আরব উপসাগরের এক দিক থেকে সূর্য ওঠে কাতারের মরুভূমিতে উত্তাপ ছড়িয়ে ডুবে গেছে আরেক দিকে। রাতের অন্ধকারে হিমশীতল করা বাতাস ছুটেছে মরুর বুকে। এই ঠাণ্ডা বাতাস থেকে বাঁচতে বাড়তি কাপড় জড়াতে হয়। তবে গতকাল রাতে হিমশীতল বাতাসের মধ্যেও কাতারের রাজধানী দোহায় ছিল মধ্য গগনের উত্তাপ। ফ্যান ফেস্টিভ্যালের দারুণ আয়োজনে সেই উত্তাপ বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে ফিফা। নিকি মিনাজ, মালুমা আর মরিয়মের আরবি-ইংলিশ-স্প্যানিশ ভাষার গান ‘তুকোহ তাকা’য় মুগ্ধ হয়েছেন ফুটবলপ্রেমীরা। বিশ্বকাপের ঠিক আগমুহূর্তে উন্মাদনায় মেতে ওঠার ওয়ার্মআপই যেন সেরে নিয়েছেন সারা বিশ্ব থেকে ছুটে আসা কয়েক মিলিয়ন দর্শক। আজ আরব সাগরের গভীর থেকে উঠে আসা সূর্য ঘোষণা করবে নতুন দিনের। ফুটবলের বইয়ে লেখা হবে নতুন অধ্যায়। মধ্যপ্রাচ্যের আগুন-গরমে বিশ্বকাপ আয়োজনের ইতিহাস গড়তে যাচ্ছে কাতার। আজ স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচে স্বাগতিক কাতার মুখোমুখি হবে ইকুয়েডরের। ম্যাচের আগে হবে জাঁকজমকপূর্ণ উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। প্রথমে এ অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ পপতারকা ডুয়া লিপার পারফরম করার কথা ছিল। তবে ওরা কেউই আসছেন না বলে জানিয়েছেন। ফিফার তালিকায় থাকা তারকাদের মধ্যে নোরা ফাতেহি এখনো অন্তত ‘না’ করেননি। গতকাল যোগাযোগ করা হলে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান নিয়ে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত চূড়ান্ত কিছু জানায়নি ফিফা। তবে কেউ আসুক আর না-ই আসুক, বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হতে যাচ্ছে জাঁকজমকপূর্ণই। তুকোহ তাকা, ম্যাজিক ইন দ্য এয়ার গানের তালে তালে ফুটবলের ছন্দে হারিয়ে যাবেন দর্শক। রেফারির বাঁশি বাজার আগেই শুরু হয়ে যাবে বিশ্বকাপের চূড়ান্ত উন্মাদনা। বিশ্বকাপ আয়োজন করতে গিয়ে কাতার দারুণ এক দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছে পৃথিবীর সামনে। এক সময় পুরো আরব অঞ্চলে ছিল যাযাবরদের আধিপত্য। তাদের নির্দিষ্ট কোনো এলাকা ছিল না। খাদ্যশস্যের সন্ধানে বিভিন্ন গোত্রের স্কাউটরা বেরিয়ে পড়ত। কোনো উপযুক্ত স্থানের সন্ধান পেলেই গোত্রের অবস্থানে ফিরে এসে খবর দিত। খিমা (আরবের তাঁবু) গুটিয়ে নতুন স্থানের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ত যাযাবর গোষ্ঠী। অনেক সময় একই স্থানে দুই গোত্র চলে এলে হতো যুদ্ধ। রক্তক্ষয়ী সেই যুদ্ধে দুর্বল গোত্র প্রায় নিঃশেষ হয়ে যেত। বন্দিদের বিক্রি করা হতো। আরবের এমন ইতিহাস প্রায় সবারই জানা। কিন্তু বর্তমানে আরব অঞ্চলে এলে অতীতের সেই ভয়ংকর ঘটনাগুলোকে মনে হবে গ্রিক মিথের মতোই অলীক কল্পনা। চারপাশে উঁচু উঁচু ভবন। ঝকঝকে তকতকে পরিবেশ। কাতার। আরব বিশ্বেরই কেবল নয়, সারা দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ ধনী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। তাদের মাথাপিছু আয় ৮২ হাজার ৮৭৭ ডলার। ধনীর তালিকায় পঞ্চমে অবস্থান কাতারের। অর্থবিত্তে দুনিয়ার সেরা দেশগুলোর মধ্যে থাকলেও নিজেদের অতীত ভুলে যায়নি তারা। ইতিহাসের সাক্ষী খুঁজে পাওয়া যায় কাতাদের চারদিকে। কোথাও প্রাচীন দুর্গের মতো তৈরি করা হয়েছে বাড়ি। কিছু সরকারি অফিস দেখলেও মনে হবে, যেন প্রাচীন কোনো যুগের তৈরি দুর্গম দুর্গ। কোথাও আবার যাযাবরদের খিমার মতো দেখতে ভবন। শীতকালে মরুভূমিতে এখনো খিমা তৈরি করে পরিবারসহ দিন কয়েকের জন্য চলে যান কাতারের স্থানীয় লোকজন। তারা নিজেকে এবং পরিবারের তরুণ সদস্যদের পূর্বপুরুষদের কষ্টকর দিনগুলোর কথাই যেন মনে করিয়ে দিতে চান। প্রথমবারের মতো আরব মরুর দেশ কাতার বিশ্বকাপ আয়োজন করতে গিয়ে মনে রেখেছে অতীতের কথা। বিশ্বকাপের স্টেডিয়ামগুলোকে তৈরি করেছে নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের কথা ভেবে। কাতার বিশ্বকাপে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও উদ্বোধনী ম্যাচ হতে যাচ্ছে আল খোর শহরের আল বাইত স্টেডিয়ামে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে যাযাবরদের বিরাটাকৃতির কোনো খিমা, যেখানে হয়তো লুকিয়ে আছে মরুভূমির কোনো রহস্য! আসলেই হয়তো রহস্য লুকিয়ে আছে আল বাইত স্টেডিয়ামে। দোহা থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরের শহর আল খোর। কাতারের লোকসংখ্যা খুব কম হওয়ায় যাতায়াত ব্যবস্থা নিয়ে খুব একটা ভাবতে হয় না সরকারকে। বিশেষ করে স্থানীয় ও বিদেশি প্রায় সবারই আছে ব্যক্তিগত গাড়ি। যাদের নেই, তারাও ভাড়া করা ট্যাক্সিতে চড়ে এপার-ওপার করেন। বিশ্বকাপের জন্য অবশ্য বিশেষ আয়োজন আছে কাতারের। তারা প্রায় ৪ হাজার নতুন গাড়ির ব্যবস্থা করেছে বিশ্বকাপের দর্শকদের এক স্থান থেকে আরেক স্থানে আনা-নেওয়ার জন্য। বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করেই তৈরি করেছে আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রো লাইন। তবে বাসের সুবিধা কেবল ম্যাচের দিনই পাওয়া যাবে। অন্য দিনগুলোতে স্টেডিয়ামে যেতে হলে প্রয়োজন ব্যক্তিগত যানবাহন অথবা ভাড়া করা ট্যাক্সি। অনেকটা যেন লোকচক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে রাখা হয়েছে কাতার জাতীয় দল ও তাদের ভেন্যুকে! আল খোরের আল বাইত স্টেডিয়ামে আজ স্বাগতিক কাতার উদ্বোধনী ম্যাচে মুখোমুখি হবে লাতিন আমেরিকান ফুটবল শক্তি ইকুয়েডরের। এই মাঠে আরও একটা ম্যাচ খেলবে কাতার। ২৯ নভেম্বর, নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে। আল খোরের আল বাইত স্টেডিয়াম থেকে শুরু হচ্ছে বিশ্ব ফুটবলের মহারণ। শেষ হবে দোহার লুসাইল স্টেডিয়ামে, ১৮ ডিসেম্বর।