সোমবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

বিক্ষোভ চলছেই, আরও এক শ্রমিকের মৃত্যু বন্ধ ৬০ কারখানা

মজুরির গেজেট প্রকাশ

প্রতিদিন ডেস্ক

ন্যূনতম বেতন নিয়ে গার্মেন্ট শিল্পে অস্থিরতা কাটেনি। শ্রমিক অসন্তোষের জেরে অনির্দিষ্টকালের বন্ধ ঘোষণার দুই দিন পর গতকাল আশুলিয়ার ৭০টি পোশাক কারখানা খুলে দেওয়া হয়েছে। তবে এখনো বন্ধ রয়েছে ৬০টি। এদিকে প্রায় তিন ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করে রাজধানীর মিরপুর ১০, ১৩ ও পল্লবী এলাকায় বিক্ষোভ করেছেন পোশাক কারখানার কয়েক শ শ্রমিক। তাদের অভিযোগ, সরকার ৫৬ শতাংশ বেতন বাড়ানোর ঘোষণা দিলেও সেটি বাস্তবায়ন হয়নি। যারা অভিজ্ঞ শ্রমিক তাদের বেতন বেড়েছে ২০-৩০ শতাংশ। এ           কারণে তারা আবারও বিক্ষোভ করছেন। এ ছাড়া গাজীপুরে শ্রমিক বিক্ষোভের সময় আহত শ্রমিক জালাল উদ্দিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা মেডিকেলে মারা গেছেন। নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য। সাভার (ঢাকা) : সাড়ে ১২ হাজার টাকা বেতন কাঠামো প্রত্যাখ্যানের পর শ্রমিক অসন্তোষের জেরে অনির্দিষ্টকাল বন্ধ ঘোষণার দুই দিন পরই আশুলিয়ার ৭০টি পোশাক কারখানা খুলে দেওয়া হয়েছে। এসব কারখানা রবিবার থেকে সকালে খুলে দেওয়া হলেও এখনো বন্ধ রয়েছে ৬০টি। কারখানা খুললেও বেশিরভাগ শ্রমিক কাজে যোগ না দেওয়ায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। বন্ধ থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রমিকদের তৃতীয় দিনের মতো কাজে যোগ দিতে এসে ফিরে যেতে দেখা গেছে। সরেজমিন দেখা গেছে, আশুলিয়ার জামগড়া, বেরণ, ছয়তলা ও নরসিংহপুর এলাকার বেশিরভাগ কারখানা বন্ধ রয়েছে। এগুলোর ফটকের সামনে ঝোলানো রয়েছে বন্ধের নোটিস। শ্রমিকরা কাজে যোগ দিতে এসে দীর্ঘ সময় কারখানার সামনে অপেক্ষা করে ফিরে যান। অনেকে কারখানার ফটকের সামনে থেকে বন্ধের নোটিসের ছবি তুলে তা সহকর্মীদের কাছে পাঠান। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি ও র‌্যাব সদস্যরা সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। আশুলিয়ার ১৩০টি পোশাক কারখানা ১০ নভেম্বর থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি জানিয়ে কারখানাগুলোর সামনে টানানো হয়েছে নোটিস। নোটিসে বলা হয়, ৯ নভেম্বর ও তার আগের কয়েক দিন ধরে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে বহিরাগত পোশাক শ্রমিকদের বেআইনিভাবে কারখানার ভিতর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে কারখানা ভাঙচুর ও কারখানার কাজ বন্ধ রাখাসহ কর্মস্থলে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করায় কারখানার উৎপাদন কাজ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। এমতাবস্থায় কারখানা কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে ১০ নভেম্বর থেকে বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ এর ১৩ (১) ধারা মোতাবেক কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। আশুলিয়ায় ১২ মামলায় প্রায় ৪ হাজার আসামি বেরণ এলাকার এনভয় গ্রুপের মানাটা গার্মেন্টসের এক শ্রমিক স্পানিশ বলেন, শনিবার কারখানার সামনে এসে বন্ধের নোটিস দেখে বাসায় ফিরে গেছি। আজও (রবিবার) এসে দেখি কারখানা বন্ধ। কবে খুলবে তাও জানি না। সারা দিন কাজ করার অভ্যাস। তাই বাসায় বসে থাকতেও ভালো লাগে না। আশুলিয়া শিল্প পুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ সারোয়ার আলম বলেন, বন্ধ ঘোষণা করা ১৩০টি পোশাক কারখানার মধ্যে শতাধিক আশুলিয়ায় অবস্থিত। রবিবার থেকে ৬০টি খুললেও আশুলিয়ার বেশিরভাগ কারখানা বন্ধ রয়েছে। এদিকে আশুলিয়ায় কারখানা ভাঙচুরের ঘটনায় আশুলিয়া থানায় পৃথক ১২টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ২১০ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত পরিচয় প্রায় ৪ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। গতকাল সকালে এই মামলায় আবু সালেক নামে আরেকজনসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সাভার সার্কেল)  শাহিদুল ইসলাম বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত কারখানা কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত ১২টি মামলা করেছে। এসব মামলায় ২১০ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা ৪ হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

গাজীপুর : গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কোনাবাড়ীর জরুন এলাকায় শ্রমিক বিক্ষোভের ঘটনায় জালাল উদ্দিন নামে আহত শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে তার মৃত্যু হয়। লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেলের মর্গে রাখা হয়েছে। মো. জালাল উদ্দিন (৪০) নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার বামহাটি গ্রামের মো. চান মিয়ার ছেলে। তিনি জরুন এলাকার ইসলাম গ্রুপের সুইং সুপারভাইজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। জালাল উদ্দিন সপরিবারে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের জরুন এলাকার ফজল মোল্লার বাড়িতে ভাড়া থেকে ওই কারখানায় কাজ করতেন। নিহতের সহকর্মী সফিকুল ইসলাম জানান, গত বুধবার গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কোনাবাড়ী জরুন এলাকায় ইসলাম গ্রুপের তিনটি কারখানার শ্রমিকরা বেতন বাড়ানোর দাবিতে বিক্ষোভ ও ভাঙচুর শুরু করেন। পরে পুলিশ তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে শ্রমিকরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। পরে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট ছোড়ে। এতে শ্রমিকরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ওই ঘটনায় কয়েকজন শ্রমিক আহত হন। আহতদের মধ্যে দুজনকে মুমূর্ষু অবস্থায় ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওইদিনই মোসা. আঞ্জুয়ারা খাতুন (২২) নামে এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়। একই ঘটনায় আহত জালাল উদ্দিন ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ছিলেন। এদিকে, গাজীপুরে কারখানা ভাঙচুর ও হামলার ঘটনায় মামলা করা হয়েছে। শনিবার দিবাগত রাতে গাজীপুরের কোনাবাড়ী এলাকার তুসুকা গ্রুপের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবু সাঈদ বাদী হয়ে কোনাবাড়ী থানায় শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় ২৪ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও ১০০/২০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ বিষয়ে শিল্প পুলিশের ডিআইজি মো. জাকির হোসেন খান শনিবার জানিয়েছিলেন, গাজীপুরে আন্দোলনকালে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে ১২৩টি কারখানায় ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালিয়েছে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা। ওই ঘটনায় বিভিন্ন থানায় ২২টি মামলায় এ পর্যন্ত ৮৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদিকে, বিভিন্ন দাবিতে সড়ক অবরোধ করে রাজধানীর মিরপুর ১০, ১৩ ও পল্লবী এলাকার বিক্ষোভ করেছেন পোশাক কারখানার কয়েক শ শ্রমিক। গতকাল সকাল ৮টা থেকে শ্রমিকেরা মিরপুর ১৩ নম্বর সড়কের দুই পাশে অবস্থান করে বিক্ষোভ শুরু করেন। এক পর্যায়ে শ্রমিকরা মিরপুর-১০ নম্বরে গিয়ে অবস্থান নেওয়ার পর তিন ঘণ্টা পর রাস্তা থেকে চলে যান। ঢাকা মহানগর পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) জসীম উদ্দীন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পোশাক কারখানার শ্রমিকরা সকাল ৮টার দিকে মিরপুর-১৩ এলাকার সড়ক অবরোধ করলেও পরে তারা মিরপুর-১০ নম্বর এলাকায় চলে যান। তারা শান্তিপূর্ণভাবে রাস্তায় অবরোধ করেন। পরে তারা বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাস্তা ছেড়ে চলে যান। সরেজমিন দেখা গেছে, পোশাক শ্রমিকদের অবরোধের ফলে প্রধান সড়কসহ আশপাশের সড়কে যানজট দেখা দেয়। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে শ্রমিকেরা মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বর এলাকায় অবস্থান নেন। পল্লবী এলাকায়ও পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা সড়কে নামেন। বিক্ষোভে অংশ নেওয়া শ্রমিকরা বেশির ভাগ মিরপুরের আশপাশের ১০টি গার্মেন্টে কর্মরত। বিক্ষোভরত শ্রমিকরা বলছিলেন, ন্যূনতম বেতন বাড়ানোর ঘোষণায় তারা সন্তুষ্ট নন। গতকাল (রবিবার) কারখানায় কাজে যোগ দিতে গিয়ে দেখেন, সবার বেতন সমান হারে বাড়েনি। সরকার ৫৬ শতাংশ বেতন বাড়ানোর ঘোষণা দিলেও সেটি বাস্তবায়ন হয়নি। তবে যারা অভিজ্ঞ শ্রমিক তাদের বেতন বেড়েছে ২০-৩০ শতাংশ। এ কারণে তারা আবারও বিক্ষোভ করছেন। জানা গেছে, মজুরি বাড়ানোর দাবিতে গত ২৩ অক্টোবর থেকে শ্রমিকদের শুরু করা আন্দোলনের মধ্যে গত মঙ্গলবার পোশাক খাতের জন্য সরকার গঠিত মজুরি বোর্ড ১২ হাজার ৫০০ টাকা ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করে। তবে নতুন বেতনকাঠামো প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন শ্রমিকেরা। তারা ন্যূনতম মজুরি ২৩ থেকে ২৫ হাজার টাকা করার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। কিন্তু মালিকপক্ষের দেওয়া ১২ হাজার ৫০০ টাকার প্রস্তাবই চূড়ান্ত করে শ্রম মন্ত্রণালয়। পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ঘিরে সহিংস বিক্ষোভের ঘটনায় ঢাকার অদূরে সাভার ও ধামরাইয়ে ১৩০টি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত বন্ধ কারখানা না খোলার ইঙ্গিত দিয়েছে তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। গাজীপুরে শ্রমিক বিক্ষোভ-ভাঙচুরের ঘটনায় এ পর্যন্ত ২২ মামলায় আসামি করা হয়েছে অজ্ঞাতনামা অন্তত ১৫ হাজার জনকে।

মজুরির গেজেট প্রকাশ : তৈরি পোশাক শ্রমিকদের ১২ হাজার ৫০০ টাকা নিম্নতম মজুরি খসড়া সুপারিশ করে গেজেট প্রকাশ করেছে মজুরি বোর্ড। গতকাল নিম্নতম মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী মোল্লা স্বাক্ষরিত এ গেজেট প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশিত গার্মেন্টস শিল্প সেক্টরে নিযুক্ত সব শ্রেণির শ্রমিক-কর্মচারীদের নিম্নতম মজুরি হারের খসড়া সুপারিশের ওপর যদি কারও কোনো আপত্তি বা সুপারিশ থাকে তাহলে সেটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের ১৪ দিনের মধ্যে লিখিতভাবে নিম্নতম মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান বরাবর পাঠাতে হবে। সময়সীমার মধ্যে কারও আপত্তি বা সুপারিশ থাকলে সেটি বিবেচনার পর বোর্ড সরকারের কাছে এটিকে কার্যকর করার জন্য সুপারিশ পেশ করবে। এর আগে গত মঙ্গলবার (৭ নভেম্বর) বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে মন্ত্রণালয়ে ব্রিফিংকালে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান তৈরি পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ১২ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করার কথা জানান। শ্রমিকদের ৭টি গ্রেড থাকলেও এবার পাঁচটি করা হয়েছে। এর মধ্যে গ্রেড-৫ এর মূল বেতন ৬ হাজার ৭০০ টাকা অন্যান্যসহ মোট বেতন ১২ হাজার ৫০০ টাকা, গ্রেড-৪ এর মূল বেতন ৭ হাজার ৫০ টাকা অন্যান্যসহ মোট বেতন ১৩ হাজার ২৫ টাকা, গ্রেড-৩ এর মূল বেতন ৭ হাজার ৪০০ টাকা অন্যান্যসহ মোট বেতন ১৩ হাজার ৫৫০ টাকা, গ্রেড-২ এর মূল বেতন ৭ হাজার ৮০০ টাকা অন্যান্যসহ মোট বেতন ১৪ হাজার ১৫০ টাকা, গ্রেড-১ এর মূল বেতন ৮ হাজার ২০০ টাকা অন্যান্যসহ মোট বেতন ১৪ হাজার ৭৫০ টাকা।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর