শুক্রবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

ভাষার শরীরে নয়া প্রাণসঞ্চার সম্ভব

জাফর ওয়াজেদ

ভাষার শরীরে নয়া প্রাণসঞ্চার সম্ভব

একুশ শতকের তৃতীয়ার্ধে এসেও যে বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়, তা হচ্ছে, বাংলাভাষার বিচিত্র ও ঐশ্বর্যময় বিভিন্ন দিগন্ত এখনো আমাদের ভাষা চর্চাকারীদের দৃষ্টিতে দূরবর্তী রয়ে গেছে। সত্য যে, ভাষার জন্য রক্তদানকারী জাতি ভাষাতত্ত্ব এবং ভাষাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য মৌলিক চিন্তা-ভাবনার প্রতিফলন ঘটাতে পারেনি। ভাষাবিজ্ঞান উল্লেখযোগ্য চর্চা চার দশক ধরে হলেও প্রাগ্রসর পরিস্থিতি দৃশ্যমান হয়নি। যদিও বাস্তবতা হচ্ছে, জটিল বিষয়ের প্রকাশে বাংলাভাষা ধীরে ধীরে স্বাচ্ছন্দ্য অর্জন করেছে। বাংলাভাষার সামনে যে পাহাড় প্রমাণ প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তা দূর যে করা খুব কঠিন তা এই প্রযুক্তির উৎকর্ষতার যুগে মনে করার কোনো কারণ নেই। যদিও ভাষা শুধু তার লিপি ও বাকবিন্যাস এবং তার ব্যবহারে অস্তিত্ববান হয়ে থাকতে পারে না। তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে সংস্কৃতি তথা শিল্পকলা, পোশাক পরিচ্ছদ, খাবার দাবার ইত্যাদি। বাংলাভাষা চড়াই-উতরাই পাড়ি দিচ্ছে প্রতি মুহূর্তেই। এই ভাষার বর্ণমালায় আছে জটিলতা, নেই কোনো প্রামাণ্য ব্যাকরণ। সাধারণ মান্য এবং মান্য শিক্ষার্থী অভিধান নেই। বানানে চলে অরাজকতা। প্রযুক্তির কারণে রোমান হরফে বাংলা লেখা চলছে। তদুপরি নেই বাংলাভাষার কোনো আর্থিক মূল্য। একুশ শতকের বাঙালি প্রজন্ম ইংরেজি ভাষার প্রতি যতটা আগ্রহী, বাংলার প্রতি তত অনাগ্রহী। তারপরও বাংলাভাষার দুর্দিন আসছে এমনটা মনে হয় না। তথ্য প্রযুক্তি তথা কম্পিউটারে বাংলাভাষার ব্যবহারকে সম্প্রসারিত করা গেলে ভাষাচর্চার বিকাশ ঘটবে বৈকি। বাংলাভাষাকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে বিশ্লেষণ, গবেষণা ও ব্যবহারে প্রযুক্তিগত সহায়তা ক্রমশ কার্যকর হচ্ছে। ভাষাতাত্ত্বিক বিষয়গুলো বিশ্লেষণ, বানান সমস্যা, বাক্যগঠন প্রক্রিয়া, যথাযথ শব্দপ্রয়োগ-ইত্যকার বিষয়ে কম্পিউটার প্রযুক্তি সহায়ক হয়ে উঠছে। অবশ্য কোনো ভাষাকে বিজ্ঞানসম্মত বিচার-বিশ্লেষণ ও প্রাত্যহিক কাজকর্মে ব্যবহার করতে গেলে প্রথমেই দরকার সেই ভাষার বহুমাত্রিক ব্যবহারের বিস্তৃত বিশ্বাসযোগ্য নমুনা। প্রযুক্তির সহায়তায় নিত্য-ব্যবহৃত লিখিত বাংলাভাষার বিস্তৃত নমুনা ও প্রমাণ জীবনের নানাক্ষেত্র থেকে সংগ্রহ বা তুলে এনে কম্পিউটারে জড়ো করা সম্ভব। এতে আধুনিক বাংলাভাষার গবেষণা, বিশ্লেষণ কিংবা প্রয়োগের জন্য আর পরোক্ষ প্রমাণ কিংবা পড়ে-পাওয়া তথ্যের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার প্রয়োজন হবে না। বাংলাভাষার স্বরূপ, চরিত্র ও ব্যবহার বোঝার জন্য ভাষা নমুনা বা ভাষাংশ বিভিন্ন গাণিতিক নিয়ম ও পদ্ধতি অনুসারে বিশ্লেষণ করা সম্ভব এবং প্রাপ্ত তথ্য, প্রমাণ ও উদাহরণ ব্যবহার করে প্রায়োগিক ভাষাবিজ্ঞান ও ভাষাপ্রযুক্তির বিভিন্ন কাজ করা যায়। যাতে সমৃদ্ধ হতে পারে সাধারণ ভাষাজ্ঞান। উন্মুক্ত হতে পারে বাংলাভাষা গবেষণার নতুন দিগন্ত এবং উপকৃত হবে সমগ্র ভাষাগোষ্ঠী। ভাষাচর্চার প্রচলিত ঘেরাটোপ থেকে বাংলাভাষাকে বের করে এনে এর শরীরে নয়া প্রাণ সঞ্চার সম্ভব। কারণ বাংলাভাষা দুর্বল কোনো ভাষা নয়। এর শক্তিমত্তা যথেষ্ট। দুই শ বছর আগে বাংলাভাষার ব্যাকরণ রচয়িতা ও বহুভাষাবিদ উইলিয়াম কেরি অভিমত জানিয়েছিলেন বাংলাভাষা সম্পর্কে, “এই ভাষা প্রায় গ্রেট ব্রিটেনের তুল্য এক বৃহৎ ভূ-ভাগে প্রচলিত এবং যথোচিত অনুশীলন হইলে স্বতঃসিদ্ধ সৌন্দর্য ও সুস্পষ্টরূপে ভাব ব্যঞ্জনায় ইহা জগতের কোনো ভাষা অপেক্ষা নিকৃষ্ট হইবে না।” জার্মান ভাষাবিদ এফ এইচ ইসক্রাইন বিশ শতকের মাঝামাঝি বলেছিলেন, “বাংলাভাষা ইহার মধুরাক্ষরা শব্দ সমৃদ্ধিতে ইতালিয়ান ভাষার সমকক্ষ তৎসহ জটিল বিষয়সমূহ প্রকাশ করার পক্ষে জার্মান ভাষার ন্যায় শক্তি বহন করে।” জেডি এন্ডারসন আই সি এস ছিলেন যিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাভাষার সাবেক অধ্যাপক, মূল্যায়ন করেছেন এভাবে, “আমার ধ্রুব বিশ্বাস যে, মনের ভাবের পূর্ণ অভিব্যক্তি করিবার উপযোগী এবং অমর কথার বাহনস্বরূপ যে সকল শ্রেষ্ঠভাষা জগতে বিদ্যমান বাংলাভাষা তাহার অন্যতম।” বাংলাভাষা একটি জীবন্ত ভাষা। কোনো স্বাভাবিক ভাষা বেঁচে থাকার প্রথম ও প্রধান হলো তার শব্দভান্ডারের ক্রমিক বিস্তার। চলমান জীবনের নানাক্ষেত্র থেকে যদি নতুন শব্দ ভাষার শব্দভান্ডারে ক্রমাগত জড়ো হতে থাকে, তবে সে ভাষা জীবন্ত। যা প্রাণস্পন্দনে স্পন্দিত। এই শব্দ আসে নানা পথে, নানা ভাবে, নানা কারণে, নানা উদ্দেশ্যে। ভাষা ব্যবহারকারীরা তাদের জীবনযাপনের নতুন নতুন প্রয়োজন মেটাতে তৈরি করে কিংবা ধার করে নতুন শব্দ। কখনো বা পুরনো শব্দগুলোকে নতুন অর্থে ও নতুন আঙ্গিকে ব্যবহার করে। এসবই হচ্ছে ভাষার বেঁচে থাকা ও অগ্রগতি এবং বিস্তার ও উন্নতির লক্ষণ। বাংলাভাষারও সে অর্থে শব্দভান্ডার ক্রমশ স্ফীত হচ্ছে। নতুন নতুন শব্দ আসছে ভাষায়। লেখক : মহাপরিচালক, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট।

সর্বশেষ খবর