শনিবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা
বিজয়ের ৫২ বছর

বাংলাদেশ এখন বিশ্বে ফ্যাক্টর

বিস্ময়কর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে পরাশক্তিগুলোর কাছে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ

জুলকার নাইন ও শাহেদ আলী ইরশাদ

বিজয়ের ৫২ বছরে এসে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান আজ সামনের কাতারে। অর্থনীতি ও সামাজিক উন্নয়নের যে কোনো সূচকের বিচারে এই সময়ে বাংলাদেশের উত্থান হয়েছে বিস্ময়কর। সীমিত সম্পদ নিয়ে কমপক্ষে ২০ খাতে বিশ্বের দরবারে গৌরবোজ্জ্বল ও ঈর্ষণীয় অবস্থান তৈরি করেছে। এসব খাতে বাংলাদেশ আছে বিশ্বের শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায়। বাংলাদেশ বদলে গেছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রায় সব ক্ষেত্রেই। আর মানবিক মর্যাদায় বাংলাদেশ ছাড়িয়ে গেছে পুরো বিশ্বকেই। ১০ লাখ নির্যাতিত মানুষকে একসঙ্গে আশ্রয় দিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছে বিশ্ববাসীকে। বিস্ময়কর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান বাজার ও ভূরাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর কাছেও ফ্যাক্টর।

তারা মনে করছে, বাংলাদেশ এখন উদীয়মান বৈশ্বিক শক্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমিনের মতে, ১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন কেউই বাংলাদেশকে চায়নি। এখন দুই দেশই বাংলাদেশকে কাছে টানছে। এর মানে আমরা ১৯৭০-এর পরিস্থিতিতে নেই। অন্য দেশগুলোর বাংলাদেশকে প্রয়োজন। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশ এখন কেন্দ্র। বাংলাদেশে কোনো সমস্যা হলে পুরো অঞ্চলের জন্য সমস্যা হয়। অর্থনীতি-বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বাধীন বাংলাদেশের বাজেটের আকার ছিল মাত্র ৭০১ কোটি টাকা। ৫২ বছরে বাজেটের আকার ৭৩ গুণ বেড়ে ৫ লাখ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। বিপুল পরিমাণ প্রবাসী আয়, তৈরি পোশাক খাতের ৪০ লাখের বেশি শ্রমিক এবং কৃষির সবুজ বিপ্লব দারিদ্র্য কমিয়ে গ্রামীণ ও প্রান্তিক মানুষের জীবনযাত্রার উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে। এর মধ্যে কাক্সিক্ষত উন্নয়নের জন্য নেওয়া ‘ডেল্টা প্ল্যান’ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ শুরু হলে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তখন মানুষের মাথাপিছু আয় হবে প্রায় ১০ হাজার ৪০০ মার্কিন ডলার। ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবে বাংলাদেশ।

হংকং সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশন-এইচএসবিসির সর্বশেষ গ্লোবাল রিসার্চে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) নিরিখে বিশ্বের ২৬তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান ৪২তম। ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইন ২০৩০ : আওয়ার লং-টার্ম প্রজেকশন্স ফর ৭৫ কান্ট্রিজ’ শিরোনামের এ রিপোর্টে দেখানো হয়েছে, ২০১৮ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে অবস্থানের দিক থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি ১৬ ধাপে উন্নীত হবে; যা অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় অধিক। অর্থনৈতিক উন্নয়নের এ তালিকায় বাংলাদেশের পরই ফিলিপাইন, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম ও মালয়েশিয়ার নাম এসেছে। প্রবৃদ্ধি অর্জনের দিক থেকে উন্নত দেশ নরওয়ের চেয়েও বাংলাদেশের অধিক সম্ভাবনা রয়েছে বলে এ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এর সবই সম্ভব হয়েছে সরকারের দূরদর্শী ও কার্যকর অর্থনৈতিক পদক্ষেপের ফলে। এইচএসবিসির দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন মডেলে দেখানো হয়েছে, ২০৩০ পর্যন্ত প্রতি বছর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গড়ে ৭.১ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে, যা রিপোর্টে উল্লিখিত ৭৫ দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। বাংলাদেশে ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ৭.৩, ২০২৩ থেকে ২০২৮ সালের মধ্যে ৭.০ এবং ২০২৮ থেকে ২০৩৩ সালের মধ্যে ৭.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে বলেও আশা করা হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে বর্তমান বাংলাদেশের ৩০০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি ২০৩০ সালে পৌঁছে যাবে ৭০০ বিলিয়ন ডলারে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৩২ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের বড় ২৫টি অর্থনীতির দেশের একটি হবে। তখন বাংলাদেশ হবে ২৪তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। বর্তমানে অবস্থান ৪১তম। ২০৩৩ সালে বাংলাদেশের পেছনে থাকবে মালয়েশিয়া, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশ। আগামী ১৫ বছর দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি গড়ে ৭ শতাংশ থাকবে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লিগ টেবিল ২০১৯ শীর্ষক এ প্রতিবেদনে ১৯৩ দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার উল্লেখ আছে।

কারণ বিগত বছরে দেশে ৩৫০ কোটি ডলারের বেশি সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। এ ছাড়া সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, সৌদি আরবের মতো দেশগুলোও বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে বর্তমান বৈশ্বিক কূটনীতিতে সবচেয়ে বেশি চর্চিত ইন্দো-প্যাসিফিক নীতিতে বাংলাদেশ হয়ে দাঁড়িয়েছে ফ্যাক্টর। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ সবার ইন্দো-প্যাসিফিক পরিকল্পনাতেই গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আছে। বিশ্বরাজনীতিতে প্রতিযোগী শক্তিগুলোর চাপের মধ্যেও বাংলাদেশ নিরপেক্ষ থাকতে চাচ্ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, কৌশলগত কারণে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাংলাদেশ পুরো বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

এ অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং কূটনৈতিক সম্পর্কের শক্তিশালী বন্ধন রয়েছে। পৃথিবীর দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে আর্থসামাজিক অগ্রগতি, দারিদ্র্য দূরীকরণ, নারীর ক্ষমতায়ন, রূপান্তর উপযোগী জ্বালানি এবং আধুনিক অবকাঠামোর সমন্বয়ে বাংলাদেশ উপকূলীয় অঞ্চলের উন্নয়নের মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতি, ভূ-কৌশলগত অবস্থানের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। আমাদের মনোযোগী ভূমিকা এবং দায়িত্বশীলতার কারণে এ অঞ্চলের দেশগুলোর অন্তর্ভুক্তিমূলক সহযোগিতা আকর্ষণ করতে পেরেছি।’

সর্বশেষ খবর