বৃহস্পতিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

এনআইডি চলে গেল স্বরাষ্ট্রে বিল পাস

নিজস্ব প্রতিবেদক

নির্বাচন কমিশনের হাত থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নিবন্ধন সেবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিতে ‘জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন বিল-২০২৩’ সংসদে পাস হয়েছে। গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বিলটি পাসের জন্য সংসদে উত্থাপন করেন। বিলের ওপর আনা জনমত যাচাই-বাছাই কমিটিতে প্রেরণ ও সংশোধনী প্রস্তাবগুলো নিষ্পত্তি শেষে কণ্ঠ ভোটে বিলটি পাস হয়।

২০১০ সালের জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন রদ করে নতুন এ আইনটি করা হচ্ছে। অবশ্য বিলটি পাস হলেও সহসাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে যাচ্ছে না। বিলে আইনটি সরকারি গেজেট দ্বারা কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে। এক্ষেত্রে যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ইসির হাত থেকে স্বরাষ্ট্রের কাছে যেতে দু-এক বছর সময় লেগে যেতে পারে। এদিকে বিলের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে বিরোধীদলীয় সদস্যরা অভিযোগ করেন সরকারের এ সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি আরও বাড়বে। কারণ পুলিশ এখনো জনবান্ধব হতে পারেনি। পুলিশের সমালোচনা করতে গিয়ে বিরোধীদলীয় সদস্যরা সম্প্রতি পরকীয়া প্রেমের জেরে পুলিশ কর্মকর্তাদের হাতে ছাত্রলীগ নেতাদের নির্যাতন এবং আদালত চত্বরে আইনজীবীদের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জের ঘটনাও উল্লেখ করেন। এসব সমালোচনার জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামাক খান বলেন, ‘যেই অপরাধ করুক প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় তাকে শাস্তি কিন্তু পেতে হয়। আপনারা যে পুলিশ অফিসারের কথা বলেছেন তিনিও আইনের ঊর্ধ্বে নন। ইমিডিয়েট যে ব্যবস্থা সেটা নেওয়া হয়েছে। এখন তার শাস্তির ব্যবস্থাটা... যেহেতু মামলা হয়নি। এখনো কেউ মামলা করেনি। আমাদের তদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী তার শাস্তির ব্যবস্থা অবশ্যই হবে’। এর আগে বিলের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে গণফোরাম সদস্য মোকাব্বির খান বলেন, এনআইডি নিয়ে মানুষের অনেক ভোগান্তি রয়েছে। এটা নিয়ে মানুষের অনেক সমস্যা আছে। এটা পুলিশের নিয়ন্ত্রণে গেলে দুর্ভোগ আরও বাড়বে। কারণ এখনো পুলিশ প্রকৃত পক্ষে জনগণের বন্ধু হতে পারেনি।

জন্মের পরই নাগরিকত্ব আইডি দেওয়ার বিষয়ে মোকাব্বির খান বলেন, জন্মনিবন্ধন তো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় করে না। এটি করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। তাহলে সেটা কীভাবে বাস্তবায়ন করবেন। এটি করতে গেলে জন্মনিবন্ধন, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ কয়েকটি কর্তৃপক্ষকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে আসতে হবে। জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম বলেন, ইসির কাছে থাকা নাগরিকের তথ্য যাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে। কিন্তু ইসির সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি। ভোটার তালিকা করার স্বাধীনতা ইসির। নভেম্বরে নির্বাচনের তফসিল হবে। এর আগে এ আইনটি কার্যকর হলে ভোটার তালিকা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা করেন।

ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিএনপিপন্থি আইনজীবী ও পুলিশের সংঘর্ষের কথা তুলে ধরে জাতীয় পার্টির সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, আইনজীবীদের পেটাতে দেখা গেছে। তাদের অপরাধ জানা যায়নি। তারা সরকারবিরোধী হতে পারেন।

আইনজীবীদের গায়ে হাত তোলার বিষয়ে সরকারের সতর্ক থাকা উচিত। তিনি বলেন, পুলিশকে ওই কৌশলটা বের করতে হবে। কীভাবে চাপ না দিয়েও পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যায়, পরিস্থিতি শান্ত করা যায়। আইনজীবীর গায়ে হাত তোলা গর্হিত কাজ- এমন মন্তব্য করে শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, পুলিশকে একসময় আইনজীবীর মাধ্যমে ন্যায়বিচার চাইতে হবে, তাই তাদের সম্মান জানানো উচিত।

ছাত্রলীগ নেতাদের ওপর নির্যাতনের প্রসঙ্গ টেনে জাতীয় পার্টির আরেক সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ঢাকায় যেসব পুলিশ কর্মকর্তার পদায়ন করা হয় তাদের বিষয়ে বিস্তারিত খোঁজখবর নেওয়া হয়। অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করে যারা অনুগত তাদের ঢাকায় পদায়ন করা হয়। তারপরও এমন কর্মকর্তা ঢাকায় কীভাবে আসে? হিন্দি সিনেমার মতো কোনো এক কর্মকর্তা তার অবৈধ প্রেমের কারণে ছাত্রলীগের নেতাদের থানায় পুলিশের কন্ট্রোল রুমে নিয়ে সাত-আটজনে মিলে অমানুষিক নির্যাতন করে। এটা সিনেমাকে হার মানিয়েছে। এটা অত্যন্ত জঘন্য ঘটনা। পুলিশের হেফাজতে নিয়ে বাংলাদেশের নাগরিককে নির্যাতন করে, তাও সরকার দলের সহযোগী সংগঠনের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিদের নির্যাতন করে, তাহলে দেশের আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতির অবস্থাটা কী? আমি জানি না কেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি মামলা করেননি। শুধু তদন্ত করে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিলে সুবিচার হবে না। সুবিচার হবে ক্ষতিগ্রস্তরা মামলা করে ফৌজদারি আইনের আওতায় এনে বিচার করে সাজার ব্যবস্থা করলে। যাতে এ ধরনের উচ্ছৃঙ্খল পুলিশ অফিসার ক্ষমতায় অন্ধ হয়ে, রাষ্ট্রের বেতন নিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করবে, এটা অন্তত বন্ধ করেন।

পাস হওয়া বিলে বলা হয়েছে, জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার জন্য একজন ‘নিবন্ধক’ থাকবেন। সরকার তাকে নিয়োগ দেবে। নিবন্ধক ও নিবন্ধকের কার্যালয়ের কার্যক্রম সম্পূর্ণ শুরু না হওয়া পর্যন্ত বিদ্যমান পদ্ধতিতে নির্বাচন কমিশন জাতীয় পরিচয়পত্র দিতে পারবে। সরকার গেজেট জারি করে যে তারিখ নির্ধারণ করবে সে তারিখ থেকে এ আইন কার্যকর হবে।

বিদ্যমান পরিস্থিততে এনআইডি দিয়ে থাকে নির্বাচন কমিশন। নতুন আইনটি কার্যকর হলে ইসি সে ক্ষমতা হারাবে। বিলে বলা হয়েছে, বিদ্যমান আইনটি রহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের কাছে রক্ষিত এবং নির্বাচন কমিশন কর্তৃক সংগৃহীত জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত সব তথ্য-উপাত্তের কপি এবং সম্পদ ও দায়দেনা নিবন্ধকের কাছে হস্তান্তরিত হবে।

বিলে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশনের চাহিদা মোতাবেক নিবন্ধক প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত প্রদান করবে। এজন্য নিবন্ধকের কার্যালয়ের অধীন একটি সেল থাকবে। এ সেলে নির্বাচন কমিশনের প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মচারী দায়িত্ব পালন করবেন।

বিলে বলা হয়েছে, জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়ার জন্য প্রত্যেক নাগরকিকে পরিচয় নিবন্ধন করতে হবে। এ জন্য নির্ধারিত পদ্ধতিতে নিবন্ধকের কাছে আবেদন করতে হবে। একজন নাগরিককে নিবন্ধক একটি নম্বর দেবেন। সেটা একক পরিচিতি নম্বর (ইউনিক আইডেনটিফিকেশন নম্বর) হিসেবে সবখানে ব্যবহৃত হবে।

বিলে অপরাধ ও শাস্তির বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘কোনো নাগরিক জাতীয় পরিচয়পত্র প্রাপ্তির লক্ষ্যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বা জ্ঞাতসারে কোনো মিথ্যা তথ্য প্রদান বা তথ্য গোপন করিলে তিনি এই আইনের অধীন অপরাধ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন। এই অপরাধের জন্য তিনি সর্বোচ্চ এক বৎসর কারাদণ্ড বা অনধিক ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’ এ ছাড়া ‘কোনো নাগরিক জ্ঞাতসারে একাধিক জাতীয় পরিচয়পত্র গ্রহণ করিলে তিনি এই আইনের অধীন অপরাধ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন এবং উক্ত অপরাধের জন্য এক বৎসর অনধিক এবং ২০ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হইবেন।’

তথ্য-উপাত্ত বিকৃত বা বিনষ্ট সংক্রান্ত অপরাধের বিষয়ে বিলে বলা হয়েছে, ‘সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মচারী অথবা এই আইন দ্বারা বা ইহার অধীন জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালনা পরিচয়পত্র প্রস্তুতকরণ, বিতরণ ও রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত দায়িত্ব পালনরত কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে নিবন্ধকের নিকট সংরক্ষিত জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত কোনো তথ্য-উপাত্ত বিকৃত বা বিনষ্ট করিলে তিনি অপরাধ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন এবং উক্ত অপরাদের জন্য তিনি সর্বোচ্চ সাত বৎসর কারাদণ্ড বা অনধিক এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’ কোনো ব্যক্তি জাতীয় পরিচয়পত্র জাল করলে বা ওই পরিচয়পত্র বহন করলে একই শাস্তি পাবেন।

বিলে বলা হয়েছে, নিবন্ধন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা, সমন্বয় ও পরিবীক্ষণের জন্য একটি সমন্বয় কমিটি থাকবে। এ কমিটির সভাপতি হবেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব। নিবন্ধক হবেন এ কমিটির সদস্য সচিব। নির্বাচন কমিশন ও সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রতিনিধিরা থাকবেন সদস্য।

বিলের উদ্দেশ্য ও কারণ-সংবলিত বিবৃতিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন কার্যক্রম নির্বাহী বিভাগের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বিভিন্ন দেশের উদাহরণের আলোকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন সুরক্ষা সেবা বিভাগ এ দায়িত্ব পালনে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ। তাই সুরক্ষা সেবা বিভাগের মাধ্যমে এ সেবাটি জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বিদ্যমান আইনটি সংশোধন করা প্রয়োজন।

সর্বশেষ খবর