সোমবার, ২৩ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

বাজিকরের ফাঁদ উড়ছে টাকা

প্রতি ম্যাচেই কোটি কোটি টাকা, সাড়ে ৩ হাজার সাইট বন্ধের পরও থেমে নেই জুয়া হচ্ছে মুদ্রা পাচার

সাখাওয়াত কাওসার

বাজিকরের ফাঁদ উড়ছে টাকা

জয়ের নেশায় মাঠে নামে দুই দল। তবে মাঠের বাইরে থাকছে আরও তিনটি পক্ষ। একপক্ষে থাকে বাজিকর। বাকি দুই পক্ষে থাকে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার সাধারণ মানুষ। মাঠের খেলাকে কেন্দ্র করে বাইরের বাজিকরের ছুড়ে দেওয়া সে খেলায় অংশ নিচ্ছে রাজধানীসহ দেশের নানা প্রান্তের অগণিত মানুষ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু চলমান বিশ্বকাপ ক্রিকেট নয়, বাজিকররা থেমে থাকে না ফুটবল এবং ক্রিকেটের অন্যসব আসরেও। আইপিএল, বিপিএল, ইউরোপ নেশন্স কাপ-উয়েফা, স্পেনিশ লিগ, কোপা আমেরিকা কাপকে কেন্দ্র করে তারা পসরা উন্মুক্ত করে হাতিয়ে নিচ্ছে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ। পাচার করে দিচ্ছে বিদেশে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনলাইন বেটিং সাইটগুলোর অনেকগুলোয় এমনিতেই যে কেউ ঢুকতে পারেন। তবে কোনো কোনো বেটিং সাইটে নিবন্ধন করে ঢুকতে হয়। নিবন্ধন করতে আবার দ্বিগুণ টাকা দিতে হয়। কোনো কোনো সাইটে ডলার দিয়ে প্রবেশ করতে হয়। আবার যে দেশগুলোর সাইট নিজস্ব তাদের টাকা দিয়ে কয়েন ক্রয় করে সাইটগুলোতে প্রবেশ করতে হয়। আর এর লেনদেন হচ্ছে বিকাশ, নগদ, রকেট বা ভিসা, মাস্টারকার্ডে। তবে এ মাধ্যমে লেনদেনে জড়িত থাকে স্থানীয় এজেন্টরা। কোনো বেটিং সাইটে বিট কয়েনের মাধ্যমে কেউ কেউ অংশ নিচ্ছে। জুয়ার পর ওই সব টাকা ক্রেডিট কার্ড, ই-ব্যাংকিং ও হুন্ডির মাধ্যমে পাচার হচ্ছে। পুরান ঢাকা থেকে শুরু করে উত্তরা পর্যন্ত অনলাইনে বাজিতে প্রতিদিন কোটি টাকা লগ্নি হচ্ছে প্রতিটি ম্যাচে। একেকটি ম্যাচকে ঘিরে প্রতিদিন কোটি টাকার বাণিজ্যে নামে মাফিয়ারা। তাদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে মানুষ। ওয়ান এক্স বেট, বেট থ্রি-সিক্সটি-ফাইভ, মোস্ট বেট বিডি, ৯ উইকেটসসহ প্রায় ১০০ সাইটে আইপিএলের জুয়া চলে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সারা দেশের প্রতিটি শ্রেণিপেশার মানুষ অনলাইনে বাজিতে বুঁদ হয়ে থাকে। ফুটপাতের চা দোকানি থেকে শুরু করে সেলুন দোকানদার, হকার, বাড়ির নিরাপত্তা প্রহরী, বিক্রয় কর্মী থেকে শুরু করে ভবঘুরে, বাস-ট্রাকের চালক-হেলপার, সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক, নির্মাণশ্রমিক, গৃহপরিচারিকা, রিকশাচালক ও দিনমজুর শ্রেণির মতো একেবারে নিম্নআয়ের মানুষ এখন দিনের একটা সময় অনলাইনে বাজি ধরতেই ব্যস্ত থাকে। আইপিএল ম্যাচ চলাকালীন সবচেয়ে বেশি জুয়া চলে। ১ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত এই শ্রেণির মানুষ বাজি ধরে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তো রয়েছেই, স্কুলের নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরাও অনলাইনে বাজি ধরতে বেশ পটু। এ ব্যাপারে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে আমি জুয়া, পর্নো এবং পাইরেসি নিয়ে খুব সিরিয়াস। আমাকে কেউ একটি লিংক পাঠালে আমি অ্যাকশন নেইনি এমন ঘটনা ঘটেনি। সাইট বন্ধ করা আমার দায়িত্ব, তবে তা শনাক্ত করে দেওয়ার দায়িত্ব আইন প্রয়োগকারী সংস্থার। তবে আমরা এখন পর্যন্ত বিপুল সংখ্যক অনলাইন জুয়ার সাইট বন্ধ করেছি। কিন্তু জড়িতদের একটা সাইট বন্ধ করে দিলে, তারা একাধিক সাইট খুলে ফেলে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সরকার গত কয়েক বছরে ৩ হাজার ৫০০টিরও বেশি জুয়ার সাইট বন্ধ করেছে। সিআইডি, ডিবি ও র‌্যাবের হাতে ধরা পড়েছে জুয়ার সাইট পরিচালনাকারী শতাধিক ব্যক্তি। তবে প্রতিটি সাইট বন্ধ করার পরপরই এ চক্র ভিপিএন (ভয়েস ওভার প্রটোকল নেটওয়ার্ক) দিয়ে সাইটগুলো আবার সচল করে। পুরান ঢাকার বংশাল, ইসলামপুর, লালবাগ, চকবাজার, লক্ষ্মীবাজার, গেন্ডারিয়া, নারিন্দা এলাকার নিম্ন শ্রেণির পেশাজীবীর মধ্যে আইসিসি ওয়ার্ল্ডকাপকে কেন্দ্র করে বেশির ভাগ সময় অনলাইন জুয়ায় বুঁদ হয়ে থাকে। সদরঘাটের ফুটপাতের একজন চা দোকানি অনলাইনে জুয়া খেলেন। গত সপ্তাহে একটি খেলার বাজি ধরার অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, ওই দিন এক খেলায় দেখলেন বিরাট কোহলি ওভারের অন্তত একটি ছক্কা মারতে পারেন। বাজি ধরলাম ১ হাজার টাকা। কিন্তু ওভারের কোনো বলেই ছক্কা না হওয়ার কারণে বাজিতে হেরে গেলাম। যদি ছক্কা মারতেন, তাহলে আমি ১০ হাজার টাকা পেতাম। কিন্তু হলো না। এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি তো ১ হাজার টাকার বাজি ধরি। মাঝে-মধ্যে লাভ হয়। আবার লসও আছে। লস যখন হয়, তখন আরেকজনের কাছে ধার করে টাকা খাটাই।’ অনলাইন জুয়া প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, অতীতে আমরা অনেকগুলো অভিযান পরিচালনা করেছি। এর সঙ্গে জড়িত অনেকেই গ্রেফতার করা হয়েছে। আবারো কেউ জড়িত থাকলে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।

সর্বশেষ খবর