মঙ্গলবার, ২২ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা
ভারতের দুই পত্রিকার খবর

শেখ হাসিনা হারলে আঞ্চলিক সহিংসতা বাড়তে পারে

দ্য হিন্দু

প্রতিদিন ডেস্ক

বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দু একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। রবিবার প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার হারলে বাংলাদেশ দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার মুখোমুখি হতে পারে। এই সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ায়ও আঞ্চলিক সহিংসতা বাড়তে পারে। সাংবাদিক প্রণয় শর্মার তৈরি এ প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছে, ‘প্রতিবেশীদের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাবের দিক দিয়ে শেখ হাসিনা সরকার সম্ভবত ভারতের সবচেয়ে নির্ভরশীল ও ঘনিষ্ঠ মিত্র। যদিও ভারতকে দক্ষিণ এশিয়ায় বিগ পাওয়ার হিসেবে ধরা হয়, কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তাদের এই অবস্থানে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে চীন। আর বছর গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ায় চীন তাদের অবস্থান শক্ত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।’ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের দৌড়ঝাঁপ নিয়েও বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, ‘মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারা বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়েছে। দেশটি বাংলাদেশে আসন্ন নির্বাচন সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে নির্বাচনে কারচুপির চেষ্টাকারীদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে পুলিশের এলিট ফোর্স র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।’

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাঁর আয়োজিত গণতান্ত্রিক সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানাননি। যেখানে ভারত-পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।’ এ ছাড়া গত মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংকের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাওয়ার পর বাইডেন প্রশাসন যে তাঁকে উপেক্ষা করেছিল তা-ও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বাস করেন, বাইডেন বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে রক্ষা নয়, ধ্বংস করতে কাজ করছেন। একবার সংসদেও তিনি বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের যে কোনো দেশের সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারে, বিশেষ করে যদি এটি মুসলিম দেশ হয়।’ দ্য হিন্দুর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলো উপকৃত হয়েছে। দেশের সবচেয়ে বড় বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) অবাধে সরকারবিরোধী সমাবেশ করছে। এ ছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠন, যেমন ইসলামপন্থি দল জামায়াতে ইসলামীও, যেটির সঙ্গে পাকিস্তানের ভালো সম্পর্ক রয়েছে এবং স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহায়তা করেছে- যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর অবস্থানের কারণে তারাও রাজনৈতিক প্রাণচঞ্চলতা ফিরে পেয়েছে।’ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘ভারতের শঙ্কা, জামায়াত ও তাদের সমমনা দলগুলো নিয়ে বিএনপি বাংলাদেশে শাসন পরিচালনা করবে- এমন সম্ভাবনা ঢাকা ও দিল্লিতে উদ্বেগ ও শঙ্কা তৈরি করেছে।’

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘গত দশকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একটি শক্তিশালী, বিশ্বস্ত এবং নির্ভরতার সম্পর্ক তৈরি করেছেন, যা দুই দেশের জন্যই মঙ্গলজনক। ভারতের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল বিজেপির নেতাদের মুসলিমবিদ্বেষী এবং বাংলাদেশবিরোধী বক্তব্যকে শেখ হাসিনা যে পাত্তা দেননি, এর মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে দুই পক্ষের মধ্যে শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার এ সম্পর্কের মাধ্যমে ভারত এমন একটি উদাহরণ তৈরি করতে সম্মত হয়েছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকলে প্রতিবেশীরা কীভাবে সুফল পেতে পারে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারত সহায়তা করেছে। তা সত্ত্বেও স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব তৈরি ও বাংলাদেশ থেকে ভারতবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনাই এসব বন্ধ করেছেন। তার পরও ঢাকা ও নয়াদিল্লির শঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্র এখন যে অবস্থান নিচ্ছে, তাতে বাংলাদেশ ও ভারতের এ সম্পর্ক হুমকির মুখে পড়তে পারে।’

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে কথা বলে। কিন্তু কোথাও যদি তাদের কৌশলগত সম্পর্ক জড়িত থাকে তাহলে এ নিয়ে মাথা ঘামায় না। কিন্তু বাংলাদেশ নিয়ে কেন তারা এতটা মাথা ঘামাচ্ছে, তার কারণ জানা উচিত। এ ব্যাপারে ওয়াশিংটনভিত্তিক এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কৌশলগতভাবে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র নৌকায় ঝাঁকুনি দিতে পারছে। বাংলাদেশ মার্কিনিদের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার, কিন্তু কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ নয়। যে কারণে বাইডেন প্রশাসন নির্বাচন নিয়ে এখন বাংলাদেশকে চাপ দিতে পারছে।’ আরও বলা হয়, ‘ভূরাজনীতির ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা ভারত মহাসাগরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিবদমান দেশগুলোর পক্ষ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের ওপর অবস্থিত, যেটি ভারত মহাসাগরের অংশ। এই ভারত মহাসাগর পরিবহন ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের মোট বাণিজ্যের ৮০ শতাংশই এখান দিয়ে হয়ে থাকে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বহুপক্ষীয় ব্যবস্থা ইন্দো-প্যাসিফিক নীতি ন্যায়সম্মত ও শক্তিশালী উন্নয়নের ওপর জোর দেয়। সঙ্গে এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখার নীতিও রয়েছে বাংলাদেশের। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ভারত ও চীনের লড়াইয়ের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। এ দুই দেশই বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করায় বিষয়টি আরও কঠিন হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র-চীনের দীর্ঘ বৈরিতার প্রভাবও পড়েছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান সম্পর্কের কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গভীর সম্পর্ক তৈরি করতে সমর্থ হয়েছে চীন। তবে উদ্ভূত পরিস্থিতিকে ভারতের জন্য উভয় সংকট হিসেবে দেখা হচ্ছে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ভালো সম্পর্কের মাধ্যমে একটি আশার সঞ্চার হয়েছে, সেটি হলো তারা শেখ হাসিনার পক্ষে বাইডেন প্রশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। আর চীন এখন ঢাকার পক্ষে থাকায় একটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে সম্পর্ক রয়েছে তা কাজে লাগিয়ে শেখ হাসিনাকে সহায়তায় কাজ করছে ভারত। কিন্তু যদি এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে তারা মানাতে না পারে, তাহলে তা ভারতের জন্যই ক্ষতিকর হবে।’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘যদি শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়, তাহলে নয়াদিল্লিকে একটি বিরোধী শক্তি মোকাবিলা করতে হবে। ভারত এ বিষয়টি নিয়ে ভীত। কিন্তু চীনের সঙ্গে বিএনপিরও ভালো সম্পর্ক আছে। ফলে ক্ষমতা পরিবর্তন হলেও বাংলাদেশে চীনের স্বার্থে খুব বড় কোনো প্রভাব পড়বে না।’ দ্য হিন্দুর প্রতিবেদনের শেষ দিকে বলা হয়েছে, ‘শেখ হাসিনা যদি নির্বাচনে হেরে যান, তাহলে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা দীর্ঘায়িত হতে পারে। এমনকি আবারও বাংলাদেশ উগ্রবাদীদের আঁতুড়ঘরে পরিণত হতে পারে। ফলে বিষয়টি শুধু ভারত নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।’

সর্বশেষ খবর