মঙ্গলবার, ৩১ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

বিএনপি অফিস এখনো বন্ধ আরও মামলা গ্রেফতার

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির সমাবেশ এবং পরদিন হরতালের নানা ঘটনায় বেড়েছে মামলার সংখ্যা। এর সমান্তরালে বেড়েছে গ্রেফতারের সংখ্যা। আগে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গড়ে প্রতিদিন হাজতির সংখ্যা ২২০ থেকে ২৫০ জন হলেও গত কয়েক দিন ধরে তা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। গত রবিবার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) আট থানায় মামলার সংখ্যা ছিল ২৯। তবে গতকাল আরও আটটি মামলা হওয়ায় মোট মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৭টি। অন্যদিকে গতকাল পর্যন্ত বিএনপির প্রধান কার্যালয় বন্ধ ও অবরুদ্ধ ছিল। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটের তত্ত্বাবধানে রয়েছে প্রধান কার্যালয়টি।

সিআইডির নিয়ন্ত্রণে বিএনপির কার্যালয় : ২৮ অক্টোবর পাল্টাপাল্টি সংঘাতের পর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় সিআইডির ‘ক্রাইম সিন’-এর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত সরেজমিন দেখা গেছে, বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে কর্ডন টেপ দিয়ে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। সেখানে নেতা-কর্মীরা কেউ প্রবেশ করতে পারছেন না। সেই সঙ্গে তদন্ত কাজ কবে শেষ হবে বা কবে নাগাদ বিএনপির কার্যালয় খুলে দেওয়া হবে- সে বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেননি পুলিশ কর্মকর্তারা। সরেজমিন দেখা গেছে, বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে চারদিকে ‘ক্রাইম সিন’ লেখা ফিতা টানানো রয়েছে। লেখা আছে, ‘ডু নট ক্রস’। কার্যালয়ের দুই প্রান্তে পুলিশ অস্ত্র হাতে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। কার্যালয়ের কলাপসিবল গেটে ঝুলছে তালা। পুলিশ জানিয়েছে, বিএনপির কার্যালয় এখন সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটের নিয়ন্ত্রণে। এখানে তারা তদন্ত কাজ করছেন। এর বাইরে দেখা গেছে, বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে লাইট পোস্টগুলোতে নতুন করে আরও সিসি ক্যামেরা লাগানো হচ্ছে। সার্বিক বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘২৮ তারিখের মহাসমাবেশে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে কিছু হয়নি। তাহলে কেন সেখানে ক্রাইম সিন দিয়ে ঘেরাও করে রাখা হবে? পুলিশ নিজেই হামলা করল আমাদের নেতা-কর্মীদের ওপর। এখন আবার আমাদের কার্যালয় তারাই ঘেরাও করে রেখেছে। সেখান থেকে তারা ১০ ধরনের আলামত সংগ্রহ করেছে বলে দাবি করেছে। যা অতীতের ন্যায় হাস্যকর ও প্রহসনমূলক।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হচ্ছে। বাড়ি বাড়িতে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। ভাঙচুর করা হচ্ছে। নেতাদের না পেয়ে তাদের পরিবারের সদস্যদের নির্যাতন করা হচ্ছে। অনেক সময় পরিবারের সদস্যদের আটক করা হচ্ছে। অন্যদিকে দলের কার্যালয় পুলিশ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে রেখেছে। এ অবস্থায় স্বাভাবিকভাবে আমাদের দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।’ গতকাল অজ্ঞাত স্থান থেকে অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান রিজভী।

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস্) ড. খ. মহিদ উদ্দিন বলেছেন, অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ঢাকাবাসীর নিরাপত্তা ও জানমালের নিরাপত্তায় পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। আমরা আশা করি, ডিএমপি তার সাধ্যমতো যে নিরাপত্তা পরিকল্পনা নেবে, সব শ্রেণি-পেশার মানুষ সেটির সঙ্গে আমাদের সহযোগিতা করবে। এটা আমরা দৃঢ় বিশ্বাস করি। তার কারণ, প্রতিটি মানুষের নাগরিক অধিকার রয়েছে এবং নাগরিক দায়িত্ব রয়েছে। রাজনৈতিক কর্মসূচি কোনো ধ্বংসাত্মক কাজের অংশ হতে পারে না।

গতকাল নিজ কার্যালয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের তিনি আরও বলেন, ২৮ তারিখ শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশের কথা ছিল। বিএনপিও আমাদের এ কথা বলেছিল। কিন্তু ১০টার পর থেকে মহাসমাবেশের কাকরাইল প্রান্তে যারা ছিল, তারা অসহিষ্ণু ও অসম্ভব আক্রমণাত্মক জায়গায় চলে যায়। যার কারণে অপরাধের মাত্রা ও সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। তবে এটি তাড়াহুড়ো করার কোনো বিষয় নয়। তাড়াহুড়ো করলে ভুল-ত্রুটি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তিনি আরও বলেন, ‘২৮ অক্টোবরের ঘটনায় অনেক সাধারণ মানুষও বাদী হয়ে মামলা করেছেন। বিশেষ করে মতিঝিল থানায় এ ধরনের ১১টি মামলা হয়েছে। পুলিশ যে জায়গায় আহত হয়েছে, সেখানে পুলিশ মামলা করেছে। আরও যদি কেউ মামলা করতে আসে, সে বিষয়গুলো দেখা হবে। দেশের প্রচলিত আইনের বিষয়ে সবাইকে সজাগ থাকার আহ্বান জানাচ্ছি। এ ছাড়া নগরবাসীকে সজাগ থাকার জন্য অনুরোধ জানানো হচ্ছে।’

মহাসমাবেশকেন্দ্রিক ঘটনা নিয়ন্ত্রণে পরিকল্পনার কোনো ভুল ছিল কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে ড. খ. মহিদ উদ্দিন বলেন, ‘মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হওয়া নতুন কিছু নয়। যথার্থই ছিল। শান্তিপূর্ণ যেগুলো হয়েছে সেগুলো ভালোভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সমাবেশ যারা করেছে তারা আগেই ঘোষণা দিয়েছিল সমাবেশ হবে। আমরা ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছি। আমরা কখনো কোনো অনাকাক্সিক্ষত পরিবেশ আশা করি না।’

এদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, গতকাল পর্যন্ত কর্মসূচিতে পুলিশ এবং আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহতের সংখ্যা চারজন, গ্রেফতারকৃত নেতা-কর্মীর সংখ্যা ৬৯০ জন, মোট মিথ্যা মামলার সংখ্যা ২০টি এবং আহত ৩ হাজারের অধিক নেতা-কর্মী। এ ছাড়াও মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে ২৩ অক্টোবর থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত পাঁচ দিনে মোট গ্রেফতার করা হয়েছে ২ হাজার ৬৪০ জনের অধিক নেতা-কর্মী এবং মিথ্যা মামলা হয়েছে ৪৫টি।

নতুন আটটি মামলা : সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সংঘর্ষের ঘটনার বিষয়ে গত রবিবার পর্যন্ত ২৯টি মামলার কথা জানিয়েছিল পুলিশ। গতকাল আরও আটটি মামলার খবর জানা গেছে। মামলার এজাহার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এসব মামলায় বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বেশির ভাগকে আসামি করা হয়েছে। মামলায় বিএনপির শীর্ষ নেতা মির্জা ফখরুল ছাড়া আসামির তালিকায় রয়েছেন- বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, রুহুল কবির রিজভী, আবদুল আউয়াল মিন্টু, বরকতউল্লা বুলু, জয়নুল আবদিন ফারুক, জয়নাল আবেদীন, আহমেদ আজম খান, নিতাই রায় চৌধুরী, শামসুজ্জামান, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, শাহজাহান ওমর, মাহবুব উদ্দিন খোকনসহ অনেকে।

মামলাগুলোয় পুলিশকে হত্যা ও হত্যার উদ্দেশ্যে ককটেল বিস্ফোরণ, সরকারি কাজে বাধা, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, পুলিশের অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়া ইত্যাদি অভিযোগ আনা হয়। মামলার বেশির ভাগের বাদী পুলিশের সদস্যরা। ১১টি মামলার বাদী হয়েছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।

হামলার ঘটনায় সচিবালয়ে গতকাল সকালে নিজ দফতরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, পুরো ঘটনাটি বর্বরোচিত ও জঘন্য। মামলা শুরু হয়েছে। অনেক মামলা হবে। যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তারাও মামলা দেবেন। পুলিশ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মামলা দেবে। পুলিশ মামলা দেবে।

৯ দিনে যত গ্রেফতার : ডিএমপির গণমাধ্যম শাখার উপ-পুলিশ কমিশনার ফারুক হোসেন বলেছেন, ডিএমপির আটটি বিভাগে এখন পর্যন্ত ৩৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলাগুলোতে নাম উল্লেখ করা আসামির সংখ্যা ১৫৪৪ জন, অজ্ঞাতনামা রয়েছে আরও অনেকেই। বিভিন্ন স্থান থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর : সংঘর্ষ, সন্ত্রাস, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, হামলা ইত্যাদির ঘটনায় সিলেটে ৫ মামলায় বিএনপি-জামায়াতের ৫ শতাধিক নেতা-কর্মী, বগুড়ায় ৪ মামলায় ১২৮ জন, নারায়ণগঞ্জে ৪ মামলায় রিজভীসহ ৩০০ জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৯ মামলায় ১০৪২ জন, মাগুরায় এক মামলায় ৩ শতাধিক জন, গাইবান্ধায় এক মামলায় ২৪ জন, শেরপুরে ৫ মামলায় ৩ শতাধিক, কুমিল্লায় এক মামলায় ৩৩০ জনকে আসামি করা হয়েছে।

এ ছাড়া গতকাল গ্রেফতার হয়েছেন বরিশাল মহানগর জামায়াতের আমির জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবর, মাগুরায় যুবদলের সভাপতি ওয়াশিকুর রহমান কল্লোলসহ তিনজন, ঝিনাইদহে ৩১ জন, গাইবান্ধায় ৪ জন, শেরপুরে ৪৫ জন, দিনাজপুরের খানসামায় ৪ জন, সাতক্ষীরায় ৩২ জন, নোয়াখালীতে ৩৭ জন।

সর্বশেষ খবর