বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করা সুস্পষ্ট নিম্নচাপ রূপ নিতে যাচ্ছে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে। এটি সোমবার (আজ) দিবাগত রাতের পর থেকে মঙ্গলবার সন্ধ্যার মধ্যে বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানতে পারে। এখন গভীর নিম্নচাপটি উত্তর-পশ্চিম দিকে যাচ্ছে। যদি দিক পরিবর্তন না করে তবে এটি ভারতের ভুবনেশ্বর ও পশ্চিম বাংলায় আঘাত হানবে। এটি উত্তর-পূর্ব দিকে মোড় নিতে পারে। যদি উত্তর-পূর্ব দিকে মোড় নেয় তাহলে এটি কক্সবাজার থেকে সাতক্ষীরা পর্যন্ত প্রতিটি জেলাতেই আঘাত হানবে। উপকূলে আঘাত হানার সময় ঘূর্ণিঝড়ের বাতাসের গতি প্রতি ঘণ্টায় ৯০ থেকে ১১০ কিলোমিটার থাকতে পারে। সম্ভাব্য এই দুর্যোগের আশঙ্কায় জানমাল নিয়ে উদ্বিগ্ন উপকূলের ১৯ জেলার লাখ লাখ মানুষ। গভীর নিম্নচাপের প্রভাবে এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আবহাওয়া কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গভীর নিম্নচাপটির বর্ধিতাংশ, অমাবস্যা তিথি ও বায়ুচাপ পার্থক্যের আধিক্যের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা-সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোর নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৩ থেকে ৫ ফুট অধিক উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে। জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা পরবর্তী সময়ে আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সব ধরনের মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান গতকাল সচিবালয়ে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির বাস্তবায়ন বোর্ডের জরুরি সভার আগে সাংবাদিকদের বলেন, লঘুচাপ সৃষ্টির পর থেকেই আমাদের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। দেশি ও আন্তর্জাতিক পূর্বাভাস সেন্টারগুলোর সঙ্গে আমরা যোগাযোগ রাখছি। সম্ভাব্য ঝুঁঁকিপূর্ণ জেলাগুলোকে আগাম প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সব জেলা প্রশাসকের সঙ্গে আমাদের ভার্চুয়ালি মিটিং হয়েছে। জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির মিটিং হয়েছে। সিপিপিকে (ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি) প্রস্তুতি গ্রহণ ও সতর্কবার্তা প্রচারের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। জেলা পর্যায়ে আশ্রয় কেন্দ্রগুলো আমরা প্রস্তুত রাখতে বলেছি। আশ্রয় কেন্দ্রগুলো পরিষ্কার করা হয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রে মানবিক সহায়তা দিতে আমরা প্রত্যেক জেলায় ২৫ টন চাল, ৫ লাখ টাকা এবং ড্রাইকেক ও বিস্কুট সরবরাহ করেছি। এটা মজুদ আছে, যে কোনো সংখ্যক লোক হলে খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারবে। আবহাওয়া অধিদফতরের আবহাওয়াবিদ ড. মো. আবুল কালাম মল্লিক গতকাল সন্ধ্যায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে আমরা আশঙ্কা করছি যে নিম্নচাপটি স্বল্প সময়ের মধ্যে গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়ে রবিবার রাত ৯টার মধ্যে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেওয়া মাত্রই সমুদ্রবন্দরগুলোতে স্থানীয় সতর্কতা সংকেত বাড়ানো হবে। ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কায় খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, ভোলা, বরিশাল, নোয়াখালী, ফেনীসহ দেশের উপকূলীয় এলাকা এবং নদীবন্দরগুলোকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আবহাওয়াবিদরা এখন পর্যন্ত মনে করছেন যে, এটি মাঝারি মাত্রার ঘূর্ণিঝড়। তবে এটি আঘাত হানার সময় অমাবস্যা থাকবে। এ কারণে বাতাসের গতি কমলেও জলোচ্ছ্বাসের কারণেই উপকূলীয় এলাকায় ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। তবে আজ (সোমবার) দেশের উপকূলসহ বেশির ভাগ এলাকাজুড়ে বৃষ্টি শুরু হতে পারে। বৃষ্টি বেশি হলে ঘূর্ণিঝড়ের গতি কমে আসতে পারে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবি) জানিয়েছে, বঙ্গোপসাগরে গভীর নিম্নচাপ থেকে সৃষ্ট হতে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে সোমবার থেকে বুধবার পর্যন্ত উপকূলীয় অঞ্চলসহ দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হওয়ার কথা। ভারী বর্ষণের ফলে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতি হতে পারে।
বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কিছু স্থানে আকস্মিক বন্যা এবং পূর্বাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মহুরী, মনু, খোয়াই, সুরমা-কুশিয়ারা নদ-নদীর পানি সমতল দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে। সময় বিশেষে আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সেন্ট মার্টিনে পর্যটকদের উদ্ধার : বৈরী পরিবেশে বঙ্গোপসাগরের কক্সবাজার উপকূল প্রচ- উত্তাল হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় গতকাল (রবিবার) রাতের মধ্যে সেন্ট মার্টিনে আটকে পড়া ৪ শতাধিক পর্যটককে জাহাজের মালিক ও জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় কক্সবাজারে ফিরিয়ে আনা হয়।
আটকে পড়া পর্যটকদের ফিরিয়ে আনতে কক্সবাজার থেকে এমভি কর্ণফুলী জাহাজ সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশে রওনা হয়। ঘূর্ণিঝড়ের শঙ্কায় আজ (সোমবার) সকাল থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সেন্ট মার্টিনে পর্যটকদের ভ্রমণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।সাতক্ষীরায় বেড়িবাঁধে ভয়াবহ ফাটল : নতুন করে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন সাতক্ষীরার উপকূলবাসী। সুন্দরবন সংলগ্ন শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ ও ২ এর অধীনে ৮২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধে ফাটল ও ভাঙন থাকায় চরম ঝুঁকিতে রয়েছে তারা। ৩ থেকে ৫ ফুট উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাস হলে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আইলার মতো বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুটি বিভাগের আওতাধীন প্রায় ৭৮০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এসব বাঁধের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ ৩৫টি পয়েন্টের ভয়াবহ ভাঙন ও ফাটল রয়েছে। সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১৫৬টি সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত রাখা হয়েছে। শ্যামনগর, আশাশুনি, কালিগঞ্জ ও দেবহাটা উপজেলার ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত করতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
হাতিয়ার সঙ্গে সারা দেশের নৌ যোগাযোগ বন্ধ : নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার সঙ্গে সারা দেশের নৌ যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট গভীর নিম্নচাপের প্রভাবে নদী উত্তাল থাকায় গতকাল বিকাল ৩টা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত কার্যকর থাকবে বলে জানিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। নিম্নচাপের প্রভাবে গতকাল সকাল থেকে জেলার বিভিন্ন স্থানে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। নোয়াখালী জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় ৪০১ আশ্রয়ণ কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সেই সঙ্গে উপকূলে ৮ হাজার ৩৮০ জন স্বেচ্ছাসেবককে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বাগেরহাট : দেশের উপকূলের দিকে ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং মোকাবিলায় বাগেরহাট জেলা প্রশাসন, মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ, সুন্দরবন বিভাগ ও কোস্টগার্ড ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। মোংলা সমুদ্র বন্দরে জারি করা হয়েছে তিন নম্বর সতর্ক সংকেত। বঙ্গোপসাগর উত্তাল হয়ে উঠেছে।
গতকাল সকাল থেকে বাগেরহাট জেলাজুড়ে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় বিপাকে পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ। এদিকে বাগেরহাটের উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড় ধেয়ে আসার খবরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বাগেরহাটে প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৩৪০টি আশ্রয় কেন্দ্রসহ স্বেচ্ছাসেক ও মেডিকেল টিম। প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৩৪০টি আশ্রয় কেন্দ্র। দুর্যোগের সময়ে এসব আশ্রয় কেন্দ্রে ২ লাখ ৮ হাজার ৪৩০ জন আশ্রয় নিতে পারবে। প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসেবে নগদ ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা ও ২৯৮ মেট্রিক টন চাল মজুদ রয়েছে।
পটুয়াখালী : পটুয়াখালীতে ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলার জন্য মানুষের জানমাল রক্ষা, আঘাত হানার পূর্বে উপকূলের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার জনসাধারণকে নিরাপদে কাছাকাছি আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসাসহ পরবর্তী সব ধরনের উদ্ধার তৎপরতার বিষয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। জেলার ৮ উপজেলায় মোট ৭০৩টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এ ছাড়াও মানুষের আশ্রয়ের জন্য ২৬টি মুজিব কিল্লা প্রস্তুত রয়েছে। জেলায় প্রতিটি ইউনিয়নে মেডিকেল টিম, পর্যাপ্ত খাবার স্যালাইন, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, শুকনা খাবার এবং নগদ অর্থ সরবরাহ করা হবে। পাশাপাশি মানুষের জানমাল নিরাপত্তাসহ সব বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সার্বিক সহযোগিতা করবেন। কোনো জেলে সমুদ্রে যাতে না যায় এ জন্য সব মৎস্য কর্মকর্তাকে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
পিরোজপুর : পিরোজপুরে গতকাল সকাল থেকে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন রয়েছে। দুপুরের পর থেকে শুরু হয়েছে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’ আঘাত হানলে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে অরক্ষিত বেড়িবাঁধের আশপাশে মানুষ রয়েছে আতঙ্কে। ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’ মোকাবিলায় পিরোজপুর জেলা প্রশাসন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রস্তুতিমূলক সভা করেছে। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহেদুর রহমান জানান, জেলার সাত উপজেলায় জনসাধারণের আশ্রয়ের জন্য ২৬০টি সাইক্লোন শেল্টার যেখানে ৫ লাখ ৫৩ হাজার ২৫০ জন মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে। এ ছাড়া ১৭৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রস্তুত আছে যেখানে আরও ১ লাখ ২৮ হাজার ২৫০ জন মানুষ বিপদের সময় আশ্রয় নিতে পারবে। এ ছাড়া প্রাথমিক পর্যায়ে ২ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার, ২৫০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ১ লাখ টাকা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। জেলা রেড ক্রিসেন্ট ইউনিটের ৩০ জন স্বেচ্ছাসেবকসহ রেড ক্রিসেন্টের শতাধিক স্বেচ্ছাসেবক উপজেলাসমূহে প্রস্তুত রাখা হয়েছে।