শুক্রবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা
রমনা বটমূলে বোমা হামলা

বিচার শেষ হয়নি ২২ বছরেও

♦ ডেথ রেফারেন্স আট বছর ধরে ঝুলছে হাই কোর্টে ♦ বিস্ফোরক মামলা এখনো নিম্ন আদালতে

আরাফাত মুন্না

২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল রমনা পার্কের বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ভয়াবহ বোমা হামলা চালিয়েছিল জঙ্গিরা। এ হামলায় ঘটনাস্থলেই মারা যান নয়জন। হাসপাতালে আরও একজন। নির্মম এ ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে করা দুটি মামলার বিচার শেষ হয়নি দীর্ঘ ২২ বছরেও। হত্যা মামলাটি বিচারিক আদালতের রায়ের পর ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তির (মৃত্যুদন্ড অনুমোদন) অপেক্ষায় আট বছর ধরে ঝুলছে হাই কোর্টে। আর বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলাটি এখনো নিম্ন আদালতেই বিচারাধীন। ২২ বছরেও মামলা দুটির বিচার শেষ না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী অনেকে। সুপ্রিম কোর্ট সূত্র জানান, ২০১৪ সালে হত্যা মামলাটি বিচারিক আদালতের রায়ের পর ডেথ রেফারেন্স হিসেবে হাই কোর্টে আসে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ মামলার পেপারবুকও (রায়সহ যাবতীয় নথি-সংবলিত বই) তৈরি করা করা হয়। কয়েক দফা আদালতও পরিবর্তন হয়েছে। এর পর থেকে এ মামলার কার্যক্রম আর এগোয়নি। এ মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ শুনানির জন্য প্রস্তুত রয়েছে। পেপারবুকও প্রস্তুত। এখন প্রধান বিচারপতি বেঞ্চ নির্ধারণ করে দিলেই গুরুত্বপূর্ণ এই মামলার ডেথ রেফারেন্স শুনানি শুরু হবে। তিনি বলেন, ‘পেপারবুক প্রস্তুত হওয়ার পর করোনার কারণে দুই বছর শুনানি করা সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে কয়েক দফা বেঞ্চ পরিবর্তনও হয়েছে। ঈদের ছুটির পর আমরা মামলাটি শুনানির জন্য বেঞ্চ নির্ধারণে প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন করব।’ রায়ে সর্বোচ্চ সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের দন্ড বহাল থাকবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি। জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এই মামলাটি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পেপারবুক প্রস্তুত করা হয়েছিল। শিগগিরই ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য প্রধান বিচারপতি বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেবেন। ঢাকার আদালত সূত্রে জানা গেছে, বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলাটির বিচার চলছে ঢাকার সপ্তম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে। কয়েক দফা আদালত বদলের পর এখন এই কোর্টে বিচারাধীন রয়েছে মামলাটি। এ মামলায় ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারা অনুযায়ী আসামি পরীক্ষা করার জন্য দিন ধার্য রয়েছে। তবে নিরাপত্তাজনিত কারণে আসামিদের আদালতে হাজির করা হচ্ছে না। ফলে এ মামলার কার্যক্রম একরকম বন্ধই রয়েছে। সূত্র জানায়, ঢাকার আদালত থেকে দুই জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনার পর থেকে কোনো জঙ্গিকে আদালতে হাজির করা হচ্ছে না।

জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর মো. মাহাবুবুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এ মামলাটি ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় আসামি পরীক্ষার জন্য ধার্য রয়েছে। তবে নিরাপত্তাজনিত কারণে আসামিদের আদালতে হাজির করা যাচ্ছে না। ভার্চুয়াল মাধ্যমে আসামি পরীক্ষার চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও জানান রাষ্ট্রপক্ষের এই আইনজীবী। দীর্ঘদিনেও বিচার শেষ না হওয়ায় ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোতাহার হোসেন সাজু আক্ষেপ করে বলেন, ‘চোখের সামনে মানুষ মারা গেল, রক্তে ভিজে গেল আমার গায়ের পোশাক, সেই ঘটনার বিচার আজও দেখতে পারলাম না, এটাই আফসোস!’

মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান ‘ইসলামবিরোধী’ বিবেচনা করে ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল রমনা বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালানো হয়। হামলায় ঘটনাস্থলেই নয়জনের মৃত্যু হয়। পরে হাসপাতালে মারা যান একজন। এ ঘটনায় নীলক্ষেত পুলিশফাঁড়ির সার্জেন্ট অমল চন্দ্র ওই দিনই রমনা থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা করেন। ঘটনার প্রায় আট বছর পর ১৪ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। আলোচিত এ মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা বারবার পরিবর্তন, সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল, বারবার তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও তদন্ত কর্মকর্তাদের আদালতে সাক্ষ্য দিতে না আসার কারণে বিচার শুরু হতে দেরি হয়। পর্যায়ক্রমে থানা, ডিবি ও সিআইডি পুলিশে মামলার তদন্ত যায়। মামলার অষ্টম তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক আবু হেনা মো. ইউসুফ ২০০৮ সালের ৩০ নভেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। দুটি মামলারই অভিযোগপত্র একসঙ্গে দাখিল করা হয়। পরে বিচারের জন্য মামলা দুটি ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে যায়। ওই আদালতে একই বছর ১৬ এপ্রিল পৃথক মামলা দুটিতে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেলের সিদ্ধান্তে হত্যা মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৩ ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এ পাঠানো হয়। বিচার শেষে ২০১৪ সালের ২৩ জুন ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে মুফতি আবদুল হান্নানসহ আটজনকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। এ ছাড়া যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয় ছয় আসামিকে। মৃত্যুদন্ড ও যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্ত প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদন্ডও দিয়েছেন আদালত। এ মামলায় ১৪ আসামির চারজন শুরু থেকেই পলাতক। এরপর ডেথ রেফারেন্স এবং আসামিদের জেল আপিল ও ফৌজদারি আপিলের শুনানির জন্য মামলাটি হাই কোর্টে আসে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর