রাজধানীর শাহজাহানপুরে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু খুনের ঘটনায় চারজনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব সদর দফতরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-৩ সদস্যরা। গ্রেফতার ব্যক্তিরা হলেন- ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক, আবু সালেহ শিকদার ওরফে শুটার সালেহ, নাছির উদ্দিন ওরফে কিলার নাছির ও মোরশেদুল আলম ওরফে কাইল্লা পলাশ। শুক্রবার রাতে মুগদা, শাহজাহানপুর ও মিরপুর এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়।
তাদের কাছ থেকে হত্যাকান্ডের সময় নজরদারির কাজে ব্যবহার করা মোটরসাইকেল এবং হত্যার জন্য দেওয়া ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা ও মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন সংস্থাটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি বলেন, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে টিপু খুনের ঘটনা ঘটে। টিপু খুনের পরিকল্পনাকারী হিসেবে ক্ষমতাসীন দলটিরই স্থানীয় নেতা ওমর ফারুক জড়িত। জানা গেছে, টিপু একসময় মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। কিন্তু ২০১৩ সালে ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াজুল হক মিল্কী হত্যা মামলায় গ্রেফতার হওয়ার পর দলে পদ হারান তিনি। পরে অবশ্য ওই মামলা থেকে টিপু অব্যাহতি পান বলে তার সহকর্মীরা জানিয়েছেন। তিনি দলীয় পদ আর ফিরে না পেলেও তার স্ত্রী ফারহানা ইসলাম ডলি ওই এলাকার নারী ওয়ার্ড কাউন্সিলর। যে ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক গ্রেফতার হয়েছেন, সেই ১০ নম্বর ওয়ার্ডে টিপুর হোটেল রয়েছে, যেখানে তিনি নিয়মিত বসতেন। এ ছাড়া জাতীয় ক্রীড়া পরিষদসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদারি করতেন টিপু। পাশাপাশি মতিঝিল আইডিয়াল অ্যান্ড কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যও ছিলেন তিনি।
র্যাব মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেফতার চারজন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকান্ডের পরিকল্পনায় সম্পৃক্ততা সম্পর্কে তথ্য দিয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে মতিঝিল এলাকার চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, স্কুল-কলেজের ভর্তি-বাণিজ্য, বাজার নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে টিপু ও হত্যার পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে বিরোধ বিদ্যমান ছিল। হত্যাকান্ড দেশে সংঘটিত হলেও এর নিয়ন্ত্রণ হয়েছে দুবাইয়ে। দেশ থেকে কিলার নাছির, কাইল্লা পলাশসহ আরও কয়েকজন টিপুর অবস্থান সম্পর্কে বেশ কয়েক দিন ধরে মুসার কাছে তথ্য পাঠাতেন। ঘটনার দিন সন্ধ্যার পর কিলার নাছির অন্তত চারবার টিপুর অবস্থান সম্পর্কে মুসাকে অবহিত করেন।টিপু হত্যাকান্ডের পর ঘুরেফিরে আসছে মুসার নাম, যিনি তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী প্রকাশ-বিকাশের সহযোগী বলে পুলিশের ভাষ্য। শাহজাহানপুরের আমতলী এলাকার রাস্তায় ২৪ মার্চ রাতে অস্ত্রধারীর গুলিতে নিহত হন টিপু। তার মাইক্রোবাসের পাশে দাঁড়িয়ে গুলি ছোড়েন হেলমেটধারী আততায়ী। ওই সময় গাড়ির কাছেই রিকশায় থাকা বেগম বদরুন্নেছা সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী সামিয়া আফরান প্রীতিও গুলিতে নিহত হন। আহত হন টিপুর গাড়িচালক মুন্না।
মাত্র মিনিটখানেকের মধ্যে কাজ সেরে হামলাকারী সড়ক বিভাজক টপকে গুলি করতে করতে রাস্তার অন্য পাশে অপেক্ষায় থাকা একটি মোটরসাইকেলে উঠে পালিয়ে যান। এর আগে ওই হত্যা মামলায় মাসুম মোহাম্মদ আকাশ ও আরফান উল্লাহ দামালকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। গ্রেফতার দুজন রিমান্ডে রয়েছেন। ডিবির ভাষ্য, আকাশই টিপুকে গুলি চালিয়েছিলেন। এই হত্যার ঘটনায় সব মিলিয়ে ছয়জনকে গ্রেফতার করে ডিবি ও র্যাব।
র্যাব কর্মকর্তা খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘টিপু হত্যার ঘটনায় আন্ডারগ্রাউন্ডের কিছু লোক জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছি। বিদেশ থেকে টিপুকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল। এর প্রমাণও পাওয়া গেছে। টিপু হত্যায় মোট ১৫ লাখ টাকা বাজেট করা হয়েছিল এবং মূল সমন্বয়কারী কিলার মুসা হত্যাকান্ডের আগেই গোপনে দুবাই চলে গেছেন। সেখানে বসেই ছক কষেছেন তিনি। কিলার মুসা নিজেও বোঁচা বাবু হত্যা মামলার আসামি।’
টিপু হত্যার সমন্বয়কারী সুমন শিকদার ওরফে মুসাকে দুবাই থেকে ফিরিয়ে আনতেও কাজ চলছে। এখন মুসা সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য দুবাইয়ের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আদান-প্রদান করা হচ্ছে। পুলিশ সদর দফতরের মাধ্যমে যথাযথভাবে দুবাই কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হবে। পাশাপাশি হত্যায় জড়িত শামীম ওরফে মোল্লা শামীমকেও খোঁজা হচ্ছে। হত্যাকান্ডের অন্যতম পরিকল্পনাকারী গ্রেফতার ওমর ফারুক। হত্যা ঘটনার পরিকল্পনা, আন্ডারওয়ার্ল্ডের সঙ্গে যোগাযোগ ও হত্যাকান্ড সংঘটনের বিষয়টি তত্ত্বাবধান ও অর্থ লেনদেন করেন তিনি। ওমর ফারুক ২০১৬ সালে রিজভী হাসান ওরফে বোঁচা বাবু হত্যাকান্ডের চার্জশিটভুক্ত ৪ নম্বর আসামি। ওই মামলায় ইতিপূর্বে কারা ভোগ করেন তিনি। গ্রেফতার নাছির উদ্দিন ওরফে কিলার নাছির হত্যাকান্ডের সময় টিপুকে নজরদারি ও হত্যার জন্য অর্থ প্রদান করেছেন। ঘটনাস্থলের কাছে তাকে সাদা শার্ট, জিন্স প্যান্ট ও জুতা পরিহিত অবস্থায় দেখা যায়। ঘটনার পর তিনি তার মোবাইল ফোন ফ্ল্যাশ করে বিক্রি করে দেন ও সিমকার্ড ভেঙে ফেলেন। র্যাব পরে ওই মোবাইল ফোন ও সিমকার্ড উদ্ধার করে। এ ছাড়া ঘটনার আগের দিন তিনি কুমিল্লার সীমান্তবর্তী এলাকা চৌদ্দগ্রামে এক দিন অবস্থান করেছিলেন। তিনি রিজভী হাসান ওরফে বোঁচা বাবু হত্যা মামলার আসামি। তার নামে অস্ত্র আইনে পল্লবী থানায় আরও একটি মামলা রয়েছে। গ্রেফতার মোরশেদুল আলম ওরফে কাইল্লা পলাশ ঘটনার দিন টিপুকে নজরদারি এবং আন্ডারওয়ার্ল্ডের সঙ্গে সমন্বয় করিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে হত্যাকান্ড বাস্তবায়নে সহায়তা করেছেন। ইতিপূর্বে তিনি মতিঝিল থানায় অস্ত্র আইনের একটি মামলায় কারা ভোগ করেছেন। গ্রেফতার আবু সালেহ শিকদার ওরফে শুটার সালেহ ঘটনার পরিকল্পনা ও অর্থ প্রদানের সঙ্গে জড়িত। তিনি রিজভী হাসান ওরফে বোঁচা বাবু হত্যা মামলার আসামি। তার নামে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় হত্যা, অস্ত্র, চাঁদাবাজিসহ অন্যান্য অপরাধে ১২টি মামলা রয়েছে এবং বিভিন্ন মেয়াদে তিনি কারা ভোগ করেছেন।