শুক্রবার, ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

ভোগান্তির শেষ নেই কর্মজীবী নারীর

♦ আছে বাসস্থান সমস্যা, নেই নারীবান্ধব গণপরিবহন ♦ ডে-কেয়ার সেন্টারের সুবিধা পায় না সবাই ♦ বেতন বৈষম্য কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানিতে অনেকেই

জিন্নাতুন নূর

ভোগান্তির শেষ নেই কর্মজীবী নারীর

নারী ঘর সামলে, শত বাধা ও প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে তার নিজের ও পরিবারের আর্থিক অবস্থার উন্নয়নে শ্রমবাজারে ঢুকছে। কিন্তু এ বিপুল পরিমাণ কর্মজীবী নারীকে ঘরের বাইরে কাজ করতে গিয়ে পদে পদে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। আধুনিক যুগে এসেও অনেক পরিবার নারীদের ঘরের বাইরে কাজ করাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছে না। আবার নিজ জেলার বাইরে যে নারীরা ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোতে কাজ করতে যাচ্ছেন তারা বাসস্থান সংকটে পড়ছেন। ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে এখনো নারীবান্ধব গণপরিবহন সুবিধা নিশ্চিত করা যায়নি। কর্মজীবী নারীদের সন্তান রেখে কাজ করতে যাওয়ার সমস্যা দীর্ঘদিনের। আর নারী-পুরুষের বেতন বৈষম্যের বিষয়টি পুরনো। কাজে গিয়ে নারীদের এখনো প্রতিনিয়ত যৌন হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। এমনকি অনেকে পুরো মাতৃত্বকালীন ছুটিও ভোগ করতে পারেন না।  বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপ ২০২৩ এর চতুর্থ প্রান্তিকের (অক্টোবর-ডিসেম্বর) প্রতিবেদন অনুযায়ী বর্তমানে দেশে কর্মক্ষম জনশক্তি ৭ কোটি ১১ লাখ। এর মধ্যে কর্মজীবী পুরুষের সংখ্যা ৪ কোটি ৬৪ লাখ আর কর্মজীবী নারীর সংখ্যা ২ কোটি ৪৬ লাখ।

বাসস্থান সংকট প্রকট : কর্মজীবী নারীদের একটি অংশ বিবাহিত, আছে অবিবাহিতরাও। এরা বিভিন্ন ব্যাংক, করপোরেট প্রতিষ্ঠান, এনজিও, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। চাকরির সুবাদে তারা ঢাকায় আসেন এবং এদের বেশির ভাগই বাসস্থান সমস্যায় পড়েন। মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের আওতায় কর্মজীবী নারীদের জন্য বর্তমানে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ৯টি মহিলা হোস্টেল রয়েছে। এগুলো নীলক্ষেত, খিলগাঁও, মিরপুর-১, গাজীপুরের কালীগঞ্জ, সাভারের বড় আশুলিয়া, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা এবং যশোরে অবস্থিত। এই হোস্টেলগুলোতে সিট রয়েছে ২ হাজার ৭৩৮টি। যা দেশের মোট কর্মজীবী নারীর সংখ্যার তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে একা একজন নারীর জন্য ঘরভাড়া নিয়ে থাকা অনিরাপদ, কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেকে কিছু বেসরকারি হোস্টেল ও বাসায় কয়েকজন কর্মজীবী নারী মিলে ভাড়া থাকছেন। মিরপুর ডিওএইচএসে একটি ফ্ল্যাটে বসবাসরত আরোহী নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নারী বলেন, ‘আমি মতিঝিলে একটি অফিসে কাজ করি। আমার প্রতিষ্ঠানে রাত ১০টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। বাসায় ফিরতে কখনো কখনো রাত ১১টা পেরিয়ে যায়। কিন্তু দারোয়ান ১১টার পর এলে অনেক কথা শোনায়।’

নেই নারীবান্ধব পরিবহন : বাসস্থানের পরই কর্মজীবী নারীর দ্বিতীয় বড় সমস্যা হচ্ছে পরিবহন। রাজধানী ঢাকাসহ অনেক স্থানেই এখন কর্মজীবী নারীদের স্কুটি চালাতে দেখা যায়। এই নারীরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ঢাকায় নারীবান্ধব গণপরিবহন না থাকায় তারা বাধ্য হয়ে দুর্ঘটনা ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও স্কুটি চালাচ্ছেন। ভুক্তভোগী কয়েকজন কর্মজীবী নারী জানান, গণপরিবহনে ওঠা মাত্রই প্রায় দিন তাদের কোনো না কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়। বিশেষ করে রাতে কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে বাস যাত্রীরা নেমে যাওয়ার পর নারীদের একা পেলে ধর্ষণ চেষ্টার ঘটনাও বেশ কয়েকটি ঘটতে দেখা যায়। দেশের গণপরিবহনে নারীদের জন্য আসন সংরক্ষণের নিয়ম থাকলেও কার্যত এটি মানা হয় না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গণপরিবহনে নারীদের হয়রানি প্রতিরোধে এর ভিতর ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা স্থাপন, নারীবান্ধব গণপরিবহনের সংখ্যা বৃদ্ধি, নারীদের জন্য আলাদা পরিবহনের ব্যবস্থা করা, বাসের চালক, তত্ত্বাবধায়ক ও সহকারীর পরিচয় উল্লেখ করে নেমপ্লেট বাধ্যতামূলক করা, দ্রুত বিচার নিশ্চিত করে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা ও জনসচেতনামূলক কার্যক্রম নেওয়া উচিত।

ডে-কেয়ার সেন্টারের সুবিধা অপর্যাপ্ত : মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের আওতায় দেশের কর্মজীবী ও শ্রমজীবী মায়ের শিশুদের জন্য ঢাকাসহ সারা দেশে ৪৩টি ডে-কেয়ার সেন্টার আছে। এর মধ্যে ঢাকায় ৬টি। আর ৮টি নিম্নবিত্তদের জন্য। জেলা শহরে আছে ১৩টি। ৫টি বিভাগীয় শহরে। আর নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য আরও আছে ১১টি। কিন্তু এসব সেন্টারে শিশুদের বেশি সময় রাখতে না পারায় অনেকে চাইলেও শিশুদের রাখতে পারছে না। কর্মজীবী মায়েদের অভিযোগ এসব সেন্টারে পর্যাপ্ত লোকবল না থাকায় তাদের সন্তানদের দেখভাল নিয়ে শঙ্কায় আছেন। খাবারের মান নিয়েও প্রশ্ন আছে। মিরপুর-১২ নম্বরের এক পোশাক শ্রমিক বলেন, ‘যে টাকা পাই চাইলেও আমার পোলাডারে কোনো সেন্টারে রাখতে পারুম না। শুনছি অনেক কারখানায় এখন ডে-কেয়ার সেন্টার আছে। আমাদের থাকলেও ভালো হইতো।’

ভয় যৌন হয়রানির : কর্মজীবী নারীরা জানান, গণপরিবহন বাদেও তাদের নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে প্রায়ই যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়। চাকরি রক্ষা ও লোকলজ্জার ভয়ে অনেকে মুখ বুঝে দিনের পর দিন এই হয়রানি সহ্য করে যান। কেউ প্রতিবাদ করে আবার চাকরি হারান। উচ্চ পদেও কর্মজীবী নারী থেকে শুরু করে কারখানার শ্রমিক পর্যায়ে নারী কেউই এই হয়রানি থেকে রেহাই পান না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির অফিস সহকারী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘অফিসে প্রায়ই তার বসের অরুচিকর কথা ও দৃষ্টিভঙ্গি সহ্য করতে হয়। রাতে প্রায়ই অশালীন খুদে বার্তা আসে বসের কাছ থেকে।’ চাকরির প্রয়োজনে তিনি এ ব্যাপারে কোনো অভিযোগও করতে পারছেন না।

বেতন-বৈষম্য দৃশ্যমান : কর্মজীবী নারী-পুরুষের মধ্যে বেতন বৈষম্য বহুদিন ধরেই হয়ে আসছে। উচ্চপদে কর্মরত নারীরা জানান, বেতন বৈষম্য না হলেও নারী হওয়ার কারণে তারা সহজে পদোন্নতি পান না। নিয়ম অনুাযায়ী ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি পাওয়ার কথা থাকলেও কেউ কেউ দু-তিন মাসের মাথায় কাজে যোগ দিতে বাধ্য হন। শ্রমজীবী নারীরা সবচেয়ে বেশি বেতন বৈষম্যের শিকার হন। রাজধানীর গাবতলীতে নির্মাণশ্রমিক রোজিনা বলেন, ‘আমরা পুরুষ শ্রমিকদের মতো সমান কাজ করেও তাদের চেয়ে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা মজুরি কম পাই। নারী শ্রমিকদের সহজে কাজেও নিতে চায় না কেউ। বাধ্য হয়ে কম মজুরিতেও কাজ করি।’ বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম বলেন, কর্মজীবী নারীদের অর্থনীতিতে যে অবদান তাকে খুব বড় করে দেখা হচ্ছে না। মাতৃত্বকালীন ছুটি নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে সন্তান লালন-পালন করা যে শুধু নারীর নিজের জন্য নয়, এর মাধ্যমে যে নারী জাতি গঠনে অবদান রাখছে এই বোধ দেশের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে আসতে হবে। কর্মজীবী নারীর জন্য শহর থেকে মফস্বল সবখানে নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা থাকা জরুরি। দেশে কর্মজীবী নারীদের জন্য যে পরিমাণ ডে-কেয়ার সেন্টার প্রয়োজন বাস্তবে তার সংখ্যা ধারেকাছেও নেই। ’৯০ সালে যে পরিমাণ মহিলা হোস্টেল ছিল ২০২৪ সালে এসে সরকারের যে পরিমাণ ব্যয় ও রাজস্ব খাত সেভাবে কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল গড়ে ওঠেনি। এর ফলে কার্যত নারী আরও যত সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখতে পারত তা হচ্ছে না। সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কর্মজীবী নারীদের ভোগান্তির বিষয়ে আরও নজর দেওয়া উচিত।

সর্বশেষ খবর