শিরোনাম
শনিবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

শতাধিক আসনে নিরাপত্তা উদ্বেগ

সহিংসতার শঙ্কায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী

সাখাওয়াত কাওসার

শতাধিক সংসদীয় আসনে নির্বাচনি নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগে আছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। দলীয় প্রতীকের বিপরীতে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিয়েই যত টেনশন তাদের। এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ এবং উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় দেশের বিভিন্ন প্রান্তের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের উদ্বেগের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সামনের দিনগুলোতে এসব নির্বাচনি আসনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা করছেন খোদ গোয়েন্দারা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্বাচনে অংশ না নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মী-সমর্থকদের একটি অংশ এবং দেশি-বিদেশি কিছু অপশক্তি এসবের সুযোগ নিতে পারেন। রীতিমতো আগুনে ঘি ঢালার মতো অবস্থা হতে পারে।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচন পূর্ববর্তী সময়ে সম্ভাব্য অপ্রীতিকর ঘটনাগুলো দক্ষ হাতে মোকাবিলা করে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে স্থানীয় প্রশাসনকে। নইলে এর রেশ অন্য আসনগুলোতেও ছড়িয়ে পড়বে। যা হিতে বিপরীত হতে পারে। প্রভাব পড়তে পারে খোদ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে। তবে সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য করণীয় ঠিক করতে শীর্ষ কর্মকর্তা এবং পুলিশ সুপারদের নির্দেশনা দিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। গত মঙ্গলবার মাসিক অপরাধ বিষয়ক সভায় এ নির্দেশনা দেন তিনি। জানা গেছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ১১ ডিসেম্বর ফরিদপুর-২ আসনে নৌকার প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য শাহদাব আকবর চৌধুরী লাবু ও স্বতন্ত্র প্রার্থী জামাল হোসেন মিয়ার সমর্থকদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। বেলা ১১টার দিকে সালথা উপজেলার যদুনন্দী বাজারে সংঘর্ষের এ ঘটনায় পাঁচ পুলিশ সদস্যসহ উভয় পক্ষের অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন। এক পর্যায়ে পুলিশ শটগানের ২৫টি ফাঁকা গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। বেশকিছু দেশি অস্ত্র উদ্ধারসহ এ ঘটনায় তিনজনকে আটক করে পুলিশ। স্বতন্ত্র প্রার্থী জামাল হোসেন মিয়া নগরকান্দা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক। এ ঘটনা নিয়ে রীতিমতো বিব্রত জেলা প্রশাসন ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা। এ জেলার ফরিদপুর-৪ আসনে নৌকার প্রার্থী আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান কাজী জাফর উল্যাহ। সেখানে বর্তমান সংসদ সদস্য যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে নেমেছেন। এ আসনেও সংঘর্ষের আশঙ্কা রয়েছে। সহিংসতার আশঙ্কা থেকে বাদ নেই ফরিদপুর-১ ও ৩ আসনেও।

এদিকে ‘নৌকাওয়ালারা পলাইবার জন্য জায়গা পাবে না’ নৌকার প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম হিরুকে (বীরপ্রতীক) এমন হুমকি দিয়ে আলোচনায় আসেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক কামরুজ্জামান কামরুলের সমর্থক মাধবদী থানা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক সিরাজুল ইসলাম। বিষয়টি সোশ্যাল মিডিয়ায় রীতিমতো ভাইরাল হয়েছে। গত ৬ ডিসেম্বর নরসিংদী-১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুলের মতবিনিময় সভা থেকে এই হুমকি দেওয়ার পর তাকে শোকজ করেছেন নরসিংদী সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সংসদীয় আসনের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা আসমা সুলতানা নাসরীন। এর আগে গত ২৯ নভেম্বর ‘কোনো স্বতন্ত্র মতন্ত্র আমরা চিনি না, মাইরের ওপর কোনো ঔষধ নাই’ বক্তব্য দিয়ে নির্বাচনি আচরণ বিধিমালা ভঙ্গের কারণে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আহসানুল ইসলাম রিমন। এ আসনের মতো নরসিংদী জেলার ৩, ৪ ও ৫-এর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগে রয়েছেন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। অনেকটা একই অবস্থা বিরাজ করছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩, চাঁদপুর-১ ও ৪, লক্ষ্মীপুর-১ ও ৩, ফেনী-৩, নোয়াখালী-১ ও ২, কুমিল্লা-২, ৫, ৮ ও ৬ এবং ১১ আসনে।

পুলিশ সদর দফতরের উপমহাপরিদর্শক (অপারেশন) আনোয়ার হোসেন বলেন, নির্বাচনি আচরণবিধি যারাই লঙ্ঘন করবেন তাদের বিরুদ্ধেই আমরা অ্যাকশনে যাব। এখানে কে কোন দলের প্রার্থী বা নেতা সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়।

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা, বরিশাল, ময়মনসিংহ, খুলনা বিভাগের একাধিক পুলিশ সুপারদের সঙ্গে কথা বলেন এ প্রতিবেদক। তারা বলেন, নৌকা এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী ক্ষমতাসীন দলের হওয়ার কারণে তারা খুবই অস্বস্তিতে রয়েছেন। কারণ দলীয় হাইকমান্ডের সঙ্গে অনেক স্বতন্ত্র প্রার্থীর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। তাদের অনেককে শীর্ষ পর্যায় থেকে নানাভাবে সহযোগিতা করা হচ্ছে। 

গোয়েন্দা সূত্র বলছে, এখন পর্যন্ত ১২৫টি আসনে আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন। এদের মধ্যে খোদ ২৭ জন বর্তমান সংসদ সদস্য। জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদের অন্তত ৩০ জন হেভিওয়েট প্রার্থী রয়েছেন নির্বাচনি মাঠে। এদের অনেকেই নৌকা প্রতীকও পেতে পারেন। তবে স্বতন্ত্র প্রভাবশালী প্রার্থীরা মাঠে থাকার কারণে সমূহ সহিংসতার আশঙ্কা থেকে যাবে।

গত ১৪ ডিসেম্বর সকালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুষ্টিয়া-৪ (কুমারখালী-খোকসা) আসনের দুই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের অভিযোগে পাল্টাপাল্টি মামলায় তিনজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কুষ্টিয়া-৪ আসনে এবার আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার সেলিম আলতাফ জর্জ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী ও সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রউফের সমর্থকদের মধ্যে এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। নির্বাচনে এখনো আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু না হলেও গত সোমবার পিরোজপুর-১ আসনে নৌকার প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে লালন ফকির নামে এক যুবক নিহত হয়েছেন। ওই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম এ আউয়াল।

নির্বাচনি আসনগুলোতে সহিংসতার আশঙ্কা নিয়ে জানতে চাওয়া হলে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী মাঠে থাকবে র‌্যাব। আইনের ব্যত্যয় ঘটলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো ধরনের সহিংসতা গ্রহণযোগ্য নয়।

জানা গেছে, বরিশাল-৫ আসন নিয়ে রীতিমতো বিব্রতকর পরিস্থিতিতে রয়েছেন জেলা প্রশাসন এবং আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। প্রতি মুহূর্তের পরিস্থিতি উচ্চ পর্যায়কে অবহিত করছেন। এ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। নৌকার প্রার্থী পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের সঙ্গে তার তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। নেতা-কর্মীদের মধ্যে এ নিয়ে উত্তেজনা বিরাজ করছে।

এদিকে গত ১৪ ডিসেম্বর আপিল শুনানি কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য নির্বাচন ভবনে এসে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন কুমিল্লা-১ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আবদুস সবুর ও স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা নাঈম হাসানের সমর্থকরা। নাঈম হাসানের আপিল আবেদন নামঞ্জুর করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তারা বেরিয়ে যাওয়ার সময় আবদুস সবুরের সমর্থকদের দেখতে পান। এ সময় দুই পক্ষ সংঘর্ষে জড়ায়। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে এবং দুজনকে আটক করে।

অনেকটা একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে টাঙ্গাইল-৩ আসনে। এখানে নৌকার প্রার্থী ডা. কামরুল হাসান খান। স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান রানা। সঙ্গে লড়বেন বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম।

টাঙ্গাইল-৪ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোজাহেরুল ইসলাম তালুকদার। এ আসনে আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী স্বতন্ত্র প্রার্থী। টাঙ্গাইল-৪ ও টাঙ্গাইল-৫ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মুরাদ সিদ্দিকী। তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। টাঙ্গাইল-৫ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মামুনুর রশীদ।

যশোর-৪ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নওয়াপাড়া পৌরসভার সাবেক মেয়র ও অভয়নগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এনামুল হক বাবুল। স্বতন্ত্র প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য রনজিত কুমার রায়। গোপালগঞ্জ-১ (মুকসুদপুর-কাশিয়ানী) আসনের এবারও নৌকার প্রার্থী আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান। এ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মুকসুদপুর উপজেলা চেয়ারম্যান কাবির মিয়া।

এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ-১, মাদারীপুর-৩, পঞ্চগড়-১, বরিশাল-২ ও ৪, ভোলা-৩, পটুয়াখালী-৪, বরগুনা-২ ও ঝালকাঠি-১ আসনেও সহিংসতার আশঙ্কা করছে পুলিশ। সহিংসতার আশঙ্কা থেকে বাদ যাচ্ছে না রাজশাহী-১, ৪ (বাগমারা) ও ৬, গাইবান্ধা-৪ ও ৫, যশোর-৪, সাতক্ষীরা-১, জামালপুর-৪, মানিকগঞ্জ-২, কিশোরগঞ্জ-২, সুনামগঞ্জ-১ ও চট্টগ্রাম-১২ আসনও।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে গতকালও সারা দেশে ১৫২ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন ছিল। বিএনপি ও সমমনা দলের অবরোধে সহিংসতা প্রতিরোধের পাশাপাশি নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে প্রতিদিনই বিজিবি মোতায়েন থাকবে। বিজিবি ছাড়া আনসার ও র‌্যাবের নিয়মিত টহল থাকবে।

সর্বশেষ খবর