সোমবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা
মন্তব্য কলাম

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষায় শহীদ পুলিশের আমিরুল পারভেজ

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

১৯৭১ সালে দেশমাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করার জন্য শহীদ হয়েছিলেন ৩০ লাখ বঙ্গ সন্তান। পরবর্তীতে সেই স্বাধীনতার পতাকা উজ্জীবিত রাখার জন্য বিভিন্ন সময়ে বহু দেশপ্রেমিককে জীবন দিতে হয়েছে। সেই তালিকায়ই সর্বশেষে যুক্ত হলো শহীদ আমিরুল ইসলাম পারভেজের নাম। যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর বিরুদ্ধে দন্ডাদেশ দেওয়ার পরে তাকে চাঁদে দেখা গেছে- এ ধরনের অবান্তর কথা বলে বহু পুলিশ সদস্যকে হত্যা করেছিল এ ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর লোকেরা। এ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে বহু পুলিশ, সাংবাদিক এবং মানবাধিকার কর্মীকেও হত্যা করেছিল এ নরপিশাচরা। শহীদ পারভেজের  পিতা বীর মুক্তিযোদ্ধা সেকান্দার আলী মোল্লা যেমন সময়ের ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, যোগ্য পিতার যোগ্য পুত্র পারভেজও তেমনি সময়ের ডাক উপেক্ষা করতে পারেননি। জীবনের ঝুঁকি আছে জেনেও স্বাধীনতাবিরোধী হায়েনাদের প্রতিহত করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের পবিত্র ব্রত নিয়ে। সেই যুদ্ধে তার প্রয়াণ হয়েছে, কিন্তু তিনি পরাজিত হয়েছেন- এটা বলা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষায় যারা প্রাণ দিয়েছেন তারা কখনো পরাস্ত হননি, হবেন না। তার রক্ত বৃথা যাবে না। সেই রক্ত অনুপ্রেরণা দেবে বহুজনকে ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হলে তা দমনের জন্য। তার বাড়িতে শোকের মাতম চলছে অবিরাম। এটাই স্বাভাবিক। মাত্র ৩৪ বছরের এক যুবক। যার কাছ থেকে বাঙালি জাতি অনেক কিছু পেতে পারত, তার প্রয়াণ শুধু পরিবারের জন্যই মহাদুর্যোগ বয়ে আনেনি, এটিকে জাতীয় ক্ষতি হিসেবেই ভাবতে হবে। তার বুদ্ধিদীপ্ত দুটি চোখ দেখে মনে হলো সর্বকালের মহানায়ক উত্তম কুমারের কথা, যার বুদ্ধিদীপ্ত চাহনি কোটি কোটি বাঙালি দর্শকের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছিল। এ যুবকের কাছ থেকে জাতির প্রত্যাশার সীমা ছিল না। কিন্তু আজ তার ৭ বছরের শিশুকন্যা হয়ে গেল পিতৃহীন, তার স্ত্রীকে বরণ করতে হলো বৈধব্য। তারপরও তার শিশুকন্যা বেড়ে উঠবে এক বীরত্বগাথা পিতার গৌরবময় স্মৃতি নিয়ে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয় বলেছেন, সিসিটিভিতে খুনির নৃশংসতার চিত্র ফুটে উঠেছে। গোটা শহর সিসিটিভির আওতায় আনা হয়েছিল বিধায় ভুলের কোনো অবকাশ নেই। প্রকৃত অপরাধীদের সহজেই চিহ্নিত করা সম্ভব। তাছাড়া উসকানিদাতাদের পরিচয় তো সবাই জানেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, খুনি ব্যক্তি বিএনপির ছাত্রদলের এক নেতা। আরও তদন্তে হয়তো জানা যাবে তার দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের পিতার মতো এই খুনি ছাত্রদল নেতার পিতা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এক রাজাকার। সে ব্যক্তির এবং অন্য হুকুমের আসামিদের দ্রুত আদালতে বিচার হবে, সেটাই সব সুস্থ মনের মানুষের প্রত্যাশা। তবে সেই খুনিকে যারা হুকুম দিয়েছিল, যারা এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল তাদেরও বিচার হতে হবে হুকুমের আসামি হিসেবে। পৃথিবীর অন্যান্য সভ্য দেশের মতো আমাদের আইনেও হুকুমের আসামিদের এবং প্ররোচনাকারীদের সাজা অধিক হয়ে থাকে।

’৭১-এর পরাজিত এই অপশক্তি, ধর্মান্ধ, ধর্ম ব্যবসায়ী জামায়াতে ইসলামের সঙ্গে একত্রিত হয়ে বহু দিন ধরেই পরিকল্পনা করছিল ২৮ অক্টোবর একটি মহাপ্রলয় ঘটিয়ে অবৈধ, অসাংবিধানিক পন্থায় মুক্তিযুদ্ধের সরকারের পতন ঘটিয়ে দেশকে আবার পাকিস্তানে পরিণত করার, যেটি করেছিলেন বিএনপি দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান। আমাদের দক্ষ এবং দেশপ্রেমী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং আপামর জনগণ কঠোর অবস্থানে থাকায় এ দস্যুর দল তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য, অর্থাৎ তালেবানি শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করলেও তারা পরিকল্পিত মহাপ্রলয় ঘটাতে পারেনি, বরং তাদেরই মহাপ্রয়াণ ঘটেছে। জনগণের যে অংশের মধ্যে এদের নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল, তাদের কাছে এ বর্বরদের পরিচয় এখন স্পষ্ট হয়ে যাবে। মাননীয় প্রধান বিচারপতির বাসভবন আক্রমণ করে এ অপশক্তি প্রমাণ করেছে তাদের আক্রমণ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, কেননা প্রধান বিচারপতি কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি নন, তিনি একটি প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের একটির প্রধান। ’৭১-এর পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই এরা সমস্ত জীবনের ক্রোধের বশবর্তী হয়ে এসব উন্মাদনা চালিয়েছে। এ নিষ্ঠুরতা দেখলে সম্ভবত চেঙ্গিস, তৈমুর, নাদির শাহর মতো গণহত্যাযজ্ঞের খলনায়করাও লজ্জিত হতেন। খুনিদের এ জিঘাংসাপরায়ণতার একটিই কারণ, যা হলো এই যে শহীদ পারভেজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধরে রাখতে মাঠে নেমেছিলেন, যে চেতনা খুনির দল কখনো সইতে পারছে না।

টেলিভিশনের পর্দায় তাকে হত্যা করার পৈশাচিক ঘটনার কিছুটা দেখে আঁতকে উঠেছেন সব বিবেকসম্পন্ন দর্শক। নির্মমতার চরম প্রকাশ দেখা গেছে এসব হৃদয়হীন মানুষের মধ্যে। দানবতার অর্থে এরা তাদের দীক্ষাগুরু জিয়াউর রহমানের সফল অনুসারী। জিয়ার কাছ থেকেই তারা শিখেছে অভিলাষ আদায়ের জন্য গণহত্যা প্রয়োজন, যা জিয়াউর রহমান নিজে বহুবার করেছিলেন। শহীদ পারভেজ এসব মানুষরূপী অসুরদের প্রাথমিক আক্রমণে ধরাশায়ী হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু তার পরেও জিয়া অনুসারী অমানুষের দল শহীদ পারভেজকে বাঁচতে দেয়নি। তার অস্ত্র কেড়ে নিয়ে ভয়ংকর চাপাতি দিয়ে তার মাথায় উপর্যুপরি আঘাত চালিয়েছিল। শুধু শহীদ পারভেজকেই নয়, এই নরদস্যুদের দল কর্তব্যরত বহু পুলিশকে মারাত্মকভাবে আহত করেছে। জ্বালিয়ে দিয়েছে পুলিশ হাসপাতাল, অ্যাম্বুলেন্স, বহু বাস, ট্রাক, ঠিক যেমনটি তারা করেছিল ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে। সংবাদ সংগ্রহের কাজে দায়িত্বরত বহু সাংবাদিকও এসব রাসেল ভাইপারদের আক্রমণ থেকে রেহাই পাননি। কবিগুরু লিখেছেন, ‘নাগিনীরা চারদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস’। এসব বিষাক্ত নাগিনীরাই দেশকে পাকিস্তানে পরিণত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত। এদের বিষদাঁত অবশ্যই ভাঙতে হবে। ভুক্তভোগীদের কেউই রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় বিধায় এটা ধরে নেওয়াই স্বাভাবিক যে, সন্ত্রাসীদের উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রযন্ত্রসমূহকে ধ্বংস করা। অগ্নিসন্ত্রাস বিএনপি-জামায়াতের যে মজ্জাগত তা বহুবার প্রমাণিত হয়েছে। কানাডার আদালত বিএনপিকে একটি সন্ত্রাসী দল হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। আর আদালতের রায় ক্রমে অবৈধ দল জামায়াতের জঙ্গি ইতিহাস তো বহু পুরনো। ১৯৫২-৫৩ সালে জামায়াত নেতা মওদুদির নেতৃত্বে পাকিস্তানি আহমেদিয়া মুসলমানদের গণহত্যার অপরাধে মওদুদিকে ফাঁসিতে ঝুলানোর আদেশ প্রদান করা হয়েছিল। ১৯৭১-এ এটি দল হিসেবে যুদ্ধাপরাধে সম্পৃক্ত ছিল বলে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালই রায়ে ব্যক্ত করেছেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন বাঙালিদের ওপর যে গণহত্যা চালানো হয়েছিল, জামায়াতি এবং অন্য ধর্মান্ধদের প্রত্যক্ষ সহায়তা এবং ভূমিকা ছাড়া তা সম্ভব হতো না। ’৭১ সালে দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর জামায়াতের নেতা-কর্মীরা দেশ ছেড়ে পালালেও বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়া তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে রাজনৈতিক, আর্থিক এবং সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করলে এবং ক্ষমতায় বসালে এরা নতুন উদ্যমে তাদের তালেবানপন্থি নীতি চালাতে শুরু করে। পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ক্ষমতায় আসার পর এদের ধ্বংসাত্মক এবং জঙ্গি কার্যকলাপ চলতে থাকে। প্রতিটি পূজার সময় তারা মিথ্যা, বানোয়াট সংবাদ সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করে দাঙ্গা পরিস্থিতির সৃষ্টি করে আসছে। এদের সমূলে দমন করার জন্য কঠোরতার বিকল্প নেই বলেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদের দাবি। ২৮ অক্টোবর অপরাধগুলোর জন্য বিএনপি-জামায়াতের অনেকের বিরুদ্ধেই হুকুমের এবং উসকানিমূলক বক্তব্যের জন্য মামলা হওয়া বাঞ্ছনীয়। যেসব ব্যক্তি ২৮ অক্টোবরের পরিকল্পনা করেছিলেন, মাস্তানদের জড়ো হতে বলেছিলেন, উসকানিমূলক ভাষণ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ করার প্ররোচনা দিয়েছিলেন, প্রচলিত আইনে তারা সবাই কৃত অপরাধগুলোর জন্য দায়ী বটে এবং তাই আসামির কাঠগড়ায় তাদেরও হাজির করতে হবে। ২৮ অক্টোবর ছিল সনাতন ধর্মাবলম্বীদের লক্ষ্মী পূজার এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্রবারণা পূর্ণিমার দিবস। উভয় ধর্মের নেতারা বিএনপি-জামায়াতকে অনুরোধ করেছিলেন সেই দিনগুলোতে কোনো কর্মসূচি না দিতে। কিন্তু সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন দল দুটির নেতারা এসব অনুরোধের তোয়াক্কা না করে তাদের ধ্বংসাত্মক কাজ চালিয়ে যায়। অতীতের অভিজ্ঞতা বলছে বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী এ অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা হলেই তাদের বিদেশি প্রভুরা হয়তো মামলা বন্ধের দাবি নিয়ে হাজির হতে পারে। এ ধরনের উদ্ভট দাবি উপেক্ষা করে তাদের কঠোর হাতে দমনের এখনই সময়। কবিগুরু লিখেছেন, ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির, জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী’। গুরুদেবের এই কবিতা আমাদের নির্ভীক জননেত্রী শেখ হাসিনার বেলায় শতভাগ প্রযোজ্য। বিশ্বের বহু প্রভাবশালী নেতার অবান্তর দাবি উপেক্ষা করে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের মামলা এবং শাস্তির ব্যবস্থা করে প্রমাণ করেছেন নীতির প্রশ্নে তিনি আপসহীন এবং কারও অযৌক্তিক চাপের কাছে তিনি মাথানত করেন না। তার পক্ষেই সম্ভব এই দৈত্যদের চিরতরে শায়েস্তা করা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের জনতার এটিই দাবি।

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি

সর্বশেষ খবর