বৃহস্পতিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

মনোনয়ন বাণিজ্য সিন্ডিকেট

অভিযান চলছে র‌্যাব পুলিশের ♦ ৩০০ কোটি টাকা বাণিজ্যের হোতা র‌্যাবের জালে ধরা সিরাজগঞ্জে আরও দুজন আটক, ভুয়া সংস্থার জরিপের নামে চলছে ব্যবসা

রফিকুল ইসলাম রনি

মনোনয়ন বাণিজ্য সিন্ডিকেট

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নৌকা পাইয়ে দিতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে ভুয়া মনোনয়ন বাণিজ্যের সিন্ডিকেট। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে বিশেষ সখ্য থাকার কথা বলে এডিট করা ছবি দেখিয়ে নানা কৌশল কাজে লাগিয়ে তারা হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ থেকে কোটি কোটি টাকা। এ চক্রের কেউ কেউ বিভিন্ন জরিপ সংস্থার লোকজন পরিচয় দিয়ে ‘জরিপে’ এগিয়ে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েও হাতিয়ে নিচ্ছেন টাকা। উঠতি ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদদের টার্গেট করে রাজধানীর নামিদামি তারকা হোটেলে করছেন বৈঠক। ইতোমধ্যে একাধিক ব্যক্তি এ ভুয়া চক্রের খপ্পরে পড়ে খুইয়েছেন টাকা। প্রতারক চক্রকে ধরতে অভিযান চলছে র‌্যাব-পুলিশের। ইতোমধ্যে এ চক্রের অন্যতম একজন আবু হানিফ তুষার ওরফে হানিফ মিয়াকে (৩৯) গ্রেফতার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-র‌্যাব। তিনি নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর নিকটাত্মীয় পরিচয় দিয়ে নৌকা পাইয়ে দিতে ৩০০ কোটি করে টাকা চাইতেন বলে জানা গেছে।  এর আগে ৩ অক্টোবর সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে গিয়ে প্রতারণার সময় গ্রেফতার হন হিউম্যান রাইটসের কর্মকর্তা পরিচয়ধারী তাছলিমা খাতুন, জাহাঙ্গীর হোসেন ও মো. ফয়জুল্লাহ। তারা নৌকা পাইয়ে দিতে এবং জরিপে এগিয়ে রাখতে কমপক্ষে ৩০ জনের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়ে শাহজাদপুরে গিয়ে ধরা পড়েন। জানা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় নৌকা পাইয়ে দেওয়ার নাম করে প্রতারক চক্র সক্রিয় হয়ে উঠছে। তারা উঠতি রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী এবং যাদের এলাকায় ন্যূনতম জনপ্রিয়তা নেই, কিন্তু অঢেল টাকার মালিক সেসব নেতাকে টার্গেট করছেন। এ প্রতারক চক্রটি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এডিট করা ছবি দেখিয়ে তাঁর নিকটাত্মীয় পরিচয় দেয়। কখনো প্রভাবশালী দেশের রাজনীতিবিদ, বিশেষ গোষ্ঠীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, উনি যে তালিকা দেবেন তারা সেই তালিকা আওয়ামী লীগ প্রধানকে দেবেন- এমন চমকপ্রদ কথা বলে প্রতারণা করছেন। তারা রাজধানীর পাঁচতারকা হোটেলে বৈঠক করছেন। নিজেদের ‘গুরুত্বপূর্ণ’ করে তুলতে সেই বৈঠকে কখনো কখনো বিদেশিদের রাখা হচ্ছে। আর সেই বিদেশিরা আওয়ামী লীগের মনোনয়নে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখেন বলে প্রচার করা হয়। মনোনয়ন পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে তারা কোটি কোটি টাকার চুক্তি করছেন। কখনো কখনো কোটি টাকা অগ্রিম নিচ্ছে।

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বারবার বলে আসছেন, ‘মুখ দেখে নয়, জরিপ দেখে মনোনয়ন’। প্রতারক চক্রটি এ সুযোগ গ্রহণ করছে। তারা নিজেদের জরিপ সংস্থার বা প্রধানমন্ত্রী তাদের দিয়ে জরিপ করাচ্ছেন- এমন কথা বলে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে প্রতারণা করছেন। এ জরিপ আগামী সংসদ নির্বাচনে নৌকা পেতে নিয়ামক ভূমিকা রাখবে। এ প্রতারক চক্র কারও জনপ্রিয়তা কম থাকলে ‘জনপ্রিয়’ নেতা বানিয়ে দেওয়ারও আশ্বাস দেয়। 

একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা জানিয়েছে, ছয় মাস ধরে প্রতারক চক্রটি দেশের বিভিন্ন এলাকার সম্ভাব্য প্রার্থীদের টার্গেট করছে। তাদের ব্যাপারে আগে থেকে নানা তথ্য সংগ্রহ করছে। কোনো কোনো এলাকায় গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রতিনিধি পরিচয় দেয়। এসব চক্রের সদস্য কথাবার্তায় বেশ পটু। এ প্রতারক চক্রের টিম লিডার বেশ ভাবগম্ভীর। তারা মনোনয়নপ্রত্যাশীদের ওই এলাকার হোটেল বা রিসোর্টে ডেকে কথা বলেন। নানা প্রশ্নে জর্জরিত করেন। তারা চাইলেই জনপ্রিয়তা না থাকলেও জনপ্রিয় প্রার্থী এমন নিশ্চয়তা দিয়ে হাতিয়ে নেন টাকা। এ ছাড়াও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের একাধিক নেতার নাম ভাঙিয়ে কেউ কেউ হাতিয়ে নিচ্ছেন টাকা। তারা কখনো নিজেদের পরিচয় দিচ্ছেন মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যদের ব্যক্তিগত সহকারী, কেউ বন্ধু, কেউ নিকটাত্মীয়। আবার কেউ কেউ অতি ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবেও জাহির করে হাতিয়ে নিচ্ছেন টাকা। শুধু সংসদ নির্বাচনই নয়, বিগত সময়ে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনেও এমন ঘটনা ঘটেছিল। এ প্রসঙ্গে গতকাল আওয়ামী লীগের পাঁচজন প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং তিনজন মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তারা এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তারা প্রত্যেকেই বলেছেন, দলীয় সভানেত্রী জরিপ করাচ্ছেন সত্য, কিন্তু যাদের দিয়ে জরিপ করাচ্ছেন তারা কখনো নিজেদের জরিপকারী সংস্থার লোক পরিচয় দেন না। অর্থ হাতিয়ে নেওয়ারও প্রশ্ন আসে না। যারা অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন তারা প্রতারক চক্র। আর দলীয় সভানেত্রী নিজস্ব জরিপ দেখে মনোনয়ন বোর্ডের সভায় প্রার্থী চূড়ান্ত করেন। কারও সুপারিশে মনোনয়ন দেন না। কেউ যদি এমন লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত হয়, আওয়ামী লীগ তথ্য পেলে উভয়কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দেবে।

সূত্রমতে, ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী অনেক নেতার ধারণা হয়েছে, নৌকা পেলেই বিজয় নিশ্চিত। সে কারণে যে করেই হোক ‘নৌকা’ পেতে মরিয়া তারা। বিশেষ করে উঠতি ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদরা এ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। সে কারণে নৌকা পেতে নানাভাবে তদবির করছেন। কেউ কেউ ধরাও খাচ্ছেন। কেউ কেউ মোটা অংকের টাকা দিয়ে নৌকা পাওয়ার আশায় বুক বেঁধে আছেন। হবেন দেশের আইনপ্রণেতা।

আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাসে অর্থ আত্মসাৎ, প্রতারক হানিফ গ্রেফতার : ??প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে পরিচয় ও সুসম্পর্কের কথা বলে প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে মঙ্গলবার রাতে আবু হানিফ তুষার ওরফে হানিফ মিয়া নামে একজনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-র‌্যাব। কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, আবু হানিফ দীর্ঘদিন ধরে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের নিকটাত্মীয় হিসেবে মিথ্যা পরিচয় ও সুসম্পর্কের কথা বলে বিভিন্ন ধরনের প্রতারণা করছিলেন। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের বিভিন্ন সংসদীয় আসনে মনোনয়ন প্রাপ্তির মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ দাবি করছিলেন। এ ছাড়াও আবু হানিফ বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে মোটা অংকের টাকা আত্মসাৎ করেন। তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন অ্যাপস থেকে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্য সেজে পদে পদায়ন ও পদোন্নতি, সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেওয়া সংক্রান্ত ও বিভিন্ন অংকের অর্থ দাবি সংক্রান্ত বার্তা নিজেরাই নিজ চক্রের সদস্যদের সঙ্গে আদান-প্রদান করতেন। বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিজের ছবি এডিট করে বসাতেন এবং প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে বলে মিথ্যা দাবি করে তা টার্গেট করা ব্যক্তিকে পাঠাতেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে কৌশলে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলে তার টার্গেট করা ব্যক্তিকে দেখাতেন। 

এক প্রশ্নের জবাবে র‌্যাবের মুখপাত্র বলেন, বিভিন্ন তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় আমরা জানতে পেরেছি ১০-১২ জনকে মনোনয়ন পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন হানিফ। প্রধানমন্ত্রীর নিকটাত্মীয়ের কথা বলে মিথ্যা অপপ্রচার করতেন তিনি। ২০১৫ সালে হানিফ যে ব্যক্তির পিএস হিসেবে কাজ করতেন তাকেও মনোনয়ন পাইয়ে দেওয়ার কথা বলেন। তিনি এভাবে মনোনয়ন পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।

র‌্যাব জানায়, ২০১৪ সালের পর থেকে একজন সুপরিচিত রাজনীতিবিদের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে পরিচয় দিয়ে প্রতারণার শুরু করেন হানিফ মিয়া। তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কৌশলে রাজনীতিবিদ, উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে নিজের মিথ্যা পরিচয় দিয়ে পরিচিত হন। পরে সুসম্পর্ক তৈরি করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির অফিস বা কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে ছবি তোলেন এবং প্রতারণার কাজে এ ছবিগুলো ব্যবহার করতেন। ২০১৫ সালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলেন। বিভিন্ন সময়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে অনুষ্ঠান, সেমিনারে অংশগ্রহণ এবং দেশের বাইরে ভ্রমণ করে ছবি তুলে তা ফেসবুকে আপলোডের মাধ্যমে তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টের পরিচিতি ও দেশে-বিদেশে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর চেষ্টা করেন। এ ছাড়া ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন অনুষ্ঠান স্পন্সর করে বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সান্নিধ্যে আসা, প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ জমি ও সম্পত্তির মালিক হওয়া, সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত থাকায় তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক সংক্রান্ত বিষয়ে একাধিক মামলা রয়েছে এবং ওই মামলায় একাধিকবার কারাভোগও করেছেন এ প্রতারক।

৩০ মনোনয়নপ্রত্যাশীর কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে অবশেষে ধরা : ৩ অক্টোবর সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার গ্র্যান্ড চায়নিজ অ্যান্ড পার্টি সেন্টার থেকে প্রতারণা করার সময় গ্রেফতার করা হয় হিউম্যান রাইটসের কর্মকর্তা পরিচয় দেওয়া তাছলিমা খাতুন, জাহাঙ্গীর হোসেন ও মো. ফয়জুল্লাহকে। আসন্ন নির্বাচনে এমপি প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ে উপজেলার ১৩ চেয়ারম্যানের সঙ্গে বসার ইচ্ছার তাদের। সেদিন ৯ জন চেয়ারম্যান হাজির হন। কারও জনপ্রিয়তা কম থাকলে নম্বর বেশি দিয়ে ‘জনপ্রিয় নেতা’ বানিয়ে তারা প্রতিবেদন দিতে পারেন। এমপির মাঠ জরিপ তথ্য সন্তোষজনক লেখার বিনিময়ে ৫০ লাখ টাকা দাবি করেন তারা। উপজেলার জনপ্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় তাদের গ্রেফতার করা হয়। সবার গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী। প্রতারণার অভিযোগে তারা এর আগে হাজতে ছিলেন বলে জানা গেছে। আটক ব্যক্তিরা সেদিন জানিয়েছিলেন, অন্তত ৩০ মনোনয়নপ্রত্যাশীর কাছ থেকে তারা টাকা হাতিয়েছেন।

জানা যায়, ওই দিন তারা সিরাজগঞ্জ-৫ আসনের বর্তমান এমপি মেরিনা জাহান কবিতার বাড়িতে যান। সেখানে কথাবার্তা সেরে একটি হোটেলে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, গণমান্য ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার নেন। এ সময় জেলা পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থার কাছে তথ্য গেলে তারা খোঁজখবর নিয়ে ‘প্রতারক’ চক্রকে গ্রেফতার করেন। সাবেক মন্ত্রী লতিফ বিশ্বাস, এমপি মমিন মন্ডল ছাড়াও চয়ন ইসলামের কাছেও গিয়েছিলেন তারা।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর