শনিবার, ১৩ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

আতঙ্ক ভোট পরবর্তী সহিংসতায়

♦ প্রতিপক্ষের হুমকিতে এলাকাছাড়া কয়েক হাজার মানুষ, নিহত ৩ ♦ আহত ২ শতাধিক, দেড় শতাধিক অগ্নিসংযোগ লুট ভাঙচুর

সাখাওয়াত কাওসার

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা নিজেদের মধ্যে বিরোধে জড়িয়েছেন। এসব ঘটনায় চরম নিরাপত্তাহীনতায় ছিলেন এলাকাবাসী। তবে নির্বাচন শেষ হয়ে গেলেও তাদের মধ্যে তৈরি হওয়া বিরোধের শেষ হয়নি। এখনো এর ঘানি টানছেন তাদের সমর্থকরা। নির্বাচন শেষ হওয়ার পর গত পাঁচ দিনে দেশের বিভিন্ন এলাকায় তিনজন নিহত হয়েছেন। আর আহত হয়েছেন দুই শতাধিক মানুষ। ১৫০টির বেশি বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন কয়েক হাজার মানুষ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের উপ-মহাপরিদর্শক (অপারেশন) আনোয়ার হোসেন বলেন, নির্বাচন শেষ। পুলিশ সদর দফতর থেকে বার্তা পাঠানো হয়েছে সবগুলো ইউনিটকে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির চেষ্টা করা হলে কোনো ছাড় নেই। সে যে-ই হোক না কেন, আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

জানা গেছে, কুষ্টিয়া-৪ আসনের খোকসায় নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা চরম রূপ নিয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই নিয়ম করে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছেন নৌকা ও ট্রাক প্রতীকের সমর্থকরা। সর্বশেষ মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে পাল্টাপাল্টি হামলা হয়েছে। এসব ঘটনায় বাড়ি ভাঙচুর, গরু ও নগদ টাকা লুটপাটের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

মাদারীপুর-৩ আসনে (কালকিনি-ডাসার-সদরের একাংশ) ঈগল প্রার্থীর বিজয় মিছিলে বোমা হামলায় এমারত সর্দার (৪৫) নামে এক চা দোকানি নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া গত বুধবার সাভার পৌর এলাকার কাতলাপুরে নৌকা ও ঈগলের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে ১০ জন আহত হয়।

বাড়িঘরে হামলার শিকার লোকজন স্বতন্ত্র প্রার্থী ও প্রস্তাবিত উপজেলা কমিটির স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রশিদ দুলালের সমর্থক। তিনি অভিযোগ করেন, নির্বাচনের পর পাবনা-১ আসনের বিভিন্ন এলাকায় স্বতন্ত্র প্রার্থীর লোকজনের ওপর হামলা চালানো হচ্ছে। দেওয়া হচ্ছে হুমকি-ধমকি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সদ্য অনুষ্ঠিত হওয়া দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অন্তত ২২০টি আসনে সাড়ে তিন শর বেশি স্বতন্ত্র প্রার্থী ভোটের মাঠ উপস্থিত ছিলেন। এর মধ্যে ৬২টি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। প্রত্যাশা অনুযায়ী ভোট না পেয়ে পরাজয়ের পর প্রতিপক্ষ এ হামলা চালায়। নির্বাচন-পরবর্তী হামলা, ভাঙচুরের অভিযোগ বেশি নৌকার প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে। এ সময় শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি নগদ টাকা, গবাদি পশুসহ আসবাবপত্র লুটপাট হয়েছে। এতে নৌকাসহ বিভিন্ন দলের সমর্থকসহ তিনজন নিহত হয়েছে। প্রার্থীদের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার চেষ্টা, এলাকায় প্রভাব বিস্তার, সমর্থকদের মধ্যে বিরোধ এই হামলা সহিংসতার অন্যতম কারণ ছিল। এ পরিস্থিতিতে দেশে ব্যাপক আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। এর আগে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরপরই শুরু হওয়া সংঘাতে অন্তত পাঁচজন নিহত হয়েছেন। প্রতীক বরাদ্দের পর এর মাত্রা আরও বেড়ে যায়।

খোদ পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, নির্বাচন ঘিরে ১৮ থেকে ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২ দিনে হামলা, সংঘর্ষ, নাশকতা ও ভাঙচুরের ঘটনায় দেশের বিভিন্ন থানায় ১৮৪টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে ২১৫ জনকে।

নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি। তাদের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ঝিনাইদহের পোড়াহাটিতে অন্তত ৪০টি, মাদারীপুরের কালকিনিতে ৪৫টি, সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে ২০টির বেশি দোকান, বসতবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, লুটপাট ও আগুনের ঘটনা ঘটেছে। এর বাইরে পিরোজপুরের ইন্দুরকানি, নেত্রকোনার কেন্দুয়া, সাতক্ষীরার শ্যামনগর, গাজীপুর, গাইবান্ধা, খুলনার ডুমুরিয়া, নাটোর, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ, ঢাকার ধামরাই, কুষ্টিয়ার দৌলতপুর, খোকসা ও কুমারখালী, মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান, পটুয়াখালীর কলাপাড়া, রাজশাহীর পবা ও পারিলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নৌকা এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে বেশি সংঘর্ষ হয়েছে।

জানা গেছে, নির্বাচনের পর দিনই পাবনা-৩ আসনের চাটমোহর উপজেলার ফইলজানা গ্রামে নির্বাচনে বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের হামলায় নৌকার সমর্থক মো. আশরাফকে ছুরি মেরে আহত করা হয়। তাকে চাটমোহর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।

এ বিষয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাসুদ আলম বলেন, ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে আশরাফ নৌকার সমর্থক ছিল। এ কারণে প্রতিপক্ষের লোকজন তাকে ছুরি মেরেছে বলে অভিযোগ পেয়ে তদন্ত চলছে।

নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় পাবনার বেড়া উপজেলার ১০টি বাড়িঘরে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ সময় চারজন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ছুরিকাঘাতে নৌকার সমর্থক মো. আশরাফ নামে একজন আহত হন।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজনীয় সব কিছুই করা হবে। আমরা সবাইকে এসব থেকে বিরত রাখার আহ্বান জানাই। নইলে আইন অনুযায়ী যা করার তাই করা হবে। এর বাইরে ইতোমধ্যে সংঘটিত নাশকতা এবং সংঘর্ষের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর