বুধবার, ২৬ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা
দিনভর বৈঠকে বিশেষ প্রতিনিধি

নির্বাচনের আগে পরের পরিস্থিতিতে নজর ইইউর

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের পূর্বাপর পরিস্থিতি নজরে রাখবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। তা ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষও দেখতে চায় জোটটি। গতকাল দুপুরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে এ কথা জানান ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি ইমন গিলমোর। পরে তিনি মানবাধিকার কমিশনে গিয়ে কমিশন চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ ও পরে সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গেও বৈঠক করেন। সেখানে আলোচনায় মানবাধিকার পরিস্থিতি ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ বিভিন্ন প্রসঙ্গ উঠে আসে। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক শেষে ইইউর মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি বলেন, বাংলাদেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে মানবাধিকার। আমরা সম্পর্কের ক্ষেত্রে মানবাধিকারকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকি। বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এ নির্বাচনের আগে ও পরে মানবাধিকারসহ সব ধরনের পরিস্থিতি নজরে রাখবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এ জোট বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ দেখতে চায়। অপর এক প্রশ্নের উত্তরে ইমন গিলমোর বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাক নির্বাচন পর্যবেক্ষক প্রতিনিধি দল সফর শেষে ব্রাসেলসে রিপোর্ট পেশ করবে। সেটির ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সঙ্গে বৈঠকে কী নিয়ে আলোচনা হয়েছে জানতে চাইলে ইইউর এ প্রতিনিধি বলেন, মানবাধিকার পরিস্থিতিসহ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। পরে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিশেষ প্রতিনিধির সঙ্গে আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে নির্বাচন কীভাবে হবে, আর কোনো দল অংশ নেবে কিনা সে বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। কেননা, কোন দল নির্বাচনে অংশ নেবে, তা তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত। তবে আমরা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে চাই। তিনি বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত সুবিধা জিএসপি প্লাস ২০২৯ সাল পর্যন্ত রয়েছে। এরপর ২০৩২ সাল বা পরবর্তী সময়ের জন্য এই সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে আমরা কাজ শুরু করেছি। এ জন্য আমাদের হাতে যথেষ্ট সময়ও আছে।

সচিবালয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে

ইউরোপীয় ইউনিয়নের মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি ইমন গিলমোর বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে আমাদের কথা হয়েছে। এই আইনের প্রয়োগ নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন উদ্বিগ্ন। বিপুলসংখ্যক সাংবাদিক ও সামাজিকমাধ্যম ব্যবহারকারীর বিরুদ্ধে এ আইনে মামলা হয়েছে। আইনমন্ত্রী আমাকে নিশ্চিত করেছেন, এ আইনটি সংশোধনে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। আমরা আইনটি প্রকাশের অপেক্ষায় আছি। প্রকাশ হওয়ার পর আমরা আইনটি বিস্তারিতভাবে পরখ করে দেখব। তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সংশোধনকে আমরা সবার আগে স্বাগত জানাতে চাই। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বাংলাদেশের সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে মানবাধিকার। অর্থনৈতিক প্রসঙ্গও পরিবর্তন হচ্ছে। কারণ পণ্য উৎপাদনে কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে কি না, তা জানতে ভোক্তা ও বিনিয়োগকারীরা আগ্রহী। শ্রম আইন প্রসঙ্গে ইমন গিলমোর বলেন, আমরা শ্রমিক সংগঠন নিয়ে কথা বলেছি। মন্ত্রী আমাকে বলেছেন যে, শ্রমিক সংগঠন গড়ার ক্ষেত্রে বাধাগুলো কমিয়ে আনা হয়েছে। পরবর্তী নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা হয়েছে কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই প্রতিনিধি বলেন, আমরা আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাক-নির্বাচনী অনুসন্ধানী দল দুই সপ্তাহের বেশি এখানে ছিল। তারা প্রতিবেদন তৈরি করছে। এখন হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ জোসেপ বোরেল সিদ্ধান্ত নেবেন, বাংলাদেশে পর্যবেক্ষক পাঠাবেন কি না। এ নিয়ে কোনো আগাম মন্তব্য করতে চাই না। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, আগামী সেপ্টেম্বরেই ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের সংশোধনী জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হবে এবং তা পাস করা হবে। আশাকরি ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের সংশোধনে সাংবাদিকদের সবাই খুশি হবেন। আইনমন্ত্রী বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বাংলাদেশের মধ্যকার যে সম্পর্ক আছে, তা তার (ইমন গিলমোর) সফরে আরও জোরদার হলো। নতুন আঙ্গিকে আমাদের এই সম্পর্ক কাজ করবে। আমাদের ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা তথ্য সুরক্ষা আইন নিয়ে কথা বলেছি। ডেটা প্রটেকশন অ্যাক্ট নিয়ে অংশীজনদের সঙ্গে একবার আলোচনা করার পর একটি ড্রাফট করা হয়েছে। এ ড্রাফট নিয়ে আবারও অংশীজনের সঙ্গে বসা হবে বলে জানিয়েছেন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী। তার (ইমন গিলমোর) সঙ্গে আমার শ্রম আইন নিয়ে আলাপ হয়েছে। এ বিষয়ে আমি বলেছি, শ্রমিক ও শ্রম আইন নিয়ে বাংলাদেশে অনেক কাজ হয়েছে এবং বর্তমানেও করছি, আগামীতেও করা হবে। যেটুকু সমস্যা আছে, তা আইএলওর আগামী গভর্নিং বডির মিটিংয়ে সমাধান হবে বলে আশ্বাস দিয়েছি। এ বিষয়ে আমি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহযোগিতা চেয়েছি। নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা হয়েছে কি না জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, নির্বাচন কমিশনার ও প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের ব্যাপারে আমরা যে আইনটি করেছি সেটির বিষয়ে আমি তাকে বলেছি। গত ৫০ বছরে উপমহাদেশে এ ধরনের আইন করা হয়নি বলেও জানিয়েছি। একই সঙ্গে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে এ আইনটি প্রয়োজন বলে জানিয়েছি।

মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ : ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি ইমন গিলমোর গতকাল সকালের দিকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কার্যালয়ে চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে বৈঠক করেন। পরে গিলমোর বলেন, বাংলাদেশের মানবাধিকারের বর্তমান অবস্থা নিয়ে কথা হয়েছে। আমার মনে হয়, বাংলাদেশের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্পর্ক অনেক ভালো। অর্থনৈতিকভাবে আমাদের সম্পর্ক অনেক শক্তিশালী। বাংলাদেশের মানবাধিকার ইস্যুতে আমরা বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছি। তারা সরকারি পর্যায়ে কথা বলবে। নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে একটি প্রতিনিধি দলের ইতোমধ্যেই ঘুরে গেছে; তারা শিগগিরই রিপোর্ট দেবে। তবে নির্বাচন সামনে রেখে মানবাধিকার পরিস্থিতি ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ আছে। এক্ষেত্রে মানবাধিকার কমিশনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কমিশন চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড ও গুম এসব বিষয় নিয়েই মানবাধিকার কমিশন কাজ করছে। এসব ঘটনা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। বিদেশিদের কাছে ভাবমূর্তি নষ্ট করে। নির্বাহী বিভাগকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক : সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিজ দফতরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি ইমন গিলমোরের সঙ্গে বৈঠক করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আলোচনার মধ্যে রোহিঙ্গা সমস্যা বেশি এসেছে। তাদের নিয়ে কী করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমাদের আসন্ন নির্বাচন সম্পর্কে তারা জানতে চেয়েছেন। আমরা তার জবাব দিয়েছি। তাদের জানিয়েছি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ যেমন সবকিছুতে উন্নত হয়েছে, অভূতপূর্ব সফলতা এনেছে, তার সঙ্গে মানবাধিকার নিয়ে অনেক কাজ করা হচ্ছে। এখানে মানবাধিকার কমিশন রয়েছে, তারা স্বাধীন। তারাও কাজ করছে। আসাদুজ্জামান খান বলেন, নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন ইউরোপীয় প্রতিনিধিরা। তাদের জানিয়ে দিয়েছি, সংবিধান অনুসারে নির্বাচন হবে। তবে সরকার নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করবে। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হচ্ছে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেওয়া।

সর্বশেষ খবর