সোমবার, ১৪ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

রাষ্ট্রদূতের বাসায় তিন দল

দুই কংগ্রেসম্যানের চা-চক্রে আওয়ামী লীগ বিএনপি জাপা, গেলেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও

বিশেষ প্রতিনিধি

রাষ্ট্রদূতের বাসায় তিন দল

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেনের সঙ্গে গতকাল মার্কিন দুই কংগ্রেসম্যানের বৈঠক -বাংলাদেশ প্রতিদিন

দুই মার্কিন কংগ্রেসম্যানের সফর উপলক্ষে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসায় একসঙ্গে চা-চক্রে বসেছিল দেশের প্রধান তিন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতারা। গতকাল গুলশানে রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের বাসায় আয়োজিত এই চা-চক্রে তিন দলেরই মধ্যম সারির নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এসময় দেশের চলমান রাজনীতি ও আসন্ন নির্বাচন নিয়ে দলগুলোর চাওয়া-পাওয়া বিষয়ে জানতে চান কংগ্রেসম্যানরা। উপস্থিত  নেতারা নিজ নিজ দলের পক্ষে বক্তব্য উপস্থাপন করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির হয়ে হাওয়াই থেকে নির্বাচিত কংগ্রেস সদস্য এড কেইস ও বিরোধী রিপাবলিকান পার্টির হয়ে জর্জিয়ার কংগ্রেসম্যান রিচার্ড ম্যাকরমিকের বাংলাদেশ সফরের প্রথম দিনই রাষ্ট্রদূত হাসের বাসায় গতকাল বিকাল ৪টায় শুরু হওয়া এই চা-চক্র প্রায় দেড় ঘণ্টা স্থায়ী হয়। এতে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলে ছিলেন দলটির অর্থ ও পরিকল্পনা সম্পাদক, সংসদ সদস্য ওয়াসিকা আয়শা খান, নাহিম রাজ্জাক ও সংরক্ষিত আসনের এমপি তামান্না নুসরাত বুবলী। বিএনপির পক্ষে ছিলেন দলটির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী। জাতীয় পার্টির প্রতিনিধি দলে ছিলেন তিন সংসদ সদস্য শেরিফা কাদের, রানা মোহাম্মদ সোহেল ও নাজমা আকতার।

বৈঠক সূত্র জানায়, চা-চক্রে কংগ্রেসম্যানরা বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে জানার আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব কী কারণে সে বিষয়টির ব্যাখ্যা করা হয়। কংগ্রেসম্যান ও দূতাবাসের পক্ষ থেকে বলা হয়, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বাংলাদেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা সীমিত হয়ে যাচ্ছে, সেই ক্ষেত্রে বাংলাদেশে যেন গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় থাকে, সেটাই চায় যুক্তরাষ্ট্র।

বৈঠকে উপস্থিত একটি সূত্র জানায়, কংগ্রেসম্যান এড কেইস আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের কাছে জানতে চান, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু হবে কি না? জবাবে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের সদস্য ওয়াসিকা আয়শা খান ও নাহিম রাজ্জাক বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার সব সময় অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচন করে থাকে। দেশের সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে আওয়ামী লীগ তথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবরই বলে আসছেন। বর্তমান নির্বাচন কমিশন অনেক শক্তিশালী। এই শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের অধীনেই অবাধ ও সুষ্ঠু ভোট হবে। গণতন্ত্রমনা সব রাজনৈতিক দল এতে অংশগ্রহণ করবে। এরপর কংগ্রেসম্যান এড কেইস আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলকে আরও বলেন, শুধু তোমাদের দেশে নয়, পৃথিবীর কাছে অবাধ, সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হবে। জবাবে আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিরা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পর্যবেক্ষক হিসেবে তাদের আসার জন্য আমন্ত্রণ জানান। একই সঙ্গে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতির কথা উল্লেখ করেন। আইনের মাধ্যমে সরকার নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করেছে বলে মার্কিন প্রতিনিধি দলকে জানায় আওয়ামী লীগ। প্রতিনিধি দলের নেতারা বলেন, একটি দল বিশেষ করে বিএনপি নির্বাচনে ভরাডুবির ভয়ে নির্বাচন থেকে সরে আসার ষড়যন্ত্র করছে। কারণ তারা জানে বিএনপিকে দেশের জনগণ ভোট দেবে না। সে কারণে ষড়যন্ত্র করছে। কংগ্রেসম্যানরা বলেন, আওয়ামী লীগ বিজয়ী হবে- কেন জনগণ ভোট দেবে? জবাবে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের নেতারা বলেন, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা মাদার অব হিউম্যানিটি। মিয়ানমার থেকে প্রত্যাগত ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে জায়গা দেওয়া, খাবার দেওয়াসহ নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। গত সাড়ে ১৪ বছরে দেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন করেছেন। অন্যদিকে বিএনপি ভোট বর্জনের নামে মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা, রাস্তাঘাট কেটে ফেলা, ক্ষমতায় থাকতে জঙ্গিবাদের সৃষ্টি, অর্থ পাচার করার কারণে জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। এ সময় বিএনপির প্রতিনিধি দল থেকে এক নেতা আওয়ামী লীগের কথার বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, দেশে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চলছে। বিগত নির্বাচনগুলো গ্রহণযোগ্য হয়নি। জবাবে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের নেতারা বলেন, আমরা সব দলকে নির্বাচনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি দেশে আগুনসন্ত্রাস করে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র করেছিল। ২০১৮ সালে তারা নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু মনোনয়ন বাণিজ্যের কারণে এক আসনে একাধিক প্রার্থী করায় মানুষ ভোট দেয়নি।

চা-চক্রে বিএনপির দলীয় অবস্থান তুলে ধরার কথা জানিয়ে দলের প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মার্কিন কংগ্রেসম্যানদের বলেছি, বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না। একই সঙ্গে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি যাবে না। কারণ দেশে এক ব্যক্তির শাসন চলছে। এ্যানী বৈঠকে বলেন, মানবাধিকার চরমভাবে লংঘিত হচ্ছে। দেশের সব গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে দিয়ে জোরপূর্বক সম্পূর্ণ অবৈধভাবে ক্ষমতায় আছে এ সরকার। গণতন্ত্র ধ্বংস করে দিয়েছে। বিগত দুটি নির্বাচনে জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি। সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগের রাতেই ভোট দিয়ে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে নিয়ে ফলাফল ঘোষণা করেছিল ক্ষমতাসীন দল। এবারও তারা (আওয়ামী লীগ সরকার) এ ধরনেরই আরেকটি যেনতেন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকতে চায়। কাজেই এ সরকারের অধীনে কখনো সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় এবং এবার আর এ ধরনের প্রহসনের কোনো নির্বাচন দেশের জনগণও হতে দেবে না এটাই তিনি (এ্যানী) কংগ্রেসম্যানদের বৈঠকে তুলে ধরেছেন বলে জানান। কেন আজকে বিএনপিকে এক দফা দাবির আন্দোলনে নামতে হয়েছে এর প্রেক্ষাপট তুলে ধরে চা-চক্রে এ্যানী আরও বলেছেন, আওয়ামী লীগের মতো কর্তৃত্ববাদী সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়। এ জন্যই তারা নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে এক দফা আন্দোলন করছেন। এ সময় তিনি বিশ্বের সর্ববৃহৎ শক্তিশালী গণতন্ত্রের দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখার জন্য আহ্বান জানান। বৈঠকে অংশ নেওয়া জাপার এক প্রতিনিধি জানান, আমরা সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন চাই। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার কথা প্রতিনিধি দলের কাছে পুনর্ব্যক্ত করেছি। এ ছাড়াও নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে যে মতভেদ রয়েছে, তা কাটাতে সংলাপের বিকল্প নেই বলে প্রতিনিধিকে জানিয়েছি। বলেছি, আমরা একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন চাই। দেশের মানুষও একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চায়। নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করতে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা অনেক বেশি। রাজনৈতিক সমস্যা আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান করতে হবে। আলোচনার মূল উদ্যোগ সরকারের পক্ষ থেকেই আসতে হবে। যেন যে কেউ প্রার্থী হতে পারে এবং নির্ভয়ে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে যোগ্য প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারেন আমরা সে কথাও বলেছি। বিকালে রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পর সন্ধ্যায় সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন দুই কংগ্রেসম্যান। বৈঠকে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের আদিলুর রহমান খান, নারীপক্ষের শিরীন হক, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন, উপস্থাপক জিল্লুর রহমান, আর্টিকেল নাইনটিন’র বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সাল প্রমুখ অংশ নেন।

সর্বশেষ খবর