মঙ্গলবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা
সংলাপ

দুই দল দুই মেরুতে

♦ সংবিধান মেনে হতে পারে : আওয়ামী লীগ ♦ তত্ত্বাবধায়ক নিয়েই কেবল কথা : বিএনপি

নিজস্ব প্রতিবেদক

মার্কিন প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমঝোতায় অংশীজনদের মধ্যে অর্থবহ সংলাপের সুপারিশ করায় রাজনীতিতে ক্ষণিক আলোর ঝিলিক দেখা গেলেও সংঘাতের শঙ্কা থেকেই গেল। সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির শর্তের বেড়াজালে বন্দি হয়ে পড়েছে কাক্সিক্ষত সংলাপ। দুই পক্ষের অনড় অবস্থান থাকায় সংলাপের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। আগামী সাধারণ নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে এসেও সমঝোতার লক্ষণ না থাকায় রাজনীতিতে সংঘাতের আশঙ্কা করছে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশি-বিদেশিদের কৌতূহল বাড়ছে। যথাসময়ে নির্বাচন হবে কি না? কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে? নির্বাচনের আগে প্রধান দুই দলের মধ্যে সংলাপ হবে কি না- তা নিয়েও আলোচনা চলছে। এ ছাড়া বিদেশিরা যাওয়া-আসার     মধ্যেই আছেন। সর্বশেষ ঢাকা সফরে আসা যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনি পর্যবেক্ষক দল সংলাপের সম্ভাবনা জাগিয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে তারা সংকট সমাধানে সমন্বয় করার পথ খুঁজতে বলেছে। দলগুলোর শীর্ষ পর্যায়ে কথা বলে জানা যায়, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের দৃশ্যত সংলাপবিরোধী অবস্থান না থাকলেও তারা নিজ নিজ অবস্থানে অটুট রয়েছেন। সংলাপে বসার আগেই তারা দলীয় দাবির পক্ষে শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। এমনকি বিদ্যমান পরিস্থিতির জন্য তারা একে অপরকে দায়ী করছেন। দাবি আদায়ে বিএনপি কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। একইভাবে আওয়ামী লীগ পালটা কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে আছে। বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করছেন, দুই পক্ষই শক্তি দেখিয়ে জিততে চাইছে। ফলে সংলাপ নয়, সংঘাতের দিকেই যাচ্ছে দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ।

আওয়ামী লীগের একাধিক নীতিনির্ধারকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দলটির সংলাপে বসতে সমস্যা নেই। শর্তবিহীন সংলাপে সম্মত তারা। আর বিএনপির নীতিনির্ধারকরা বলছেন, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে আলোচনায় সম্মত নন তারা। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, শর্ত তুলে দিলে সংলাপের চিন্তা। আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়কমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, সংবিধানের বাইরে সংলাপ নয়। আর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নেওয়া ছাড়া সংলাপ নয়।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করছে, দুই দলের এরকম অবস্থানে সংলাপ আশা করা যায় না। তবে নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক সমঝোতা হবে কি না তার সবকিছুই নির্ভর করছে দলগুলোর ওপর বিদেশি চাপ কতটুকু আছে তার ওপর।

সংবিধান মেনে সংলাপে সম্মত আওয়ামী লীগ : নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে সংবিধানের ভিতরে থেকে নিবন্ধিত যে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করতে রাজি আওয়ামী লীগ। শর্তযুক্ত কোনো সংলাপে যাবে না দলটি। সব দলের অংশগ্রহণ ও প্রতিযোগিতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন করতে সংলাপের পরিবেশ সৃষ্টি হলে এতে আগ্রহী হবে ক্ষমতাসীন দলটি। দলের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন আভাস পাওয়া গেছে।

দলটির শীর্ষ নেতারা বলছেন, সুষ্ঠু গণতন্ত্রের জন্য আলাপ-আলোচনা কিংবা সংলাপের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু বসার আগেই যদি কেউ শর্ত জুড়ে দেয় তাহলে বসার দরকার কী? তাদের দাবি যদি মেনেই নেওয়া হয়, তাহলে তো সংলাপের প্রয়োজন হবে না। সংলাপে বসতে হলে ছাড় দেওয়ার সদিচ্ছা থাকতে হবে বিরোধী পক্ষকে। অন্যথায় আওয়ামী লীগ সংলাপ করবে না। কারণ এমন কোনো পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি, যে সরকারি দলকে সংলাপে বসতেই হবে।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শর্তহীনভাবে তারা বসতে চাইলে আমরা সংলাপে বসব। কারণ আমরা চাই প্রতিযোগিতাপূর্ণ ও সুন্দর একটি নির্বাচন হোক। আর বসার মধ্য দিয়ে একটি সুন্দর রাজনৈতিক ও ভোটের পরিবেশ তৈরি হবে বলে বিশ্বাস করি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দুই দলের দ্বিতীয় প্রধান (সাধারণ সম্পাদক-মহাসচিব) ব্যক্তির কথায় আগের অবস্থান থেকে সরে আসার আভাস পাওয়া যায়। অর্থাৎ রাজনৈতিক বরফ গলতে শুরু করেছে। বিশেষ প্রয়োজনে তারা শর্ত যুক্ত করে দিলেও বসলে একটা সমাধান আসবেই। তবে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিএনপিকে শর্ত তুলে নিতে হবে। তা না হলে সংলাপ করার প্রয়োজনীয়তা দেখছেন না তারা। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সংলাপে বসতে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হবে, নির্দলীয় সরকার করতে হবে? বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে ভেঙে দিতে হবে- বিএনপি এসব শর্ত জুড়ে দিলে কোনো সংলাপ হবে না। শর্তবিহীন সংলাপ চাইলে আমরা রাজি আছি।’

নির্বাচনের বাকি আর মাত্র তিন মাস। এ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত হচ্ছে। নির্বাচনকালীন সরকারসহ নানা ইস্যুতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং অন্যতম বিরোধী দল বিএনপি বিপরীতমুখী অবস্থানে রয়েছে। দুই দলই নতুন নতুন কর্মসূচি নিয়ে রাজপথ দখলে রাখতে মরিয়া। এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য সংলাপ বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। বড় দুই দলের মধ্যে সংলাপ হবে কি না- এনিয়ে জনমনে আগ্রহের শেষ নেই। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহলের পক্ষ থেকেও অর্থবহ সংলাপের তাগাদা রয়েছে। জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আর কয়েক মাস পরই জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আমরা চাই, এ নির্বাচনটি নিবন্ধিত সব দলের অংশগ্রহণে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও প্রতিযোগিতামূলক হোক। সে কারণে সংবিধানের ভিতরে থেকে যে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আমরা সংলাপ করতে রাজি আছি। যা হওয়ার সংবিধানের ভিতর থেকেই হতে হবে। সংলাপে বসার আগেই প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ, নিরপেক্ষ সরকার গঠনের শর্ত যুক্ত করে দিলে বসার কোনো সুযোগ নেই।’ দলের আরেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণই বড় কথা। জনগণ নির্বাচনমুখী। কাজেই কারও শর্ত মেনে সংলাপ করার প্রয়োজনীতা দেখছি না। দলের নীতি-নির্ধারকরা বলছেন, সংলাপ হতে হবে শর্তমুক্ত। শর্তই যদি যুক্ত থাকে তাহলে সংলাপের অর্থ হয় না। সুতরাং আওয়ামী লীগের অবস্থান হচ্ছে, বিএনপি শর্ত ছেড়ে এলে সংলাপ হবে। আর শর্তযুক্ত থাকলে সংলাপ অনর্থক, তাদের সঙ্গে বসার কোনো প্রয়োজনীতা নেই।

আওয়ামী লীগের এজেন্ডায় সংলাপে যাবে না বিএনপি : আওয়ামী লীগের নির্ধারণ করা এজেন্ডায় কোনো সংলাপে যাবে না রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। দলের নীতি-নির্ধারকরা বলেছেন, আমরাও সংলাপ চাই। কিন্তু যাদের বিরুদ্ধে পর পর তিনটি জাতীয় নির্বাচনে অস্বচ্ছতা ও ভোট চুরির অভিযোগ রয়েছে, যারা দিনের ভোট রাতে করে অবৈধভাবে ক্ষমতায় আছে। যাদের জন্য আজ দেশের গণতন্ত্র ও মানুষের ভোটাধিকার অপহৃত, সেই আওয়ামী লীগ সংলাপের এজেন্ডা নির্ধারণ করে দেবে, বিএনপি সে সংলাপে যাবে না। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের পরিষ্কার ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোনো সংলাপ করবে না বিএনপি।

বিএনপির একাধিক সিনিয়র নেতা জানান, বর্তমানে একতরফা নির্বাচনের ব্যাপক তোড়জোড় শুরু করেছে সরকার। সরকারের ইচ্ছানুযায়ী নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার বড়জোর এক মাস বাকি আছে। এ পর্যায়ে সংলাপের উদ্যোগ নেওয়া, আয়োজন করা এবং এ থেকে একটা ফলপ্রসূ সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর মতো রাজনৈতিক বাস্তবতা দেশে নেই। সেক্ষেত্রে রাজপথের আন্দোলনই হবে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর একমাত্র পথ। ১৮ অক্টোবর বুধবার ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জনসভা থেকে আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করবে দলটি। সরকারকে পদত্যাগের জন্য কয়েকদিনের সময় বেঁধে দেওয়া হতে পারে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে একদফা দাবি না মানলে পরবর্তিতে লাগাতার কর্মসূচিতে যাওয়ার কথা রয়েছে বিএনপির। পরিস্থিতি অনুযায়ী সভা-সমাবেশ, অবস্থান, ঘেরাও, হরতাল, অবরোধসহ সব ধরনের কর্মসূচিই ঘোষণা করা হতে পারে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংলাপ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নির্বাচনকালীন নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে আলোচনা করতে আমরা রাজি নই। এটা ছাড়া বিএনপি কোনো সংলাপে যাবে না। সংলাপের বিষয়ে বিএনপি তার আগের অবস্থানেই অটুট রয়েছে। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও দলের আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নির্বাচনে ভোট চুরির দায়ে যারা অভিযুক্ত, যাদের বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি সবার এ অস্বচ্ছতার অভিযোগ- সেই ভোট চোরদের দেওয়া এজেন্ডায় বিএনপি কোনো সংলাপে যাবে না। তিনি বলেন, আমরাও সংলাপের পক্ষে। কিন্তু সে সংলাপের এজেন্ডা হতে হবে বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আর জনগণের প্রত্যাশা হচ্ছে- একটি নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আগে সরকারকে পদত্যাগ ও নির্বাচনকালীন নির্দলীয়-নিরপেক্ষ নির্বাচনের ঘোষণা দিতে হবে। তারপর আমরা অবশ্যই সংলাপে যাব।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর