বৃহস্পতিবার, ২ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

লাঠিহাতে দিনভর শ্রমিক বিক্ষোভ

বেতন বাড়ানোর দাবি, সড়ক অবরোধ ভাঙচুর অব্যাহত

নিজস্ব প্রতিবেদক

লাঠিহাতে দিনভর শ্রমিক বিক্ষোভ

রাজধানীর মিরপুরে গতকাল লাঠিহাতে পোশাক শ্রমিকদের বিক্ষোভ -বাংলাদেশ প্রতিদিন

বেতন বৃদ্ধির দাবিতে রাজধানীর মিরপুরে দ্বিতীয় দিনের মতো সড়ক অবরোধ অব্যাহত রেখেছেন পোশাক শ্রমিকরা। এ সময় কয়েকটি পোশাক কারখানার ফটক ভাঙচুরও করেন তারা। এ ছাড়া গাজীপুরেও একই দাবিতে শ্রমিক আন্দোলনের নবম দিন গতকাল বিভিন্ন শিল্পকারখানার শ্রমিকরা বিক্ষোভ ও মহাসড়ক অবরোধ করেছেন। গতকাল সকাল থেকেই রাজধানীর মিরপুর ১, ২, ৭, ১০, ১৩ ও ১৪ নম্বর গোল চত্বরে অবস্থান নেন সহস্রাধিক শ্রমিক। এ সময় শ্রমিকরা কয়েকজন গণমাধ্যমকারীকে মারধর করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এমনকি যারাই মোবাইল দিয়ে ছবি তোলা ও ভিডিও করার চেষ্টা করেছেন তাদেরই মারধর করেছেন শ্রমিকরা। ক্ষুব্ধ পোশাক শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তোপের মুখে পড়েন স্থানীয় এমপি ও শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার। একপর্যায়ে আন্দোলনস্থল ত্যাগ করেন তিনি। এতে মঙ্গলবারের মতো গতকালও গোটা মিরপুর এলাকায় যানচলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ। বন্ধ করে দেওয়া হয় সংশ্লিষ্ট এলাকার দোকানপাটও। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গতকাল সকাল ৮টায় লাঠিসোঁটা নিয়ে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন পোশাক শ্রমিকরা। এতে মিরপুর ১০, ১১, ১২ এবং ১ ও ২ নম্বরের আশপাশের এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। শ্রমিকরা রাস্তায় কোনো যানবাহন দেখলেই ঘুরিয়ে দেন। একই সময়ে পল্লবীর পূরবী বাসস্ট্যান্ড থেকে ১২ নম্বর বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত সড়কে কয়েক হাজার শ্রমিক লাঠিসোঁটা নিয়ে অবস্থান নেন। এরপর তারা খন্ড খন্ড মিছিল নিয়ে মিরপুর ১০, ১১, ১২, ১৩ ও ১৪ নম্বরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করেন। এতে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত থমথমে অবস্থা বিরাজ করে পুরো মিরপুরজুড়ে। আন্দোলনরত শ্রমিকরা বলেন, মঙ্গলবার সরকারদলীয় লোকজন আমাদের ওপর হামলা করে। আমাদের ধারণা আওয়ামী লীগের লোকজন আবারও আমাদের ওপর হামলা চালাতে পারে, এ জন্য লাঠিসোঁটা নিয়ে হাজির হয়েছি। আগামী বছর নতুন বেতন কাঠামো অনুযায়ী আমাদের ন্যূনতম বেতন ২৩ হাজার টাকা হওয়ার কথা। এ জন্য চলতি মাসে গ্রেড ঠিক করার কথা ছিল। কিন্তু মালিকপক্ষ গ্রেড পরিবর্তন ও বেতন বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ নেননি। তারা আগের বেতন বহাল রেখেই কারখানা চালাতে চান। মিরপুর এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হাজারো শ্রমিক একত্রিত হয়ে মিরপুরের পল্লবী থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ১০ নম্বর গোল চত্বর ও মিরপুর ২ নম্বর ঘুরে মিরপুর ১ নম্বরে এসে অবস্থান নেন। পরে মিরপুর টেকনিক্যাল মোড়ে গিয়ে তারা আবার বিক্ষোভ মিছিল করে একই পথ ধরে পল্লবী গিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ শেষ করেন। এদিকে শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদারের নেতৃত্বে গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা একটি মিছিল নিয়ে মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বর এলাকা প্রদক্ষিণ করেন। যেখানে আগে থেকেই রাস্তা বন্ধ করে অবস্থান করছিল বেতন বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকরা। এ সময় কামাল আহমেদ মজুমদার কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন। তখন শ্রমিকরা ভুয়া, ভুয়া স্লোগান দিতে শুরু করেন। উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। দ্রুত মিছিল নিয়ে গোল চত্বর এলাকা ত্যাগ করেন শিল্প প্রতিমন্ত্রী। এ ছাড়াও বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা মোবাইল ফোনে ছবি বা ভিডিও করতে দেখলেই হামলা করেছেন। এমনকি গণমাধ্যমকর্মী পরিচয় দেওয়ার পরেও হামলা করেছেন তারা। পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহফুজুর রহমান মিয়া বলেন, সকাল থেকে আবারও গার্মেন্টস শ্রমিকরা সড়কে অবস্থান নিয়েছিল। পরে তাদের বুঝিয়ে সড়ক থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে মিরপুরের বেশ কয়েকটি সড়ক প্রদক্ষিণ করে তারা তাদের কর্মসূচির সমাপ্তি ঘোষণা করেন। আমাদের গাজীপুর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, গতকাল গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বাসন এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ভোগড়া বাইপাস এলাকায় বিক্ষোভ করেন শ্রমিকরা। এ সময় তারা টায়ার জ্বালিয়ে মহাসড়ক অবরোধ করেন। এতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ও ঢাকা বাইপাস (নাওজোর-ভুলতা) সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে আন্দোলনরতদের মহাসড়কের ওপর থেকে সরিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলে শ্রমিকরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। একপর্যায়ে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা স্থানীয় রুয়া ফ্যাশন নামের গার্মেন্টস কারখানায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করতে থাকেন। পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে আন্দোলনরতদের ছত্রভঙ্গ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পরে কারখানা কর্তৃপক্ষ কর্মরত শ্রমিকদের কারখানা থেকে বের করে দিয়ে ছুটি ঘোষণা করে।

এদিকে গাজীপুরের কোনাবাড়ী এলাকায় পোশাক কারখানায় অগ্নিসংযোগ ও এক শ্রমিক নিহতের ঘটনায় মামলা হয়েছে। মঙ্গলবার রাতে কারখানা নিরাপত্তাকর্মী গোলজার হোসেন বাদী হয়ে কোনাবাড়ী থানায় মামলাটি করেন। এতে ৯ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ৭০০ থেকে ৮০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে পুলিশ ৯ জনকে গ্রেফতার করেছে। বুধবার রাতে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) উপ-পুলিশ কমিশনার আবু তোরাব মো. শামছুর রহমান। গ্রেফতারকৃতরা হলেন- গাজীপুরের আমবাগ পূর্বপাড়া এলাকার ভাড়াটিয়া মো. শের আলী (১৯), কোনাবাড়ী এলাকার মো. রিফাত (১৯), আমবাগ এলাকার খোবায়েব (২০), কোনাবাড়ী কুদ্দুসনগর পুকুরপাড়া এলাকার মো. নূর হোসেন (১৮), আমবাগ এলাকার শান্ত তালুকদার (২১), বাইমাইল এলাকার মো. ইয়াসিন (১৯), কোনাবাড়ী এলাকার শহিদুল ইসলাম (২০), হরিনাচালা সেলিমনগর এলাকার মো. তোফায়েল (২২), আমবাগ পূর্বপাড়া এলাকার রহিম বাদশা (২২)।

২৫ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের দাবি : পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা নির্ধারণের দাবি জানিয়েছেন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহের নেতারা। গতকাল এক যৌথ বিবৃতিতে এ দাবি জানান তারা। বিবৃতিতে বলা হয়, ২০১৮ সালে ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার ৩০০ টাকা নির্ধারণ করেছিল সরকার। কিন্তু বর্তমানে উচ্চ পণ্যমূল্যের কারণে এ টাকা দিয়ে সংসার চালানো অসম্ভব।

 শ্রমিকরা বারবার দাবি জানালেও মালিকপক্ষ ও সরকার বিভিন্ন অজুহাতে মজুরি বৃদ্ধি করতে কালক্ষেপণ করছে। শুধু তাই নয়, সর্বশেষ বৈঠকে ন্যূনতম মজুরি ১০ হাজার ৪০০ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব দিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে প্রহসন করেছে মালিকপক্ষ। যৌথ বিবৃতিতে আন্দোলনকালে নিহত শ্রমিকদের আজীবন আয়ের সমান ক্ষতিপূরণ ও আহতদের উপযুক্ত চিকিৎসার দাবি জানানো হয়। প্রতিবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো হলো- বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, বিবর্তন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, গণসংস্কৃতি কেন্দ্র, সংহতি সংস্কৃতি সংসদ, সমাজ অনুশীলন কেন্দ্র, বাংলাদেশ গণশিল্পী সংস্থা, সাংস্কৃতিক ইউনিয়ন, রাজু বিতর্ক অঙ্গন, চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, ভাগ্যকুল পাঠাগার ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, সমগীত সংস্কৃতি প্রাঙ্গণ, প্রগতি লেখক সংঘ, গণসংস্কৃতি পরিষদ, স্বদেশ চিন্তা সংঘ, বাংলাদেশ থিয়েটার, তীরন্দাজ, রণেশ দাশগুপ্ত চলচ্চিত্র সংসদ, এই বাংলায়, ঢাকা ড্রামা, বিজ্ঞান আন্দোলন মঞ্চ, বিবর্তন নাট্যগোষ্ঠী-সিরাজগঞ্জ, বাংলাদেশ মূকাভিনয় ফেডারেশন, ধাবমান সাহিত্য আন্দোলন, থিয়েটার’৫২, সমাজতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবী সংঘ, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পরিষদ ও শহীদ আসাদ পরিষদ।

সর্বশেষ খবর