শুক্রবার, ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভয়ংকর যৌননিপীড়ন

জড়িত খোদ শিক্ষক, প্রভাবশালী ছাত্র সংগঠনের নেতা, বহিরাগতরাও, বারবার অপরাধ করেও পার

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশের সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় লুকিয়ে আছে ভয়ংকর যৌন নিপীড়ক। সংখ্যায় কম হলেও এই বিকৃত অপরাধীরা সাধারণ শিক্ষার্থী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেই মিশে থাকে। সুযোগ পেলেই নিজের কুরুচিপূর্ণ আচরণ তথা মেয়ে শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন করে। এই যৌন নিপীড়কদের মধ্যে শিক্ষকরা যেমন আছে, একইভাবে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে শিক্ষার্থী, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাবশালী ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছাত্র ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত যাতায়াতকারী কিছু বহিরাগত ব্যক্তি। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, সাধারণত যে অপরাধীরা যৌন নিপীড়নের সঙ্গে জড়িত তারা আগেও কয়েকবার এ ধরনের অপরাধ করেছে। কিন্তু ঘটনাটি গণমাধ্যমে না আসা পর্যন্ত আগের ঘটনাগুলো সম্পর্কে জানা যায় না। সম্প্রতি দেশের দুই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে একের পর এক যৌন নিপীড়নের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটির কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়েও তৈরি হচ্ছে শঙ্কা।

জানা যায়, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকলেও এখন পর্যন্ত দেশের সব সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়নি। আবার কমিটি গঠিত হলেও বেশির ভাগ শিক্ষার্থী এই প্রতিরোধ কমিটি সম্পর্কে তেমন একটা জানেন না।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট বিভাগের উপপরিচালক মৌলি আজাদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশের হাতেগোনা কয়েকটি বড় বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আমাদের কাছে নিয়মিত প্রতিরোধ কমিটির প্রতিবেদন পাঠায় না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ ব্যাপারে শিক্ষার্থীদেরও বিস্তারিত জানায় না। আমি মনে করি, এ ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের বিস্তারিত জানানো প্রয়োজন।

‘বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পুরুষতান্ত্রিক ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধের কৌশল’ শীর্ষক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর পরিচালিত এক গবেষণা থেকে জানা যায়, ৫৬ শতাংশ নিপীড়কই ছাত্রীদের সহপাঠী। ২৪ শতাংশ তাদের চেয়ে ছোট বা বড়। ১১ শতাংশ বহিরাগত ও ৯ শতাংশ শিক্ষক। ১০ শতাংশ ছাত্রী জানান, নির্যাতনের ৩০ শতাংশ বাজে মন্তব্য ও ৬০ শতাংশ সাইবার হয়রানির শিকার। নিপীড়নের ঘটনার মাত্র ১০ শতাংশ ছাত্রী অভিযোগ করেন। এর মধ্যে ৫ শতাংশ বিভাগের শিক্ষকদের কাছে এবং বাকি ৫ শতাংশ সেলে। ৯২ শতাংশ জানান, ন্যায়বিচার না পওয়া ও চরিত্র হননের ভয়ে তারা সেলে অভিযোগ করেননি। ছাত্রীদের অভিযোগ, অভিযুক্ত ব্যক্তিরা প্রভাবশালী। শিক্ষকরা ভুক্তভোগীদের তেমন সাহায্য করেন না। মনোভাবও ততটা সহযোগিতাপূর্ণ নয়। এ অবস্থায় তারা অসহায় বোধ করেন।

কেস স্টাডি ১ : সম্প্রতি স্নাতকোত্তর পর্বের থিসিস করতে গিয়ে শিক্ষক কর্তৃক যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের এক ছাত্রী। রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক এবং থিসিসের সুপারভাইজার অধ্যাপক ড. মাহবুবুল মতিনের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নির্যাতন সেলকে মাধ্যম করে চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি উপাচার্য বরাবর যৌন হয়রানির লিখিত অভিযোগ দেন ভুক্তভোগী ছাত্রী। এতে বলা হয়, থিসিস চলাকালীন সুপারভাইজার কর্তৃক যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের শিকার হন সেই শিক্ষার্থী। ল্যাবে একা কাজ করার সময় এবং কেমিক্যাল দেওয়ার বাহানায় নিজ কক্ষে ডেকে দরজা আটকে তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করেন এই শিক্ষক। এই শিক্ষার্থীর অন্য দুই সহপাঠীও ওই শিক্ষকের মাধ্যমে আগে যৌন হেনস্তার শিকার হয়েছিলেন বলে জানা যায়।

কেস স্টাডি ২ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক ছাত্রীকে নিজ কক্ষে পরামর্শের জন্য ডেকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছে একই ইনস্টিটিউটের প্রফেসর নুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় ২০২৩ সালের নভেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগী ছাত্রী। এতে ওই ছাত্রী বলেন, গত ১১ সেপ্টেম্বর হল বিষয়ে পরামর্শ নেওয়ার জন্য ইনস্টিটিউটের অফিস কক্ষের সামনে গেলে ওই শিক্ষক তাকে নিজে থেকে তার কক্ষে ডাকেন। কক্ষে যাওয়ার পর সেই শিক্ষক প্রয়োজনীয় দু-একটা কথা বলার পর অপ্রাসঙ্গিক কথা বলতে শুরু করেন। এরপর শিক্ষকের কথার ধরন ও অঙ্গভঙ্গি অস্বাভাবিক মনে হলে শিক্ষার্থীটি উঠে দাঁড়ান। তখন সেই শিক্ষকও নিজ আসন থেকে উঠে এসে তাকে যৌন নিপীড়ন করেন। মেয়েটির শরীরের আপত্তিকর স্থানে স্পর্শ করেন। ঘটনার আকস্মিকতায় কিছু বুঝে ওঠার আগেই মেয়েটি শিক্ষকের কক্ষ থেকে দৌড়ে পালিয়ে যান। জানা যায়, অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে এর আগেও কয়েকবার যৌন নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছিল।

কেস স্টাডি ৩ : সর্বশেষ গত ৩ ফেব্রুয়ারি রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ আবাসিক হলে ‘এ’ ব্লকের ৩১৭ নম্বর কক্ষে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে কৌশলে বোটানিক্যাল গার্ডেনে নিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান, তার পরিচিত মামুনুর রশীদ মামুনসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগীর স্বামী ছয়জনকে আসামি করে আশুলিয়া থানায় ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন’ আইনে মামলা করেন। অভিযোগটি ওঠার পর থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় উত্তাল হয়ে আছে।

বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ভালোমন্দ এবং নৈতিকতার শিক্ষা আমরা শিক্ষকদের কাছ থেকেই পাই। কিন্তু একজন শিক্ষকের মাধ্যমে যখন শিক্ষার্থী যৌন নির্যাতনের শিকার হন তখন তার আদৌ শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা আছে কি না ভাবতে হবে। একজন শিক্ষকের মেধাবী হওয়ার পাশাপাশি তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেও খোঁজখবর নেওয়া উচিত। বেশির ভাগ সময়ই যৌন হয়রানির শিকার মেয়েরা নীরবে এসব সহ্য করে যেত। কিন্তু এ বিষয়ে আগের চেয়ে মেয়েরা সোচ্চার হয়েছে। ফলে, এ ধরনের ঘটনাও এখন বেশি প্রকাশ পাচ্ছে। রাজনীতিবিদদের এসব বিষয়ে সোচ্চার হওয়ার কথা থাকলেও তারা এসব বিষয়ে কথা বলছেন না।

ধর্ষণের দায় জাবি কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারে না : র‌্যাব

 

সর্বশেষ খবর