মঙ্গলবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

চুরির নাটক, স্বর্ণ আগেই গায়েব

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিমানবন্দরে কাস্টম হাউস থেকে স্বর্ণ লুটের ঘটনায় বেরিয়ে আসছে একাধিক কর্মকর্তার নাম। নিজেদের অপরাধ আড়ালে চক্রটি সিসি ক্যামেরা বন্ধ রাখাসহ চুরির সবরকম আলামত নষ্টের চেষ্টা করেছে। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে চার সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তাসহ আটজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে পুলিশ। থানা পুলিশের পাশাপাশি মামলার ছায়াতদন্ত শুরু করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশসহ একাধিক টিম। অন্যদিকে এ ঘটনায় শুল্ক বিভাগ একজন যুগ্মকমিশনারের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বর্ণ আগেই চুরি করা হয়েছে। তদন্ত ভিন্ন খাতে নিতে লকার ভাঙার ‘নাটক’ সাজানো হয়েছে।

জানা গেছে, চুরির ঘটনায় তোলপাড় হওয়ার পর ভল্টে থাকা ৫৫ কেজি স্বর্ণ গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দিয়েছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। স্বর্ণ চুরির ঘটনায় ঢাকা শুল্ক বিভাগের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ সোহরাব হোসেন বাদী হয়ে মামলা করেছেন। মামলায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করা হয়েছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, চুরির বিষয়টি গোয়েন্দা পুলিশ ছায়াতদন্ত করছে। একাধিক টিম কাজ করছে। কারা কারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনবে পুলিশ।

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছেন, আটকদের বক্তব্যে রয়েছে ব্যাপক গরমিল। একেকজন একেক রকম কথা বলছেন। সাম্প্রতিক সময়ে তাদের অবস্থানের বিষয়ে মিথ্যা তথ্য দিচ্ছেন। পরে প্রযুক্তির মাধ্যমে তাদের অবস্থানের বিষয়টি তুলে ধরলে তারা কোনো কথা বলছেন না। এতে সন্দেহ বাড়ছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম বলেন, ‘কাস্টম হাউসের নিজস্ব গুদামে যে কারও যাওয়ার সুযোগ নেই। এখানে কাস্টমসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই যেতে পারেন। এই স্বর্ণ চুরির আলামত নেই বললেই চলে। আমাদের কাছে যে তথ্য-উপাত্ত আছে সেখানে বাইরে থেকে কেউ এসে স্বর্ণ নিতে পারবে না। কোনো ধরনের যন্ত্রপাতি ছাড়া যে আলমারিতে স্বর্ণ ছিল সেগুলো ভাঙা সহজ না। আর সেখানে যেসব যন্ত্রপাতি ছিল তা দিয়েও আলমারি ভাঙা সম্ভব না।’

ডিসি বলেন, ‘ধরেন প্রতিটি ডিএমে ১০টি স্বর্ণবার ছিল। চোর চুরি করলে তো ১০টি বারই নিয়ে যাবে। সে ওখান থেকে তো একটি দুটি করে নেবে না। যেসব ডিএম থেকে স্বর্ণ চুরি হয়েছে তাদের তথ্যমতে ‘আংশিক স্বর্ণ চুরি’ হয়। এখানে প্রশ্ন জাগিয়ে তুলেছে, বাইরের নাকি ভিতরের কোনো অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী চুরিতে জড়িত- এটা এখন তদন্তের বিষয়।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বিমানবন্দর কেপিআইভুক্ত এলাকা। পুরো এলাকায় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাসহ সরকারি বেশ কয়েকটি সংস্থা কাজ করে। এত নিরাপত্তার মধ্যে গুদাম থেকে স্বর্ণ চুরি হওয়ার বিষয়টি বিমানবন্দরের নিরাপত্তাকেও প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।

পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ২০ আগস্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দেখতে পান ছয়টি চালানের মধ্যে ৯০টি স্বর্ণের বার নেই। বিষয়টি চেপে গিয়ে তারা সুরাহার চেষ্টা করেন। এ বিষয়টি কাস্টমসের অধিকাংশ কর্মকর্তাই জানতেন। এরপর একে একে বেরিয়ে আসে, আরও চালান থেকে একইভাবে দীর্ঘদিন যাবৎ স্বর্ণ সরিয়ে ফেলা হয়েছে। সম্প্রতি ভল্টে রাখা স্বর্ণ যাচাইবাছাইয়ের কথা ছিল। এরপর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কী পরিমান স্বর্ণ চুরি হয়েছে তা দেখতে গিয়ে ৫৫ কেজি স্বর্ণ খোয়া যাওয়ার হিসাব বেরিয়ে আসে।

বিমানবন্দরসূত্র জানান, শাহজালাল বিমানবন্দরের ভিতরে শুল্ক বিভাগে দুটি গুদাম বা লকার রয়েছে। এর মধ্যে নিচতলায় শুল্ক বিভাগের স্ক্যানার দিয়ে যাত্রীদের বের হওয়ার পথে তল্লাশি টেবিলের পাশে ছোট একটি লকার আছে। সেখানে মূলত তল্লাশির সময় তাৎক্ষণিকভাবে জব্দ করা পণ্য রাখা হয়। তবে স্বর্ণ বা বেশি মূল্যবান সামগ্রী হলে সেটা নিচতলায় ‘লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড’ শাখার পাশেই শুল্ক হাউসের গুদামে নিয়ে রাখা হয়। গুদামের ভিতর আলাদা লকার রয়েছে। ওই গুদামের দায়িত্ব পালন করেন চারজন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও চারজন সেপাই। তাদের মধ্যে চার সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা হলেন মাসুদ রানা, সাইফুল ইসলাম শাহেদ, শহিদুল ইসলাম ও আকতার শেখ। চারজন সেপাই হলেন রেজাউল করিম, মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক, আফজাল হোসেন ও নিয়ামত হাওলাদার।

পুলিশ বলছে, দায়িত্বে থাকা আটজনকেই পুলিশ আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। প্রত্যেককে আলাদা এবং একত্র করে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। জিজ্ঞাসাবাদে অনেক তথ্যই বেরিয়ে আসছে। তবে তারা ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন। জিজ্ঞাসাবাদের তথ্য প্রযুক্তিগত তদন্তের সঙ্গে মিলছে না।

জানা গেছে, বিমানবন্দরের চুরি যাওয়া ওই ভল্টের দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্বে ছিলেন দুই কর্মকর্তা শহিদুল ও শাহেদ। সম্প্রতি অভ্যন্তরীণ আদেশে তাদের দুজনকে বদলি করে একই পদমর্যাদার আকরাম ও মাসুমকে দেওয়া হয় দায়িত্ব। কিন্তু তারা গুদামে সংরক্ষিত সামগ্রীর হিসাব নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত আকরাম ও মাসুমকে বুঝিয়ে দিতে টালবাহানা করেন। একপর্যায়ে ঢাকা কাস্টম হাউসের ডেপুটি কমিশনার লুবানা ইয়াসমিন ২১ আগস্ট শহিদুল ও শাহেদের বদলির আদেশ গুদামের মূল্যবান সামগ্রী বুঝিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত স্থগিত করেন। স্বর্ণ উধাওয়ের ঘটনায় এ চারজনকেই নিজেদের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।

শুল্ক বিভাগের ভাষ্য অনুযায়ী, চুরি হওয়া এসব স্বর্ণ ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বিভিন্ন সময় উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু এত দিন ধরে এত পরিমাণ স্বর্ণ বিমানবন্দরের গুদামে রাখা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

ঢাকা কাস্টমস সূত্র জাপ্রণ, বিমানবন্দর থেকে চোরাচালানের স্বর্ণ উদ্ধার হলে সেটা জব্দ তালিকা করে যত দ্রুত সম্ভব বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে পাঠানো হয়। এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিতে হয়, এরপর তারা সময় দিলে সেদিন কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে সেখানে পৌঁছানো হয়। সাধারণত এক-দুই দিনের মধ্যে পাঠানো হয়। এর বাইরে যাত্রীদের আনা (ব্যাগেজ রুলের আওতায়) স্বর্ণ ঠিকভাবে শুল্ক পরিশোধ করতে না পারলে বা নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি আনলে সেটা ছাড়িয়ে নেওয়ার আগ পর্যন্ত ওই গুদামে রাখা হয়। অনেক ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিকতা বা আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে স্বর্ণ ছাড়িয়ে নিতে কারও কারও কয়েক মাস লেগে যায়। সাত-আট মাস বা এক বছরও লেগেছে এমন ঘটনাও রয়েছে। কিন্তু চুরি হওয়া স্বর্ণের মধ্যে দু-তিন বছর আগের স্বর্ণও ছিল বলা হচ্ছে। এত দিন রাখাটা স্বাভাবিক নয়।

মামলার এজাহারে যা আছে : মামলার এজাহারসূত্রে জানা যায়, গত শনিবার সকাল ৯টার দিকে ঢাকা শুল্ক বিভাগের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও গুদামের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা মাসুদ রানা যুগ্মকমিশনারকে বিমানবন্দরের ‘লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড’ শাখার কাছে শুল্ক বিভাগের গুদামের মূল্যবান পণ্যসামগ্রী রাখার একটি স্টিলের আলমারির লকার ভাঙা বলে জানান। মাসুদ রানা যুগ্মকমিশনারকে আরও জানান, প্রতিদিনের মতো আটক পণ্য গুদামে রেখে তিনিসহ চারজন রাত সাড়ে ১২টার দিকে শুল্ক বিভাগ ছেড়ে চলে যান। গুদামের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের কাছ থেকে এমন সংবাদ পেয়ে ওই গুদাম পরিদর্শনে যান ঢাকা শুল্ক বিভাগের কমিশনার, অতিরিক্ত কমিশনার ও যুগ্মকমিশনার। তারা গিয়ে গুদামের একটি স্টিলের আলমারির লকার ভাঙা দেখেন। গুদামের পুব পাশে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের বাতাস যে অংশ দিয়ে বের হয়, সেখানকার টিনের কিছু অংশ কাটা দেখতে পান। পরে তারা গুদামের দায়িত্বে থাকা চারজন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও চারজন সেপাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।

মামলার এজাহারে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, গুদামের দায়িত্বে কর্মকর্তাদের কাছ থেকে কোনো সন্তোষজনক উত্তর না পেয়ে শুল্ক বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গুদাম থেকে কোনো মূল্যবান বস্তু চুরি হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য গুদামের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মৌখিক নির্দেশনা দেন। পরে গুদামের কর্মকর্তারা স্বর্ণ আটকের রসিদ (ডিএম) মোতাবেক দেখতে পান ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে আটক ৫৫ কেজি ৫১ গ্রাম স্বর্ণ চুরি হয়েছে। শনিবার রাত সাড়ে ৯টা থেকে পরদিন সকাল সাড়ে ৮টার মধ্যে কে বা কারা গুদামের আলমারির লকার ভেঙে স্বর্ণ নিয়ে যায় বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ রয়েছে। শুল্ক বিভাগ বলছে, চুরি হওয়া এই স্বর্ণের মূল্য প্রায় ৪৫ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে ঢাকা কাস্টমসের প্রিভেন্টিভ টিমের ডেপুটি কমিশনার সৈয়দ মোকাদ্দেস হোসেন বলেন, ঘটনায় যারা দোষী তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। কাউকে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। চুরি যাওয়া স্বর্ণের মধ্যে অলংকার ও বার ছিল। এ ঘটনার পর আমরা সেখানে কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করি। পুরো গোডাউনটা চেক করি কোনো সমস্যা আছে কি না দেখতে। এ সময় এখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্য বাহিনীর সদস্যরাও ছিলেন। তিনি বলেন, এল শেপ গুদামটির মাথায় যেখানে এসি আছে সেখানে একটি গর্ত দেখা গেছে। সেটা দিয়ে মানুষ প্রবেশ করা সম্ভব। এখানে কর্মকর্তা বা অন্যরা জড়িত থাকতে পাপ্রণ। কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সিসিটিভি ফুটেজ চেক করা হবে। এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না কী ঘটেছে।

ঢাকা কাস্টম হাউসের কমিশনার এ কে এম নুরুল হুদা আজাদ বলেছেন, গুদামে অনেক লকার থাকলেও স্বর্ণ চুরি হয়েছে একটি লকার থেকে। এসব স্বর্ণ ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে উদ্ধার হয়েছে। আট দিন আগে গুদামটি অটোমেশনের কাজ শুরু হয়। এ কাজের অংশ হিসেবে গুদামে থাকা স্বর্ণ গণনার কাজ শুরু হয়। স্বর্ণ চুরির ঘটনা আগেই ঘটেছে। গুদামের অটোমেশনের কাজ শুরু হওয়ায় সেটা ধরা পড়বে; তাই লকার ভাঙার ‘নাটক’ তৈরি করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর