শিরোনাম
মঙ্গলবার, ১৫ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

বিচার হয়নি আরও ২৩ হত্যার

♦ কামানের গোলা হামলা মামলায় ৫৮ সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ১৮ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ ♦ শেখ মণি হত্যা মামলার হদিস জানে না কেউ ♦ সাক্ষীর অভাবে সেরনিয়াবাত হত্যার বিচার বন্ধ

আরাফাত মুন্না

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার দিন সকালে খুনিদের ছোড়া কামানের গোলা গিয়ে পড়েছিল মোহাম্মদপুরের শেরশাহ সুরী রোডের বস্তিতে। গোলার আঘাতে নিহত হন ১৩ জন। প্রায় এক যুগ আগে অভিযোগ গঠন করা হলেও শেষ হয়নি এ মামলার বিচারকাজ। সেই কালরাতে বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণির বাড়িতেও হামলা চালায় বিপথগামী সেনারা। হত্যা করা হয় অন্তত আরও ১০ জনকে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হলেও ৪৮ বছরেও বিচার মেলেনি এ ২৩ হত্যাকাণ্ডের।

আদালত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই তিন মামলার মধ্যে মোহাম্মদপুর বস্তিতে কামানের গোলা-সংক্রান্ত মামলাটির সাক্ষী হাজির না হওয়ায় খুব শিগগিরই সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ করা হবে। আর সেরনিয়াবাত হত্যা মামলা দীর্ঘদিন হাই কোর্টের স্থগিতাদেশের কারণে বিচার বন্ধ ছিল। বর্তমানে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হলেও বিচার এগোচ্ছে না সাক্ষী না আসার কারণে। অন্যদিকে শেখ মণি হত্যার ঘটনায় ১৮ জনকে আসামি করে মামলা করা হলেও এ মামলার সর্বশেষ অবস্থা বলতে পারছে না কেউ।

এ তিন মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এসব মামলার অধিকাংশ আসামিই বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় সাজা পেয়েছেন। অনেকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। এখন যারা বাকি আছেন তাদেরও বিচার হবে। মামলাগুলো নিষ্পত্তিতে কেন এত বিলম্ব হচ্ছে, এ বিষয়ে আমি রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলব। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর করতে বদ্ধপরিকর। কেউ যাতে বলতে না পারে বিচার পাইনি। আদালতে মামলা বিচারাধীন, অর্থাৎ এসব হত্যাকাণ্ডের বিচারও একদিন হবে।

মোহাম্মদপুরে কামানের গোলা হামলা মামলা : ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট ভোর সাড়ে ৫টার দিকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণের সময় বিপথগামী সেনারা কামানের গোলা ছুড়লে তা গিয়ে পড়ে মোহাম্মদপুরের শেরশাহ সুরী রোডের ৮, ৯, ১৯৬ ও ১৯৭ নম্বর বাড়ির (টিনশেড বস্তি) ওপর। লে. কর্নেল মুহিউদ্দিন আহমেদের (আর্টিলারি) ছোড়া কামানের গোলার বিকট শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। মুহূর্তেই লন্ডভন্ড হয়ে যায় বস্তিটি। ওই ঘটনায় নারী ও শিশুসহ ১৩ জন মারা যান। আহত হন ৪০ জন। ওই ঘটনায় ৮ নম্বর বাড়ির মালিক মোহাম্মদ আলী বাদী হয়ে ১৯৯৬ সালের ২৯ নভেম্বর মোহাম্মদপুর থানায় এ মামলাটি করেন। ২০০১ সালের এপ্রিলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। এরপর ২০০৬ সালের ১ নভেম্বর এ মামলায় ১৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। ১৭ আসামির মধ্যে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচজনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এ ছাড়া মামলার বাকি ১২ আসামি পলাতক। আদালতের নথিপত্রে বলা হয়, মামলার ৫৮ সাক্ষীর মধ্যে এখন পর্যন্ত বাদীসহ ১৮ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা সম্ভব হয়েছে। সমন দিয়ে এমনকি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেও সাক্ষীদের আদালতে হাজির করা যাচ্ছে না। এ মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আবদুল্লাহ আবু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মামলাটিতে সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ করার জন্য রাষ্ট্রপক্ষ সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। সমন দিয়ে এমনকি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেও সাক্ষী আনা যাচ্ছে না। তাই খুব শিগগিরই সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ করার চিন্তা করছি আমরা। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত যাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে, আসামিদের অপরাধ প্রমাণে সেটাই যথেষ্ট।

সেরনিয়াবাত হত্যা মামলা : বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি তৎকালীন পানি ও বন্যানিয়ন্ত্রণ মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতেও পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ভোরে হামলা চালায় বিপথগামী সেনা সদস্যরা। বাসার সব সদস্যকে ড্রয়িংরুমে জড়ো করে তারা। একপর্যায়ে ব্রাশফায়ার করে আবদুর রব সেরনিয়াবাতসহ আটজনকে হত্যা করে ঘাতকরা। নথি সূত্রে জানা গেছে, এ ঘটনায় ১৯৯৬ সালের ২১ অক্টোবর আবদুর রব সেরনিয়াবাতের ছেলে আবুল হাসানাতের স্ত্রী সাহান আরা বেগম বাদী হয়ে ঢাকার রমনা থানায় হত্যা মামলা করেন। ১৯৯৭ সালের ৩০ জুলাই ১৫ সাবেক সেনা কর্মকর্তাসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। এ মামলার এক আসামি ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারিতে মামলাটির স্থগিতাদেশ চেয়ে উচ্চ আদালতে আবেদন করেন। উচ্চ আদালত তিন মাসের জন্য মামলার কার্যক্রম স্থগিত করেন। ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর এ স্থগিতাদেশ দফায় দফায় বাড়তে থাকে। এরপর ২০০৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সরকারের প্রতি দেওয়া রুলের শুনানি না হওয়া পর্যন্ত মামলার কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। এভাবে ২৩ বছর ধরে এ মামলার বিচার বন্ধ থাকার পর চলতি বছর হাই কোর্টের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করার পর মামলাটি আবার সচল হয়। তবে এখন সাক্ষী না আসায় এ মামলার বিচারিক কার্যক্রমে স্থবিরতা লেগেই আছে। মামলাটি বর্তমানে ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন। এ মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আবদুস সাত্তার দুলাল বলেন, মামলাটি দীর্ঘদিন হাই কোর্টের স্থগিতাদেশের কারণে বিচার বন্ধ ছিল। সম্প্রতি এ মামলায় হাই কোর্টের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হয়েছে। তিনি বলেন, এখন মামলাটিতে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হবে, তবে অনেক পুরনো মামলা হওয়ায় সাক্ষী খুঁজে পাওয়া কষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শেখ মণি হত্যা মামলা : ২৫ থেকে ৩০ জনের একটি ঘাতক দল পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট শেখ ফজলুল হক মণির ধানমন্ডির ১৩/১-এর বাসায় আক্রমণ চালায়। তারা খুন করে শেখ মণি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণিকে। ১৯৯৬ সালের ২০ নভেম্বর ধানমন্ডি থানায় ১৮ জনকে আসামি করে মামলা হলেও নথি না পাওয়ায় মামলার কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে বিভিন্ন সূত্র। এ মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আবদুল্লাহ আবু বলেন, নথি হারিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। যেহেতু শুনানি হচ্ছে না, তাই নথি খোঁজা হয়নি। আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর