ার আগেই গ্যাসের চাপ এত কমে যায় যে, তা দিয়ে আর চুলায় আগুন ধরানো যায় না। গভীর রাতেই কেবল গ্যাসের দেখা মেলে। ততক্ষণে অধিকাংশ গৃহিণী থাকেন শীতের গরম চাদরে শরীর মুড়িয়ে নিদ্রায়। আবার তীব্র গ্যাস সংকটের মুখে শিল্পাঞ্চলে উৎপাদন ২০ থেকে ৩০ শতাংশে নেমে এসেছে বলে শিল্পমালিকরা জানিয়েছেন। মাস শেষে গ্যাস বিল পরিশোধ করেও বিকল্প জ্বালানির জন্য এখন গ্রাহককে বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে। এ জন্য অধিকাংশ গ্রাহকই ক্ষোভে ফুঁসছেন। দ্রুত এই সমস্যার সমাধান করা না গেলে শিল্পমালিকরা বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হবেন বলে আশঙ্কা করছেন।

শীতে বরাবরই রাজধানী ও তার আশপাশের এলাকায় গ্যাস সংকট দেখা দেয়। কিন্তু এবার এই সংকট তীব্রতর। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দিনে বা রাতের একটি নির্দিষ্ট সময় কিছুটা গ্যাস পাওয়া গেলেও তা দিয়ে রান্নার কাজ সারতে গৃহিণীদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। নিরুপায় গ্রাহকদের কেউ কেউ এলপি গ্যাসের সিলিন্ডার কিনছেন। কেউ মাটির চুলা আবার কেউ ইলেকট্রিক চুলায় প্রয়োজনীয় কাজ সারছেন। একটি অংশ রাইস কুকারে রান্নার কাজ করছেন। শীতে শিশু ও বয়স্কদের জন্য গরম পানির প্রয়োজন মেটাতে মানুষ বিকল্প ব্যবস্থায় যাচ্ছেন। অতি ভোরেই গ্যাস চলে যাওয়ায় পাউরুটি, কলা, বিস্কুট ও পান্তা ভাত খেয়ে সকালের নাস্তা সারছেন অনেক নগরবাসী। ভোরে কোনো রকম দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করছেন অনেকে। মেসে ও হোস্টেলে অবস্থান করা ছেলে- মেয়েরা হোটেলের খাবার খেয়ে দিন পার করছে। চাকরিজীবী গৃহিণীদের অবস্থা আরও করুণ। নগরীর ফার্মগেট, তেজকুনীপাড়া, নাখালপাড়া, খিলগাঁও, শাহজাদপুর, কুড়িল, বাড্ডা, আশকোনা,  মোহাম্মদপুর, মিরপুর, ধানমন্ডি, বাংলামোটর, ইস্কাটন, মতিঝিল, টিকাটুলী, স্বামীবাগ, গোপীবাগ, সায়েদাবাদ, রাজারবাগ, ঝিগাতলা, মহাখালী, আদাবর, বনশ্রী. মিরপুর ও পল্লবীতে গ্যাসের জন্য গ্রাহকরা হাহাকার করছেন। শুধু বাসাবাড়িতেই নয়, ঢাকার আশপাশের বিভিন্ন শিল্প-কারখানাতেও এখন গ্যাসের জন্য চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেন শিল্পমালিকরা। গ্যাস সংকটে শিল্প উৎপাদন কমে গেছে বলে তারা অভিযোগ করেন। জানা যায়, শিল্প এলাকাগুলোতে ১৫ দিন ধরে তীব্র গ্যাস সংকট চলছে। এতে  ডায়িং কারখানাগুলো স্পিনিং মিল থেকে সুতা না পেয়ে ডায়িংয়ের কাজ ঠিকভাবে করতে পারছে না। ফলে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এর ফলে শিল্পমালিকরা শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধে ঝামেলায় পড়তে যাচ্ছেন। আবার নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ক্রেতার কাছে পণ্য পৌঁছাতে না পারলে ক্রেতাকে উড়োজাহাজে করে পণ্য পৌঁছাতে হবে, এতে খরচ কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাবে।

এমএস ডায়িং, প্রিন্টিং অ্যান্ড ফ্যাশন লি. নারায়ণগঞ্জ বিসিক শিল্প নগরীর অন্যতম বড় পোশাক কারখানা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই কারখানায় ডায়িং, প্রিন্টিং, ফিনিশিং প্রতিটি সেকশনের উৎপাদন সক্ষমতা গড়ে ১০০ টন। কিন্তু গত ১৫ দিন ধরে তীব্র গ্যাস সংকটে উৎপাদন ২০ থেকে ৩০ টনে নেমে এসেছে। এখানে সকাল সাড়ে ৭টার পর গ্যাস চলে যায়, এতে অধিকাংশ মেশিনই বন্ধ থাকে।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফেকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) এর নির্বাহী সভাপতি এবং এমএস ডায়িং, প্রিন্টিং অ্যান্ড ফ্যাশন লির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ হাতেম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নারায়ণগঞ্জ শিল্প এলাকাতে এখন তীব্র গ্যাস সংকট আর সংকটের জন্য উৎপাদন ২০ থেকে ৩০ শতাংশে নেমে এসেছে। গ্যাস সংকটের কারণে রপ্তানিও ব্যাহত হচ্ছে। আর এই সংকটের সমাধান যদি দ্রুত করা না হয় তাহলে যেভাবে দেশের রপ্তানিহার বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা ব্যাহত হবে। এরই মধ্যে আমরা পেট্রোবাংলা ও তিতাস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলেছি। তাদের কাছে এ সমস্যার সমাধান চেয়েছি এবং অবৈধ সংযোগ বন্ধ করতে বলেছি। শিল্প-কারখানায় চোরাই লাইন বন্ধ করতে বলেছি। দ্রুত এলএনজি আমদানি করতে বলেছি। আমাদের প্রাকৃতিক গ্যাস কূপ খননে আরও কার্যক্রম বৃদ্ধি করতে হবে। তিতাসের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে শীতে পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ কম, তিতাসে চাহিদার অনুপাতে কম এলএনজি সরবরাহ এবং আশুগঞ্জে গ্যাস ক্ষেত্রে কারিগরি সমস্যা গ্যাস সংকটের কারণ।

তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শীতে প্রতি বছরই গ্যাস সংকট দেখা দেয়। তিতাসে বর্তমানে এলএনজি সরবরাহ কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী এলএনজি আমদানি হলে এই সংকট কমবে বলে তিনি মনে করেন।

বর্তমানে দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩ হাজার ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট। আর বিতরণকারী সংস্থাগুলো ২ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করছে। দেশে মোট চাহিদার ৭৫ শতাংশ গ্যাস উৎপাদিত হয় এবং ২০ শতাংশ আমদানি করা হয়। এর মধ্যে ৫ শতাংশ গ্যাস আন্তর্জাতিক খোলা বাজার থেকে আনা হয়।

সর্বশেষ খবর