সোমবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

সিলেটে মিলল তেলের খনি

দিনে আসতে পারে ৫০০ থেকে ৬০০ ব্যারেল

নিজস্ব প্রতিবেদক

সিলেটে মিলল তেলের খনি

বাংলাদেশের ভূগর্ভে ৩৭ বছর পর আবারও জ্বালানি তেলের সন্ধান মিলেছে। দেশে সবশেষ ১৯৮৬ সালে সিলেটের হরিপুরে তেলের সন্ধান মিলেছিল। সেখান থেকে পাঁচ বছর তেল উত্তোলন হয়। এরপর প্রায়ই ছোট-বড় গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান মিললেও দেশে তেলের অস্তিত্ব আর পাওয়া যায়নি। এবার তিন দশকেরও বেশি সময় পর সিলেট গ্যাসক্ষেত্রের ১০ নম্বর কূপে (অনুসন্ধান কূপ) গ্যাসের পাশাপাশি জ্বালানি তেলের সন্ধান পাওয়া গেছে। সেখানে সেলফ প্রেসারে প্রতি ঘণ্টায় ৩৫ ব্যারেল তেলের প্রবাহ পাওয়া গেছে। পরীক্ষা শেষ হলে তেলের মজুদ জানা যাবে। তবে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, তেলের মজুদ প্রায় ৮ থেকে ১০ মিলিয়ন ব্যারেল, যার মূল্য প্রতি লিটার ৫৬ টাকা হিসেবে ৭ হাজার কোটি টাকা। আর এখান থেকে দৈনিক ৫০০ থেকে ৬০০ ব্যারেল হারে তেল পাওয়া যাবে বলেও জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। বিজয়ের মাসে তেলের খনির সন্ধান পাওয়ার বিষয়টিকে সবার জন্য ‘বিরাট সুখবর’ বলেও উল্লেখ করেন তিনি। গতকাল সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী এ ঘোষণা দেন। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন,      বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রাপ্ত তথ্য থেকে ধারণা করা হচ্ছে, সিলেটের অনুসন্ধান কূপে জ্বালানি তেলের খনি পাওয়ার বিষয়টি ঠিক আছে। কারণ সাধারণত ব্র্যান্ট ত্রুুডের এপিআই গ্রাভিটি (একটি পরিমাপ যে একটি পেট্রোলিয়াম তরল জলের তুলনায় কতটা ভারী বা হালকা) ৩০ ডিগ্রির বেশি। আর এই খনির এপিআই গ্রাভিটি ২৯ দশমিক ৭ ডিগ্রি। যা ব্র্যান্ট ত্রুুডের এপিআই গ্রাভিটির কাছাকাছি। তারা তেলের এ খনি পাওয়ার বিষয়টি দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক বলে মনে করছেন। কারণ এই কূপ থেকে যে পরিমাণ তেল পাওয়া যাবে তা যদি পরিশোধন করে ব্যবহার করতে পারি তাহলে জ্বালানি তেল আমদানিতে সরকারের যে অর্থ ব্যয় হয় তা কমে আসবে। কারণ বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)-এর তথ্যে, বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৬৫ লাখ টন জ্বালানি তেলের চাহিদা আছে এবং মোট চাহিদার ৯০ শতাংশই আমদানি করা হয়।

বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী জানান, সিলেট তামাবিল-জাফলং মহাসড়কের পাশে গোয়াইনঘাট উপজেলার আলীরগাঁও ইউনিয়নের বাঘের সড়ক এলাকায় অবস্থিত এ অনুসন্ধান কূপে দুই মাস আগে খনন কাজ শুরু করে সরকারি প্রতিষ্ঠান সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড কোম্পানি। গত ১৪ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কূপটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। তিনি আরও  জানান, সিলেট-১০ নম্বর গ্যাসকূপে ২ হাজার ৫৭৬ মিটার গভীরতায় খনন সম্পন্ন হয়েছে। কূপটিতে তিনটি স্তরে গ্যাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে নিচের স্তরটি ২ হাজার ৫৪০ থেকে ২ হাজার ৫৫০ মিটার পর্যন্ত পরীক্ষা করে ২৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের প্রবাহ পাওয়া গেছে। যার ফ্লোয়িং প্রেসার ৩ হাজার ২৫০ পিএসআই। গ্যাসের মজুদের পরিমাণ ৪৩ থেকে ১০০ বিলিয়ন ঘনফুট। এ ছাড়া ২ হাজার ৪৬০ থেকে ২ হাজার ৪৭৫ মিটার গভীরে আরও একটি ভালো গ্যাস স্তর পাওয়া গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এখানে পরীক্ষা করলে ২৫ থেকে ৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাবে বলে আমরা আশা করছি। আর ২ হাজার ২৯০ থেকে ২ হাজার ৩১০ মিটার গভীরেও গ্যাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়।

গ্যাস ছাড়াও ওপরের দিকে ১ হাজার ৩৯৭ থেকে ১ হাজার ৪৪৫ মিটার গভীরতায় আরও একটি জোন পাওয়া গেছে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, যেখানে গত ৮ ডিসেম্বর পরীক্ষা করে তেলের উপস্থিতি পাওয়া যায়, যার প্রাথমিকভাবে এপিআই গ্রাভিটি ২৯ দশমিক ৭ ডিগ্রি। একযোগে উৎপাদন করা হলে এ কূপটি প্রায় ৮ থেকে ১০ বছর সাসটেইন করবে উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, যদি ২০ মিলিয়ন ঘনফুট হারে উৎপাদন করা হয়, তাহলে কূপটি ১৫ বছরেরও বেশি সময় সাসটেইন করবে।’

এর আগে ১৯৮৬ সালে হরিপুরে তেলের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘সেই কূপটির স্থায়িত্ব ছিল পাঁচ বছর। সেখানে পাওয়া গিয়েছিল এপিআই গ্রাভিটি ২৭ ডিগ্রি। এবার যে তেলের মজুদ পাওয়া যাচ্ছে সে তেল পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। এর এপিআই গ্রাভিটি ২৯ দশমিক ৭ ডিগ্রি।’ প্রথম দিনে দুই ঘণ্টায় ৭০ ব্যারেলের মতো তেল উত্তোলন করা হয়েছে উল্লেখ করে নসরুল হামিদ বলেন, ‘তেল উত্তোলন আমরা আপাতত বন্ধ রেখেছি। এটা আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে, মোট মজুদের পরিমাণটা আমরা জানতে পারব। পুরো বিষয়টি বিস্তারিত জানতে আরও চার থেকে পাঁচ মাস সময় লাগবে। আরও বিস্তারিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য তেল ইস্টার্ন রিফাইনারি লি., বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এবং সিলেট গ্যাসফিল্ডে পাঠানো হয়েছে।’

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ম. তামিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশে বড় ধরনের তেল খনি পাওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে সিলেট গ্যাসক্ষেত্রের ১০ নম্বর অনুসন্ধান কূপে তেল পাওয়ার বিষয়টি ইতিবাচক। এ কূপ থেকে যে পরিমাণ তেল পাওয়া যাবে তা যদি পরিশোধন করে ক্রুড অয়েল হিসেবে আমরা ব্যবহার করতে পারি তাহলে জ্বালানি তেল আমদানিতে সরকারের যে অর্থ ব্যয় হয় তা কমে আসবে। তবে তেল খনিটি থেকে কী পরিমাণ তেল পাওয়া যাবে বা মজুদ কত এসব বিষয়ে এখনই মন্তব্য করা যাবে না। এ জন্য আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন বলে এ অধ্যাপক মনে করেন।

বুয়েট-এর পেট্রোলিয়াম অ্যান্ড মিনারেল রিসোর্সেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, উৎপাদনে আনার জন্য এ খনিতে আরও যথেষ্ট পরিমাণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন আছে। আপাত দৃষ্টিতে যে নমুনার ওপর ভিত্তি করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় তেলের খনি পাওয়ার বিষয়টি ঘোষণা করেছে সেটি ঠিক আছে। তেল পাওয়ার ক্ষেত্রে এবারের কূপটির এপিআই গ্রাভিটি ২৯ দশমিক ৭ ডিগ্রি, যা আদর্শ মান। সাধারণত ব্র্যান্ট ক্রুডের এপিআই গ্রাভিটি ৩০ ডিগ্রির বেশি। এই রেঞ্জের মধ্যেই তেল পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আপাতত সিলেটের প্রাপ্ত পদার্থকে তেলই বলা যাবে। কিন্তু এই কূপ থেকে কী হারে তেল উৎপাদন করা যাবে এবং সেখানে কী পরিমাণ তেল মজুদ আছে এটি জানার জন্য আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। এখনই খুব বেশি নিশ্চিয়তা দিয়ে বলা যাবে না। তবে এ কূপ থেকে তেল পাওয়া গেলে নিজেদের জ্বালানি তেলের চাহিদা মেটাতে এটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন পর জ্বালানি তেলের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে এটি অবশ্যই আমাদের জন্য ভালো খবর। তবে দেশের রিফাইনারিগুলো এই ক্রুড তেল পরিশোধন করতে পারে কি না আমাদের সেটিও দেখতে হবে। একবার তেলের উৎপাদন শুরু করলে তা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। এ জন্য এ খনির স্থায়িত্ব কতটুকু, সেটিও পরীক্ষা করে দেখতে হবে।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের দেশে হরিপুরে আগেও তেল পাওয়া গিয়েছিল। সেটি প্রায় চার থেকে পাঁচ বছর উৎপাদনে ছিল। এটি ছিল ছোট তেলের খনি। বড় আকারে দেশে কখনো তেলের খনি পাওয়া যায়নি এবং উৎপাদনও হয়নি। এ তেলখনি থেকে হয়তো আগেরটির থেকে বেশি পরিমাণে তেল উৎপাদন করা যাবে। তবে এটিও ছোট ক্ষেত্র হবে বলে ধারণা করছি। কিন্তু এটি আমাদের জন্য ইতিবাচক বিষয় যে, দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলোয় মাঝে মাঝে তেল পাওয়া যাচ্ছে। যথেষ্ট পরিমাণে কূপ খনন করা হলে তেলের প্রাপ্তি আরও বেশি হবে।

সর্বশেষ খবর