শুক্রবার, ৬ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা
জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতি

দুর্নীতি সন্ত্রাস মাদক নির্মূলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করুন

নিজস্ব প্রতিবেদক

দুর্নীতি সন্ত্রাস মাদক নির্মূলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করুন

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, দুর্নীতি-সন্ত্রাস, মাদক ও জঙ্গিবাদ সম্পূর্ণরূপে নির্মূলের মাধ্যমে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাঙালি জাতিকে আরও ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।

গতকাল জাতীয় সংসদের ২১তম ও নতুন বছরের প্রথম অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে রাষ্ট্রপতি এ কথা বলেন। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন।

সংসদে রাষ্ট্রপতি ১৬৮ পৃষ্ঠার ভাষণে সংক্ষিপ্তসার পাঠ করে শোনান। ভাষণের পর রাষ্ট্রপতি সংসদের সাংবাদিক লাউঞ্জে এসে তাদের সঙ্গে নতুন বছরের শুভেচ্ছা ও মতবিনিময় করেন। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের  পররাষ্ট্রনীতির মূলমন্ত্র ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরিতা নয়’-এ নীতির ওপর ভিত্তি করে প্রধানমন্ত্রী  শেখ হাসিনার গতিশীল এবং দূরদর্শী নেতৃত্বে পরিবর্তিত বৈশ্বিক  প্রেক্ষাপটে প্রতিবেশী দেশসমূহের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শ্রমবাজার সম্প্রসারণে সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের মানবিক সাহায্য প্রদান, নারীর ক্ষমতায়ন এবং জলবায়ুর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হচ্ছে। তিনি প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বলেন, দেশের অগ্রযাত্রাকে বেগবান করতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর জাতির পিতার আদর্শকে ধারণ করে বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে জাতি এগিয়ে যাক ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত, আত্মমর্যাদাশীল বঙ্গবন্ধুর সমৃদ্ধ ‘সোনার বাংলা’ গড়ার পথে।

নারীর ক্ষমতায়ন প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপতি বলেন, সরকারের যুগোপযোগী ও নারীবান্ধব কর্মসূচি গ্রহণের ফলে বাংলার নারীরা দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করছে। ২০২২ সালে সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা অর্জনের মাধ্যমে নারীরা দেশের জন্য এক অনন্যসাধারণ গৌরব বয়ে এনেছে। তথ্যপ্রযুক্তিতে প্রবেশাধিকার এবং তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক সেবা প্রদানের মাধ্যমে ১ কোটি ১০ লাখ গ্রামীণ নারীদের তথ্যপ্রযুক্তিতে ক্ষমতায়ন করা হয়েছে। সব নারী উদ্যোক্তাকে ই-কমার্সে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে ই-কমার্স মার্কেটপ্লেস ‘লালসবুজ ডটকম’ এবং ‘ই-জয়িতা’ চালু করা হয়েছে। তিনি শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগতি অব্যাহত রয়েছে উল্লেখ করে বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের নিট ভর্তি হার ৯০ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৯৭ দশমিক ৪২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষায় ‘ঝরে পড়ার হার’ ৪৯ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ১৪ দশমিক ১৫ শতাংশে নেমে এসেছে। সম্প্রতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩৭ হাজার ৫৭৪ জন সহকারী শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যা স্বাধীনতার পর এক আদেশে সর্বোচ্চ সংখ্যক।

রাষ্ট্রপতি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে বলেন, ২০২২ সাল আমাদের জন্য ছিল চ্যালেঞ্জের একটি বছর। সমগ্র বিশ্বই পার করছে এক কঠিন সময়। করোনা অতিমারি আমরা সফলভাবে মোকাবিলা করে অর্থনীতির গতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হলেও রাশিয়া এবং ইউক্রেনের যুদ্ধ আমাদের এই অগ্রযাত্রাকে শ্লথ করেছে। তারপরও ২০২১-২২ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাজেট ১৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। তিনি পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেন, ২০২১-২২ অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক দুই-পাঁচ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা সামগ্রিক বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ইতিবাচক। মাথাপিছু জাতীয় আয় পূর্ববর্তী অর্থবছর থেকে ২৩৩ মার্কিন ডলার বৃদ্ধি পেয়ে ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৬০ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার এবং  বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ৩ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলারে।  রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, আমাদের অর্থনীতিতে বস্ত্র ও পাট খাতের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে ১ দশমিক ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং তৈরি পোশাক খাত থেকে ৪২ দশমিক ৬১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়েছে। বাংলাদেশের সোনালি ঐতিহ্য মসলিনের সুতা  তৈরির প্রযুক্তি ও ঢাকাই মসলিন পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, করোনার অভিঘাত মোকাবিলায় বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজের কার্যকর বাস্তবায়নের ফলে আমাদের অর্থনীতিতে গতিশীলতা ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। সরকার ঘোষিত ১ লাখ ৮৭ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকার কৃষি, গার্মেন্টসহ ২৮টি প্রণোদনা প্যাকেজের সরাসরি উপকারভোগী প্রায় ৭ কোটি ৩২ লাখ ব্যক্তি ও প্রায় ২ লাখ প্রতিষ্ঠান।

মো. আবদুল হামিদ বলেন, এখন প্রত্যন্ত গ্রামেও একজন দিনমজুরের বেতন দিনে কমপক্ষে ৭০০ টাকা। একই সঙ্গে বেড়েছে জাতীয় উৎপাদন। বৈশ্বিক অর্থনীতির অস্থিতিশীলতা সত্ত্বেও দেশের খাদ্য নিরাপত্তা সুরক্ষিত রয়েছে এবং বর্তমানে দেশে খাদ্যশস্য মজুদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ দশমিক ১৪ লাখ মেট্রিক টন, যা সন্তোষজনক। এ ছাড়া এবার দেশব্যাপী আমন ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। রাষ্ট্রপতি সংসদকে জানান, হর্টিকালচার, মৎস্য চাষ, পোলট্রি, ডেইরি ও প্রাণিসম্পদ খাতে পর্যাপ্ত ঋণ প্রবাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিশেষ প্রণোদনামূলক পুনঃঅর্থায়ন স্কিমের আওতায় এ পর্যন্ত ১ লাখ ৮৭ হাজারের অধিক সুবিধাভোগীর অনুকূলে স্বল্প সুদে প্রায় ২ হাজার ৭৮৬ কোটি টাকার বেশি ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় মাছ ধরা বন্ধকালীন ২০২১-২২ অর্থবছরে ১২ লাখ ৪৫ হাজারের অধিক জেলে পরিবারকে প্রায় ৯৬ হাজার ৫৫০ মেট্রিক টনের অধিক খাদ্যশস্য ভিজিএফ হিসেবে প্রদান করা হয়েছে। পাশাপাশি ৮ লাখের অধিক মৎস্য চাষি/খামারিকে প্রায় ৯০৩ কোটি টাকা নগদ এবং উৎপাদন উপকরণ সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।

রাষ্ট্রপতি বলেন, সরকার ‘শেখ হাসিনার বাংলাদেশ, ক্ষুধা হবে নিরুদ্দেশ’-স্লোগান নিয়ে ‘খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি’র আওতায় ৫০ লাখ ১০ হাজারের অধিক নিম্নআয়ের পরিবারকে ১৫ টাকা কেজি দরে মাসে ৩০ কেজি চাল এবং ২৪ টাকা দরে ৫ কেজি আটা বিতরণ করছে। এ ছাড়া, সরকার টিসিবির মাধ্যমে ১ কোটি পরিবারকে সাশ্রয়ীমূল্যে সয়াবিন তেল, চিনি ও মসুর ডাল সরবরাহ করছে। তিনি বলেন, সরকার দেশের ৬৪ জেলার ৫০০টি উপজেলায় বেকার যুবদের প্রশিক্ষণ ও ঋণ প্রদানের মাধ্যমে আত্মকর্মী তৈরি করছে। সামাজিক ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদানের জন্য ২০২২ সালে প্রধানমন্ত্রী ১২ জন যুবকে ‘শেখ হাসিনা ইয়ুথ ভলান্টিয়ার অ্যাওয়ার্ড’-২০২২ প্রদান করেছেন।

রাষ্ট্রপতি অত্যাধুনিক গণপরিবহন হিসেবে ৬টি মেট্রোরেল সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার লক্ষ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত প্রথম উড়াল মেট্রো ট্রেন চালু হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, সরকারের সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে ৬টি এমআরটির মাধ্যমে স্বয়ংসম্পূর্ণ যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে উঠবে। একইসঙ্গে নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত বাংলাদেশের সক্ষমতা ও গর্বের প্রতীক আইকনিক পদ্মা সেতু উদ্বোধনের জন্য তিনি শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানান। এ সময় তিনি কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বহুলেন টানেলের দক্ষিণ টিউবের নির্মাণকাজ সমাপ্ত হয়েছে উল্লেখ করে দ্রুতই টানেলটি জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া সম্ভব হবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। এ সময় রাষ্ট্রপতি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে ২০৪১ সালে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের লক্ষ্যে মাস্টারপ্ল্যান, আইন, নীতিমালা ও স্ট্র্যাটেজি প্রণয়নসহ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে সরকার সদা তৎপর। বাংলাদেশের সব থানায় ‘নারী, শিশু, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী সার্ভিস ডেস্ক’ স্থাপন করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর ‘ফোর্সেস গোল-২০৩০’- এর আলোকে বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন সেনানিবাসে ২০২২ সালে বিভিন্ন কোরের ৪টি                                ইউনিট নতুনভাবে গঠন এবং একটি পদাতিক ব্রিগেড ও চারটি পদাতিক ব্যাটালিয়নকে মেকানাইজড হিসেবে রূপান্তর করা হয়েছে। নৌঘাঁটি ‘বানৌজা শের-ই-বাংলা’ ও সাবমেরিন ঘাঁটি ‘বানৌজা শেখ হাসিনা’ নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর নয়টি গর-১৭ হেলিকপ্টার এবং একটি ঈ-১৩০ পরিবহন বিমান কঙ্গোতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে উড্ডয়ন পরিচালনা করছে। তিনি বলেন, সবার জন্য বিদ্যুৎ সুবিধা নিশ্চিত করার মাধ্যমে ‘শেখ হাসিনার উদ্যোগ-ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ’ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি ‘বাংলাদেশের একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না’। এ লক্ষ্যে  আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ৭ লাখ ৫৮ হাজার ৫২৫টি পরিবারের প্রায় ৩৫ লক্ষ গৃহহীন মানুষকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। পাশাপাশি অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধা/ বীরাঙ্গনা/ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা/প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধাদের স্ত্রী ও সন্তানদের মুজিববর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসাবে ৩০ হাজার বাসস্থান ‘বীর নিবাস’ দেওয়া হচ্ছে। 

রাষ্ট্রপতি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে স্বাক্ষরিত ‘পার্বত্য শান্তিচুক্তির’ ৭২টি ধারার মধ্যে ৬৫টি ধারা ইতোমধ্যে সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হওয়ায় অনগ্রসর পার্বত্য অঞ্চল জাতীয় উন্নয়নে সংযুক্ত হয়েছে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার মধ্যে সৌহার্দ্য বিরাজ করছে এবং দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অটুট রয়েছে।

চলতি সংসদের অধিবেশন চলবে ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। সংসদের কার্য উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়।

সর্বশেষ খবর