বৃহস্পতিবার, ২ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা
অবরোধের দ্বিতীয় দিন

আতঙ্কের মধ্যেও থেমে ছিল না জনজীবন

রাজধানীতে ছয় গাড়িতে আগুন, ঝটিকা মিছিল থেকে আটক ১৫

নিজস্ব প্রতিবেদক

আতঙ্কের মধ্যেও থেমে ছিল না জনজীবন

বিএনপির ডাকা অবরোধ কর্মসূচির দ্বিতীয় দিনে গতকাল রাজধানীর মুগদা মেডিকেল সংলগ্ন রাস্তায় বাসে আগুন। সন্দেহভাজন একজনকে আটক করেছে পুলিশ -বাংলাদেশ প্রতিদিন

বিএনপি-জামায়াতের ডাকা দেশব্যাপী তিন দিনের অবরোধের দ্বিতীয় দিনে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া কার্যত সচলই ছিল রাজধানীসহ সারা দেশ। আতঙ্কের কারণে যাত্রীশূন্যতায় দূরপাল্লার গাড়ি না চললেও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার অভ্যন্তরীণ যোগাযোগব্যবস্থা অনেকটা স্বাভাবিকই ছিল। তবে অবরোধকারীরা রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় যাত্রীবাহী বাস এবং পুলিশ বক্সে অগ্নিসংযোগ করেছে। এর মধ্যে রাজধানীতে যাত্রীবাহী বাসে অগ্নিসংযোগকালে একজনকে আটক করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সদস্যরা।

ফায়ার সার্ভিস সূত্র বলছে, মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে গতকাল রাত ৯টা পর্যন্ত দুর্বৃত্তরা ২২টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটিয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীতে ছয়টি, ঢাকা বিভাগে (গাজীপুর, কালিয়াকৈর, সাভার, নারায়ণগঞ্জ) সাতটি, চট্টগ্রাম বিভাগে (সীতাকুন্ড, কর্ণফুলী, রাঙ্গুনিয়া) চারটি, রাজশাহী বিভাগ (বগুড়া, রায়গঞ্জ) চারটি এবং রংপুর বিভাগে (পার্বতীপুর) একটি ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ১১টি বাস, তিনটি কাভার্ডভ্যান, তিনটি ট্রাক, একটি পিকআপ, একটি মোটরসাইকেল, দুটি বাণিজ্যিক পণ্যের শোরুম এবং একটি পুলিশ বক্স পুড়ে গেছে। ডিএমপি সূত্র বলছে, গত ১১ দিনে ২ হাজার ১৯ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গত মঙ্গলবার ভোর থেকে গতকাল ভোর পর্যন্ত সহিংসতার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় রাজধানীর ৫০টি থানায় ১৪১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। 

এদিকে গতকাল সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অবরোধকারীরা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ছয়টি যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেয়। এর মধ্যে রাতে মিরপুর ১২ নম্বরে   বেসরকারি গ্রিন ইউনিভার্সিটির একটি বাসে, সন্ধ্যায় শ্যামলী এলাকায় ‘ওয়েলকাম’ পরিবহনের ও নর্দায় বৈশাখী পরিবহনের বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এর আগে সকাল ১১টায় মুগদা মেডিকেল কলেজের সামনে মিডলাইন পরিবহনের একটি বাসে এবং বিকালে মিরপুরের কাফরুল থানার সামনে তিতাস নামে একটি বাসে আগুন দেওয়া হয়। এ ছাড়া উত্তরা এলাকায় একটি বাসে ও টায়ারে আগুন জ্বেলে সড়ক অবরোধ করা হয়েছে।

ডিএমপির কর্মকর্তারা বলছেন, গাড়িতে আগুন দিয়ে পালানোর সময় সাধারণ জনতার সহযোগিতায় দুজনকে আটক করা হয়েছে। এ ছাড়া অবরোধ চলাকালীন বিভিন্ন এলাকায় হামলা, ভাঙচুর ও সড়ক অবরোধ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি সৃষ্টির অভিযোগে ১৩ জনকে আটক করা হয়।

ডিএমপি সূত্র বলছে, অবরোধ চলাকালীন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় আরও বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য কমবেশি আহত হয়েছেন। অবরোধ চলাকালে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাজধানীর পল্টন, বনানী, যাত্রাবাড়ী, মতিঝিল ও মিরপুর এলাকায় ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।

সড়কে ঝটিকা মিছিল : রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বিএনপির নেতা-কর্মীরা অবরোধের সমর্থনে ঝটিকা মিছিল করেন। গতকাল অবরোধের মধ্যে ঢাকায় যানবাহন চলাচল ছিল কম। সাধারণ মানুষ জরুরি কাজ ছাড়া বাইরে তেমন যাননি। দূরপালার বাস কম ছেড়েছে।

বিএনপির অভিযোগ, সারা দেশে টানা তিন দিনের অবরোধ কর্মসূচির দ্বিতীয় দিনে ঢাকা মহানগর দক্ষিণে থানায় থানায় বিক্ষোভ মিছিল করেছেন মহানগর বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। ঢাকা মহানগর দক্ষিণের বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ড থেকে ৩৬ জনকে আটক করা হয়েছে বলে দলটি জানিয়েছে।

শাহবাগ, রমনা, পল্টন, নিউমার্কেট থানাসহ বিভিন্ন থানায় অবরোধের সমর্থনে মিছিল বের করলে আওয়ামী লীগ ও পুলিশ বিভিন্ন স্থানে হামলা চালালে এতে মহানগর বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের ২০ নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন বলে জানান দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা সাইদুর রহমান মিন্টু।

এ ছাড়া বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট ও গণ অধিকার পরিষদও একই দিনগুলোতে অবরোধ ডেকেছে। জামায়াতে ইসলামী আলাদাভাবে এই তিন দিন অবরোধ কর্মসূচি পালন করছে। অবরোধে সমর্থন দিয়েছে এবি পার্টি। দলগুলো অবরোধের সমর্থনে গতকালও বিক্ষোভ করেছে।

 

এর মধ্যে বিএনপি রাজধানীর রামপুরা, উত্তরা, বনশ্রী, মেরাদিয়া বাজারে ছাত্রদল, রামপুরায় ছাত্রদল, পল্টনে জাতীয়তাবাদী সমমনা দলসহ বিভিন্ন এলাকায় ঝটিকা মিছিল করেছে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতারা।

চার দিনে ৯ জন নিহত, আহত ৩৪৫০, দুই দিনে গ্রেফতার ২৫৬৩-রিজভী  : বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেছেন, ‘গত চার দিনে বিএনপির ৯ জন নিহত এবং আহত হয়েছেন ৩ হাজার ৪৫০ জন। অবরোধ কর্মসূচিতে গত দুই দিনে বিএনপির ২ হাজার ৫৬৩ নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমাদের আন্দোলন জনগণের আন্দোলন। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন। হুমকি দিয়ে, গুলি করে, হত্যা করে, দমন-নিপীড়ন করে এ আন্দোলন দমানো যাবে না। এবার জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেই বিএনপির নেতা-কর্মীরা ঘরে ফিরবে ইনশাআল্লাহ।’ সরকারের পদত্যাগসহ এক দফা দাবিতে অবরোধ কর্মসূচির দ্বিতীয় দিনে সকালে রাজধানীর রামপুরা বিশ্বরোডে অবস্থান নিয়ে বিএনপি ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের পিকেটিংকালে এক সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় বিএনপির স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম, সহ- স্বেচ্ছাসেবকবিষয়ক সম্পাদক আবদুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল, মহানগর বিএনপি নেতা ভিপি শামসুল ইসলাম শামসু, ফয়েজ আহমেদ, যুবদলের দীপু সরকার, রামপুরা থানা বিএনপির হেলাল কবির প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। পরে এক সংবাদ সম্মেলনেও রিজভী আহমেদ বক্তব্য রাখেন। সেখানে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ নানা ধরনের ফন্দি করে আবারও ভোটারবিহীন একতরফা নির্বাচন করতে চায়। তারা রাজনৈতিক সমঝোতা ও সম্প্রীতি এবং অবাধ, অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বিশ্বাসী নয়। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কেউ দাবি করলেই তারা ক্ষুব্ধ ও বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সরকারের প্রশ্রয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মরণঘাতী অভিযানে আরও বেশি হিংস্র হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, গত তিন দিন পুলিশ যা করছে সেটি নজিরবিহীন ঘটনা। আওয়ামী লীগ শুধু বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের আক্রমণ ও জখম করে হতাহত করছে না, খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষদের ন্যায্য দাবির আন্দোলনকেও রক্তাক্ত পন্থায় দমন করছে। বিরোধী দলের আওয়াজকে নিস্তব্ধ করার জন্য নিজেদের মনের মতো করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সাজিয়েছে।  তিনি আরও বলেন, জেলখানায় বিএনপি নেতা-কর্মীদের দুর্দশা এখন চরমে উঠেছে। বিএনপির যেসব নেতা একসময় মন্ত্রী-এমপি ছিলেন তাদেরও ডিভিশন দেওয়া হচ্ছে না। কারাগারের ভিতরে বিএনপি নেতাদের আটকে রাখা হচ্ছে। এমনকি দিনের বেলায়ও তাদের সেলের ভিতরে আটক রাখা হয়। ভয়ংকর হয়রানির মধ্যে বিএনপি নেতারা দিন কাটাচ্ছেন।

মৃত্যু : কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব পৌর শাখার ৭ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সদস্য মো. আশিক মিয়া মঙ্গলবার পুলিশের টিয়ার শেলের আঘাতে গুরুতর আহত হয়ে ভাগলপুরস্থ জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সেদিন রাত ১০টায় মৃত্যুবরণ করেন। তিনি আরও জানান, ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ, ২৯ অক্টোবর বিএনপির শান্তিপূর্ণ হরতাল এবং গত দুই দিনে বিএনপির শান্তিপূর্ণ অবরোধকে কেন্দ্র করে মোট ২ হাজার ৫৬৩ জনের অধিক নেতা-কর্মী গ্রেফতার হয়েছেন।  মোট মামলা দেওয়া হয়েছে ৫৫টিরও বেশি। নিহত হয়েছেন ৯ জন (সাংবাদিক ১ জন)। মোট আহত হয়েছেন ৩ হাজার ৪৫০ জনের অধিক।

এ ছাড়াও মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে গত সাত দিনে মোট গ্রেফতার করা হয়েছে ৪ হাজার ২৮৩ জনের অধিক নেতা-কর্মী এবং মিথ্যা মামলা হয়েছে ৮০টিরও বেশি। এ ছাড়াও গত কয়েক মাসে মোট ১৭টি মামলায় ৯ জনের মৃত্যুদন্ডাদেশ ও প্রায় ১১১ জনের অধিক নেতা-কর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

সর্বশেষ খবর