মঙ্গলবার, ৩১ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

সহিংসতায় অনিশ্চয়তা অর্থনীতিতে

উসকে দিচ্ছে ডলার সংকট লাগামহীন দ্রব্যমূল্য

মানিক মুনতাসির

হঠাৎই অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ। এক দিনের হরতালের পর টানা তিন দিন অবরোধের ডাক দিয়েছে বিএনপি। সংকট সমাধানে আওয়ামী লীগ-বিএনপি উভয় দলই অনড় অবস্থানে থাকায় রাজনীতিতে সংকট বাড়ছে। যা মূলত অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা বাড়াচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। হরতাল, অবরোধসহ রাজনৈতিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে আবারও ২০১৪ সালের মতো জ্বালাও পোড়াও সহিংসতা শুরু হয়েছে। যা মূলত দেশের অর্থনীতিকে অপূরণীয় ক্ষতির দিকেই ঠেলে দিচ্ছে। এদিকে সহিংস রাজনৈতিক পরিবেশ উসকে দিচ্ছে চলমান ডলার সংকট। কোনোভাবেই কমছে না মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতির ধারা। লাগামহীন দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি অর্থনীতিতে সৃষ্টি করছে নানা ধরনের অস্বস্তি। ফলে রাজস্ব আদায় ও সামগ্রিক বাজেট বাস্তবায়নেও নেমে এসেছে স্থবিরতা। রাজনৈতিক সংকট দীর্ঘায়িত হলে আর্থিক খাতের সংকট আরও গভীর হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি যে ভালো নেই তার আর নতুন করে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই। আপনি যদি সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলোতে নজর দেন তাহলে দেখবেন প্রায় সবগুলোই নিম্নগামী। এই নিম্নগামিতাকে ঠেকাতে হলে সবার আগে যা প্রয়োজন তা হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। অথচ তার কোনো সম্ভাবনাই তৈরি করতে পারছে না উভয় দল। ফলে এই অনিশ্চয়তা দিন দিন বেড়েই চলছে। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অর্থনীতি ভালো না থাকলে তো দেশের মানুষও ভালো থাকবে না। রাজনৈতিক সংঘাত যেন আর না বাড়ে আমাদের সবার সেদিকেই নজর দেওয়া উচিত। জাতীয় নির্বাচনের আগে যে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে সেটার সমাধান করতে না পারলে ব্যবসা-বাণিজ্য আর অর্থনীতির সঙ্গে দেশটাই পিছিয়ে যাবে বলে তিনি মনে করেন। এদিকে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ প্রায় সবগুলো উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থা রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে উদ্বেগ জানিয়েছে। একই সঙ্গে আইএমএফ বলেছে, চলতি ২০২৩ সালে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে ৬ শতাংশ হতে পারে। তবে মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমে ৭ দশমিক ৯ শতাংশে নামার পূর্বাভাসও দিয়েছে তারা। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বার্ষিক সভায় প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক’ শীর্ষক আইএমএফের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।

এতে বলা হয়, ২০২৪ সালেও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ হবে। তবে ২০২৮ সালে প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে ৭ শতাংশে উন্নীত হবে। আইএমএফ বলছে, সব দেশে যে প্রবৃদ্ধি একই হারে হচ্ছে তা নয়। বিভিন্ন দেশের মধ্যে মত পার্থক্য বাড়ছে। সংস্থাটি আরও জানিয়েছে, এমন পরিস্থিতিতে বিশ্ব অর্থনীতি খুঁড়িয়ে চললেও একেবারে থেমে যায়নি। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যকার যুদ্ধসহ অন্য দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিবেশ অস্থিতিশীল থাকলে সেসব দেশের প্রবৃদ্ধি আরও কমতে পারে বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক। এদিকে সামনের দিনগুলোতেও বাংলাদেশের চলতি হিসাবে ভারসাম্যে ঘাটতি অব্যাহত থাকবে বলে মনে করে আইএমএফ। সংস্থাটি বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে চলতি হিসাবের ঘাটতি জিডিপির শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ হতে পারে। আইএমএফের প্রতিবেদনে বৈশ্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে বলা হয়েছে, করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধিজনিত সংকট থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে বিশ্ব অর্থনীতি। যুদ্ধের প্রভাবে খাদ্য ও জ্বালানি বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীল থাকা অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশের অর্থনীতিতে যে সংকট বিরাজ করছে তা আমরা এড়াতে পারতাম। কিন্তু আমাদের সঠিক পরিকল্পনার অভাব ও ভুল নীতির কারণে এ সংকটকে এড়াতে পারিনি। বিশেষ করে খেলাপি ঋণ কমানোর কোনো কার্যকর উদ্যোগ বাংলাদেশ ব্যাংক নিতে পারেনি। অন্যদিকে আর্থিক খাতের অনিয়ম-দুর্নীতির কোনো বিচার আমরা করতে পারিনি। এখনো দেশের অর্থনীতিকে জোরপূর্বক ভালো রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে- অর্থনীতির রাজনীতিকরণ। এ ছাড়া এরই মধ্যে দেশে আসন্ন সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে নতুন করে সংকট তৈরি হয়েছে। যা মূলত অর্থনৈতিক সংকটকে আরও গভীর করবে বলে তিনি মনে করেন।

 

সর্বশেষ খবর