বৃহস্পতিবার, ২৫ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

গাজীর শাসনে পাট যুগের অবসান

মন্ত্রীর সুপারিশেই বন্ধ হয় সব পাটকল, ইজারা দেওয়া হয় বস্ত্রকল, পরিণত হয় ভয়াবহ লোকসানি খাতে, নিষিদ্ধ পলিথিনকে উৎসাহিত করতে পাটের কবর রচনা

নিজস্ব প্রতিবেদক

গাজীর শাসনে পাট যুগের অবসান

সদ্য বিদায়ী বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর হাতেই ধ্বংস হয়েছে পাট খাত। একসময়ের লাভজনক পাট খাত পরিণত হয়েছে ভয়াবহ লোকসানি খাতে। বন্ধ হয়েছে একে একে রাষ্ট্রায়ত্ত সব পাটকল। ইজারা দেওয়া হয়েছে সরকারি বস্ত্রকলগুলোও। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রীর অজ্ঞতা, দায়িত্বহীনতা ও পরিকল্পনার অভাবকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, মন্ত্রীর নিষ্ক্রিয়তায় পাটজাত শিল্পের কোনোরকম বিকাশ তো ঘটেইনি, উল্টো সরকারের ৫ হাজার কোটি টাকা বাড়তি খরচ করে একযোগে বন্ধ করা হয়েছে সব পাটকল। নিষিদ্ধ পলিথিনকে উৎসাহিত করতেই কবর খোঁড়া হয়েছে সোনালি আঁশ পাটের।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় ৭০টি পাটকল। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থান হয় লাখ লাখ মানুষের। সোনালি আঁশ পাট ছিল বাংলাদেশের একটি ব্র্যান্ড পণ্য। সারা বিশ্বে রপ্তানি হতো পাটপণ্য। পরিবেশবান্ধব হওয়ায় পাটের কদর বিশ্বে ক্রমেই বাড়ছে। টেকসই উন্নয়নের জন্য যখন বিশ্বজুড়ে পরিবেশবান্ধব শিল্পের অর্থনৈতিক তৎপরতাকে গুরুত্ব দেওয়ার তাগিদ বাড়ছে, ঠিক সেই সময় লক্ষাধিক শ্রমিক ও কৃষক পরিবারকে অনিশ্চয়তায় ফেলে ২০২০ সালের ২ জুলাই দেশের প্রধান ২৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ করে দেওয়া হয়। পাশাপাশি বন্ধ পাটকলগুলো বেসরকারি খাতে ইজারা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও গত তিন বছরে ১৫টি পাটকল পরিণত হয়েছে পরিত্যক্ত সম্পদে। অন্যদিকে ২৬টি পাটকলের জায়গাজমি-রাস্তা-গোডাউন-নদীর ঘাট পর্যন্ত বেহাত হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাট চাষ ও পাটশিল্পকে উৎসাহিত করতে নানা পদক্ষেপ নেন। অথচ নিষিদ্ধ পলিথিনকে উৎসাহিত করতে গত ১৫ বছরে পাটের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকেছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। পাটকলগুলোর ধারাবাহিক লোকসানের জন্য দায়ী মন্ত্রণালয় ও বিজেএমসির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের অপসারণসহ শাস্তি প্রদানের পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় সম্পদ পাট সেক্টরই নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে। জলাঞ্জলি দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২০ সালের জুনের প্রথম সপ্তাহে তৎকালীন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী স্বাক্ষরিত বিশেষ নোট পাঠানো হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। বিশেষ ওই নোটেই সাবেক পাটমন্ত্রী দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো বন্ধ করে তা বেসরকারি খাতে ইজারা প্রদানের সুপারিশ করেন। এরপর একই বছর জুলাইয়ে সব পাটকল বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়। গোলাম দস্তগীর গাজী পাটকলের পর বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশনের তিন বস্ত্রকলও বেসরকারি খাতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত জারি করে গেছেন। ইজারার অনুমতি পাওয়া টেক্সটাইল মিলগুলো হলো চট্টগ্রামের ভালিকা উলেন মিলস, সিলেট টেক্সটাইল মিলস ও কুড়িগ্রাম টেক্সটাইল মিলস। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বিটিএমসির কারখানাগুলো বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পুনরায় চালুর জন্য ইজারা দেওয়া হবে। ইজারার শর্তাবলি, পদ্ধতি ও ইজারা প্রস্তাব চূড়ান্ত করার জন্য ১০ সদস্যের একটি আন্তমন্ত্রণালয় ওয়ার্কিং কমিটিও গঠন করা হয়। পর্যায়ক্রমে বিটিএমসির অন্য ২৮টি কারখানাও বেসরকারি খাতে ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল মন্ত্রী গাজীর। এ ব্যাপারে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে প্রশ্ন শোনার পর সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি মোবাইলে ইন্টারভিউ দিই না। আপনি সামনাসামনি আসেন, কথা বলব।’ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এ পর্যন্ত নয়টি পাটকল ভাড়াভিত্তিক ইজারা দেওয়া হলেও তা সচল হয়ে উঠছে না। পাটপণ্যের পাশাপাশি টেক্সটাইল পণ্য উৎপাদনের শর্তে নরসিংদীর বাংলাদেশ জুট মিলসের ইজারা পেয়েছে বে ফুটওয়্যার লিমিটেড, চট্টগ্রামের কেএফডি জুট মিলস পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে ইউনিটেক্স কম্পোজিট, সিরাজগঞ্জের জাতীয় জুট মিলস ইজারা পেয়েছে যুক্তরাজ্যের জুট রিপাবলিক, চট্টগ্রামের কুমিরার এমএম জুট মিলস লিমিটেড, আরআর জুট মিলস লিমিটেড, খুলনার প্লাটিনাম জুবিলী জুট মিলস লিমিটেড ও যশোরের অভয়ননগরের জে জে আই জুট মিলস লিমিটেডের পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে আকিজ গ্রুপ। সর্বশেষ আরও দুটি পাটকল ইজারা দেওয়ারও খবর পাওয়া গেছে। বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী থাকাবস্থায় গোলাম দস্তগীর গাজী বলেছিলেন, এক বছরের মধ্যে সব বন্ধ মিল চালু করা হবে। কিন্তু গত তিন বছরে ২৬টি পাটকলের মধ্যে মাত্র তিনটি পাটকল উৎপাদনে যেতে পেরেছে। বাকি পাটকল কবে নাগাদ চালু হবে বলতে পারছে না কেউ। এদিকে ইজারাবিহীন বাকি পাটকলগুলো প্রয়োজনীয় তদারকির অভাবে রীতিমতো পরিত্যক্ত সম্পদে পরিণত হয়েছে। সেসব কারখানার মেশিনপত্র, যন্ত্রাংশ জরাজীর্ণ ও নষ্ট হয়ে গেছে। ভগ্নদশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে কারখানা ভবনসহ আনুষঙ্গিক স্থাপনা, বেহাত হয়েছে জমি ও মূল্যবান সম্পদ। দীর্ঘ সময়ে অযত্ন অবহেলায় শুধু খুলনা অঞ্চলের নয়টি পাটকলেই নষ্ট হতে বসেছে ৫ হাজার ৮৩টি তাঁত। বিজেএমসির সূত্রমতে, তাঁতগুলোর বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া মিলগুলোর মোট জমি রয়েছে ৫৫০ একর। এ বিশাল জমির অধিকাংশই পড়ে আছে অব্যবহৃত।

এসব পাটকলে পাটজাত পণ্যের পাশাপাশি টেক্সটাইল পণ্য, এমনকি চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনের প্রস্তাব তুলে ইজারা প্রদানের চেষ্টা চালিয়ে আসছে পাট মন্ত্রণালয়। এ অবস্থায় পাটকলগুলোয় পাটজাত পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া আদৌ থাকবে কি না সেটাই এখন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে বিলুপ্তির ক্ষণ গুনছে দেশের ঐতিহ্য পাট।

এদিকে পাটকলগুলো বন্ধ ঘোষণার সময় তৎকালীন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী দুই মাসের মধ্যে সব পাওনা পরিশোধের অঙ্গীকার করলেও খুলনার খালিশপুর ও দৌলতপুর জুট মিল, সিরাজগঞ্জের জাতীয় জুট মিল এবং চট্টগ্রামের কেএফডি ও আর আর জুটমিলের শ্রমিকরা এখনো বকেয়া পাননি। অনেকেই পাননি সঞ্চয়পত্রের কাগজপত্রও। ফলে শ্রমিক পরিবারগুলো বছরের পর বছর উৎকণ্ঠা নিয়ে মানবেতর দিন যাপন করছে। মিলগুলোর স্কুলের ছাঁটাইকৃত শিক্ষক-কর্মচারীরাও আছেন সীমাহীন কষ্টে। রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ করার মধ্য দিয়ে পাটের চাষ ও পাটের বাজারজাতকরণকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। অথচ উৎপাদন বন্ধ থাকলেও বিজেএমসি ও মিলের ২ হাজার ৫১৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সবেতন বহাল রাখা হয়েছে। সরকার তাদের বেতন বাবদই প্রতি বছর প্রদান করছে ১৪০ কোটি টাকা। বিশ্লেষকরা বলছেন, সারা বিশ্ব এখন সবুজায়নে জোর দিচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ২৮ দেশ পলিথিন ব্যবহার বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সেসব দেশে বিপুল পরিমাণে পাটের ব্যাগের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। পাটবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল জুট স্টাডি গ্রুপের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বে বছরে ৫ হাজার কোটি পিস শপিং ব্যাগের চাহিদা রয়েছে। এ ছাড়া পাটের তৈরি শৌখিন আসবাবপত্র ও শোপিসের চাহিদা বিশ্বব্যাপী। ক্রমেই পরিবেশবান্ধব পাটের চাহিদা বাড়ছে। এতসব সুযোগ ও সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর