মঙ্গলবার, ২২ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

ক্রিপটোকারেন্সিতে সর্বনাশ

সাখাওয়াত কাওসার

ক্রিপটোকারেন্সিতে সর্বনাশ

দেশের অর্থনীতির সর্বনাশ হচ্ছে ক্রিপটোকারেন্সির অবৈধ লেনদেনে। দেশে ক্রিপটোকারেন্সির কোনো বৈধতা না থাকলেও ১০ রকমের ক্রিপটোকারেন্সির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। ‘ডার্ক ওয়েবে’ থাকা এই ‘ক্রিপটো ওয়ালেট’কেই অর্থ পাচারের সবচেয়ে নিরাপদ মাধ্যম মনে করেন কালো টাকার মালিকরা। ব্যবসার নানা কৌশলে অর্থ পাচার করে তা নিজের বাইন্যান্স ওয়ালেটে জমা রাখছেন। অন্যদিকে খোদ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এখন ক্রিপটোকারেন্সিকে দেখছেন বিশ্বব্যাপী কর-রাজস্ব ব্যবস্থার জন্য এক বড় ভবিষ্যৎ হুমকি হিসেবে। সম্প্রতি আইএমএফের একটি পলিসি পেপারেও বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশে ক্রিপটোকারেন্সির লেনদেন অবৈধ।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডির প্রধান মোহাম্মদ আলী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ক্রিপটোকারেন্সিতে মুদ্রা পাচার হচ্ছে কি না বিষয়টি নিয়ে সিআইডির সাইবার ক্রাইম ইউনিট এবং ফিন্যানশিয়াল ক্রাইম ইউনিট কাজ করছে। তবে আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ ই-কমার্সের মতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতারিত হওয়ার পরও সচেতন হচ্ছে না। এটা সত্যিই দুঃখজনক।’ তিনি আরও বলেন, ‘এমটিএফই নামের প্রতিষ্ঠানটি দুবাই থেকে পরিচালিত হয়ে আসছিল। এটা নিয়েও আমাদের কাজ চলছে।’ জানা গেছে, বিএনবি, বিটিসি, ইটিএইচ, আলপাইন, এক্সআরপি, আইএনজে, এলটিসি, টিআরএক্স, এসএফপি, এসএইচআইবির মতো ১০টি ক্রিপটোকারেন্সির দিকে বেশি ঝুঁকেছে দেশের কালো টাকার মালিকরা। তবে অনেকে লাইটকয়েন, পাইপেল, প্লাটিনকয়েন, ভিকে-টেলিগ্রাম, কয়েন মার্কেট কেপকে পছন্দের তালিকায় রাখছে। তারা হুন্ডি, ভুয়া এলসির মাধ্যমে অবৈধ পন্থায় অর্থ বিদেশে নিয়ে ই-ওয়ালেটে জমা রাখছে। আবার ডার্ক ওয়েব নজরদারির মতো দেশে সক্ষমতা না থাকায় ক্রিপটোকারেন্সিগুলোর ওপর নজরদারি করতে পারছে না সাইবার মনিটরিং প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে বাইন্যান্স থেকে দেশের মোবাইল আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় হামেশাই অর্থ লেনদেন হচ্ছে। আর বর্তমানে দেশে লক্ষাধিক তরুণ-তরুণী তৃতীয় পক্ষ হয়ে মোবাইল লেনদেনের মাধ্যমে বাইন্যান্সিং করছে। বিনিময়ে পাচ্ছে ৫ থেকে ১০ শতাংশ কমিশন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাক অ্যান্ডে ‘ওয়ান টু ওয়ান’, ‘এপিআই’ না থাকলে কখনো এই মাধ্যমে টাকা লেনদেন করা যায় না। আর বাইন্যান্সের সঙ্গে দেশের অন্তত তিনটি ‘এমএফএস’ (মোবাইল ফিন্যানশিয়াল সার্ভিস)-এর সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে।

আইএমএফের পলিসি পেপারসের তথ্যের বরাত দিয়ে অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুত সম্প্রসারণশীল বাজার এবং লেনদেনকারীর পরিচয় গোপন রাখার সুযোগের কারণে ক্রিপটোকারেন্সিতে লেনদেন কোনো ধরনের করব্যবস্থার আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না। এখনো এর ব্যবহার অনেক সীমিত। তবে যত ব্যাপকতা পাবে, এটিকে যথাযথভাবে করব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসা ততই কঠিন হয়ে পড়বে। সে ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের কর-রাজস্ব ব্যবস্থার কার্যকারিতা ধরে রাখার পথে বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে ক্রিপটোকারেন্সি।

তারা আরও বলছেন, এনক্রিপশন অ্যালগরিদমে তৈরি ডিজিটাল মুদ্রাটিতে কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ বা নজরদারির উপায় এখনো বের করতে পারেননি বৈশ্বিক আর্থিক খাতের হর্তাকর্তারা। এর পরও অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বড় হচ্ছে ক্রিপটোকারেন্সির বাজার। এদিকে এমটিএফইয়ের প্রতারণা নিয়ে কাজ করছেন এমন কয়েকজন কর্মকর্তা বলছেন, দুবাই, রাশিয়ায় বৈধভাবে এই ব্যবসা থাকার কারণে অনেক বাংলাদেশি এতে জড়িয়ে পড়েছে। দেশের অনেক ছাত্রসহ বিভিন্ন পেশার লোকজন অতি লোভের আশায় এমটিএফইতে বিনিয়োগ করেছিল। তারা কখনো খোঁজ নিয়ে দেখার প্রয়োজনবোধও করেনি।

অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে এভাবে অবৈধ লেনদেন অব্যাহত থাকলে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিদেশে বাড়বে অবৈধভাবে অর্থ পাচার। অতি লোভের আশায় অনেকে শেয়ারবাজার থেকেও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। আবার এমটিএফইয়ের প্রতারণার দায় দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ আর্থিক খাত নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান এড়াতে পারে না। গোয়েন্দারাও এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ ছিলেন।

জানা গেছে, এক দশক আগেও জনপ্রিয় ক্রিপটোকারেন্সি ‘বিটকয়েন’-এর বিনিময় হার ছিল ২০০ ডলার। ২০২১ সালে তা উঠে দাঁড়ায় ৭০ হাজার ডলারের কাছাকাছি। তবে বর্তমানে তা নেমে গিয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৯ হাজার ডলারে। গত বছর দেউলিয়া হয়ে পড়ে বাহামাভিত্তিক ক্রিপটোকারেন্সি এক্সচেঞ্জ ও হেজ ফান্ড এফটিএক্স। সম্প্রতি ক্রিপটোকারেন্সি এক্সচেঞ্জ বাইন্যান্স ও কয়েনবেজের বিরুদ্ধে মামলা করেছে ইউএস সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন। এ দুই ঘটনা ক্রিপটোকারেন্সি ব্যবহারকারীদের মধ্যে উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে জানিয়ে আইএমএফ বলছে, দেশে দেশে নীতিনির্ধারক মহলেও বিষয়টিতে নজরদারি বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে। বিষয়টিকে আইনি কাঠামোয় নিয়ে আসার কথাও বলছেন তারা। প্রযুক্তিবিদ সুমন হোসেন সাবির বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ক্রিপটোকারেন্সি মনিটরিং কিংবা অপারেটিং করার মতো সক্ষমতা আমাদের দেশে এখনো তৈরি হয়নি। এর আগে কেউ যাতে ক্রিপটোকারেন্সিতে অবৈধভাবে ঝুঁকে না পড়ে সেদিকে নজর দেওয়া উচিত ছিল সংশ্লিষ্টদের। কারণ বাংলাদেশ ওপেন ইকোনমির দেশ হলে কোনো সমস্যা ছিল না।’ ২০২০ সালের ১৯ জানুয়ারি ‘অর্থ পাচারে নতুন আতঙ্ক বিটকয়েন’ শিরোনামে বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে নড়েচড়ে বসেছিল সরকার। তবে বিষয়টি নিয়ে কিছুদিন পরই উৎসাহে ভাটা পড়ে তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলোর। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ক্রিপটোকারেন্সিতে লেনদেনে জড়িত বাংলাদেশের শতাধিক নাগরিকের একটি তালিকা তৈরি করেছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। এর বেশির ভাগই ব্যবসায়িক সাইনবোর্ডের রাজনৈতিক দলের নেতা। এ তালিকার কেউ কেউ তাদের কিছু প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে ভুয়া এলসি খোলে এবং হুন্ডির মাধ্যমে নিয়মিত বিদেশে অর্থ পাচার করে যাচ্ছে। আবার অনেকে ওই কালো টাকা রেমিট্যান্স আকারে ফিরিয়ে নিয়ে এসে সরকারের প্রণোদনা হাতিয়ে নিচ্ছে। এ ছাড়া কূটনৈতিক পাসপোর্ট ব্যবহার করে এমন কেউ কেউ এবং বিদেশি এয়ারলাইনসের কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত পাইলট ও ক্রু তাদের ক্ষমতা ও সুযোগসুবিধার অপব্যবহার করে বিদেশে ডলার পাচারে সহায়তা করছে। পরে এসব ডলার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ই-ওয়ালেটে ঢোকানো হচ্ছে। আবার বাইন্যান্সে অ্যাকাউন্ট খুলে কালো টাকা রেখে এমএফএসের মাধ্যমে ফিরিয়ে নিয়ে আসছে। তবে নজরদারির বাইরে রয়ে যাচ্ছে জড়িত এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলো। জানা যায়, ২০১৮ সালের ২৮ নভেম্বর র‌্যাব-২-এর তৎকালীন কোম্পানি কমান্ডার পুলিশ সুপার মহিউদ্দীন ফারুকীর নেতৃত্বে একটি দল ‘বিটকয়েন’ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে আটজনকে গ্রেফতার করে। তাদের মোবাইল ফোনে বিটকয়েনের কার্যক্রম সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য পায় আভিযানিক দল। মামলা নম্বর-১২১। এর আগে মহিউদ্দীন ফারুকীর নেতৃত্বেই আরেকটি দল ওই বছর সেপ্টেম্বরে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থেকে বিটকয়েন ব্যবসায় জড়িত থাকার অপরাধে আরও একজনকে গ্রেফতার করে। পরে ওই দুটি মামলার তদন্ত করে সিআইডি। জানা গেছে, এনক্রিপশন অ্যালগরিদমে তৈরি ডিজিটাল মুদ্রাটিতে কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ বা নজরদারির উপায় এখনো বের করতে পারেনি বিশ্বের অনেক দেশের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রকরা। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অবৈধ অস্ত্র, মাদক, কিলিং, হ্যাকিং, সন্ত্রাসের মতো কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন হচ্ছে ক্রিপটোকারেন্সির মাধ্যমে। ইন্টারনেট ক্রিপটোগ্রাফি ব্যবহার করে স্পষ্ট তথ্যকে প্রায় অবিচ্ছেদ্য কোডে রূপান্তর করা হয় ক্রিপটো প্রক্রিয়ায়। ক্রিপটো ওয়ালেট খুলতে কোনো থার্ড পার্টি ভেরিফিকেশনেরও প্রয়োজন হয় না। সর্বশেষ একজন গ্রাহককে দেওয়া হয় একটি ‘ইউজার নেম’ ও আট ডিজিটের একটি পাসওয়ার্ড। এ সিস্টেমটি পরিচালনা হয় ব্লকচেন পদ্ধতির মাধ্যমে। ডি-সেন্ট্রালাইজড নেটওয়ার্ক থাকায় এর ওপর নজরদারিও অনেক কঠিন।

সর্বশেষ খবর