শনিবার, ২১ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

ধরাছোঁয়ার বাইরে আইস মাফিয়ারা

তদন্ত সীমাবদ্ধ ক্যারিয়ারে

মুহাম্মদ সেলিম, চট্টগ্রাম

মরণনেশা ক্রিস্টাল মেথ বা আইস পাচারের সময় ক্যারিয়ার (বহনকারী) গ্রেফতার হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছেন মাফিয়ারা। মামলার তদন্ত সীমাবদ্ধ থাকছে ক্যারিয়ারে। জানা গেছে, চট্টগ্রামের সবচেয়ে বেশি ক্রিস্টাল মেথের চালান জব্দ করেছে র‌্যাব-৭। আদালতে চার্জশিটেও এগিয়ে সংস্থাটি। এ বিষয়ে র‌্যাব-৭-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মাহাবুল আলম বলেন, ‘এ পর্যন্ত যতগুলো ক্রিস্টাল মেথের চালান জব্দ করা হয়েছে তার বেশির ভাগ মালিকের অবস্থান মিয়ানমার সীমান্তে। ক্রিস্টাল মেথ বহনকারী (ক্যারিয়ার) ক্রেতা-বিক্রেতার বিষয়ে তথ্য দিতে পারে না। তাই ক্যারিয়ারকে আসামি করে মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়।’ ক্রিস্টাল মেথের একাধিক চালান জব্দ করেছেন মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের চট্টগ্রাম মেট্রো উত্তর অঞ্চলের উপপরিচালক হুমায়ন কবির খোন্দকার।

তিনি বলেন, ক্রিস্টাল মেথের অন্যতম মজুদস্থল কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প। চট্টগ্রাম হয়ে যাওয়া প্রায় সব চালান আসছে সেখান থেকে। ক্যারিয়ারের কাছে মূল হোতা বিষয়ে খুব একটা তথ্য থাকে না। অনেক ক্ষেত্রে ক্যারিয়ার তথ্য দিতে চান না। এ ছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অবস্থান চট্টগ্রাম থেকে বেশ দূরে হওয়ায় হোতা বিষয়ে উপযুক্ত প্রমাণ পাওয়া যায় না। এ তিন কারণে তদন্তসংশ্লিষ্টরা মূল হোতা শনাক্তে ব্যর্থ হন। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে ক্রিস্টাল মেথের সবচেয়ে বেশি জোগান আসে মিয়ানমারের শান স্টেট থেকে। সেখানকার মাদক মাফিয়ারা মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, লাওস, চীন থেকে ক্রিস্টাল মেথের কাঁচামাল সংগ্রহ করে। পরে কারখানায় তৈরি করা হয় ১০ থেকে ১২ ধরনের ক্রিস্টাল মেথ। যার মধ্যে স্বচ্ছ কাচের মতো, মিছরির মতো ধলাকৃতি, স্ফটিক স্বচ্ছ পাথর আকৃতি সাদা, নীলাভ, সামুদ্রিক দানাদার লবণ ও শক্ত বরফের মতো- এ ছয় ধরনের ক্রিস্টাল মেথ আসে বাংলাদেশে। মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এবং আন্তর্জাতিক মাফিয়াদের সহায়তায় নিয়ে আসা হয় বাংলাদেশের সীমান্তে। এখান থেকে কমপক্ষে ৩০ রুটে ঢোকে বাংলাদেশে। অন্যতম রুটগুলো কক্সবাজারের টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, সাবরাং, হ্নীলা, হোয়াক্যং, উখিয়ার বালুখালী, পালংখালী, রাজাপালং বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম। কক্সবাজারের সেন্টমার্টিন হয়ে চট্টগ্রামের মহেশখালী, কর্ণফুলী চ্যানেলে আনোয়ারা, গহিরা, বাঁশখালী, জলদী, পারকির চর, পতেঙ্গা, সীতাকুন্ড ও মিরসরাই। একই রুটে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় এসে মেঘনা নদী পাড়ি দিয়ে বরিশাল, ভোলা, বরগুনা, পিরোজপুর, নোয়াখালীর হাতিয়া, লক্ষ্মীপুর মজু চৌধুরীর ঘাট, চাঁদপুর, মুন্সীগঞ্জ, ষাটনল এবং নারায়ণগঞ্জ হয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে। ক্রিস্টাল মেথের আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করে মিয়ানমারভিত্তিক কয়েকটি সন্ত্রাসী গ্রুপ। তাদের সহযোগী হিসেবে রয়েছে বাংলাদেশের মাদক মাফিয়ারা। যারা দেশের ইয়াবা সাম্রাজ্যও নিয়ন্ত্রণ করে। বাংলাদেশি ছাড়াও রোহিঙ্গাদের একটি অংশ বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে ক্যারিয়ার হিসেবে কাজ করছে। রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে ক্রিস্টাল মেথ বাংলাদেশে প্রবেশের পর কক্সবাজার ও টেকনাফের কয়েকটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পাচার করা হয় বিভিন্ন জায়গায়। এ ছাড়া দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বঙ্গোপসাগরের জেলেদের মাধ্যমে মাছ ধরার ট্রলারে করে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে চালান। বিভিন্ন জায়গায় অর্ধশতাধিক চক্র সক্রিয় রয়েছে। গত কয়েক বছরে বৃহত্তর চট্টগ্রামে ছোটবড় প্রায় ১০০ ক্রিস্টাল মেথের চালান জব্দ করেছেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। যার বেশির ভাগ মামলায় ক্যারিয়ারকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। আড়ালে থেকে গেছে মূলহোতারা।

সর্বশেষ খবর