শুক্রবার, ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

ধর্ষণের দায় জাবি কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারে না : র‌্যাব

নিজস্ব প্রতিবেদক

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) স্বামীকে আটকে রেখে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ঘটনার দায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারে না। কারণ সেখানে বিভিন্ন সময় মাদক, ধর্ষণসহ নানা অপরাধ ঘটেছে। এসব ঘটনায় বহিরাগতদের প্রবেশের দায় কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে। মাদক ব্যবসার আড়ালে দীর্ঘদিন ধরেই জাবি এলাকায় এমন ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজার র?্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন সংস্থাটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি বলেন, আমরা আগামী প্রজন্মকে জাহাঙ্গীরনগর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করার স্বপ্ন দেখি। এমনকি যারা মাদক কারবার, চোরাচালানসহ অবৈধ ব্যবসা করেন সেসব ব্যক্তি খারাপ হলেও অভিভাবক হিসেবে নিজের সন্তানকেও বিদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করান। আমরা চাই আমাদের সন্তানরা লেখাপড়া করুক এবং সুশিক্ষায় শিক্ষিত হোক।

৩ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ৯টার দিকে জাবির মীর মশাররফ হোসেন হলের এ ব্লকের ৩১৭ নম্বর কক্ষে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। রাতেই বিশ্ববিদ্যালয় হল কর্তৃপক্ষের সহায়তায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চারজনকে আটক করে। এ ঘটনায় ৪ ফেব্রুয়ারি ভিকটিমের স্বামী জাহিদ মিয়া ওরফে রবিন বাদী হয়ে ঢাকার আশুলিয়া থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা করেন। সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে আইনের আওতায় নিয়ে এসে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেন। এ ছাড়া ঘটনাটি সমাজমাধ্যমসহ গণমাধ্যমে প্রচারিত হলে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে র‌্যাব। র‌্যাব মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন বলেন, বুধবার রাতে র‌্যাব-২, র‌্যাব-৪ ও র‌্যাব-৫-এর আভিযানিক দল ঢাকার ফার্মগেট থেকে ধর্ষণের মূল পরিকল্পনাকারী মামুনুর রশিদ ওরফে মামুন ও নওগাঁ সদর এলাকা থেকে অন্যতম সহায়তাকারী মুরাদকে গ্রেফতার করে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা ধর্ষণে তাদের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেন। জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, মামুন শুরুতে গার্মেন্টস পেশায় নিয়োজিত থাকলেও তার মূল ব্যবসা ছিল মাদক। আর সে ব্যবসার মূল ক্ষেত্র ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। মামুন প্রতি মাসে ৭-৮ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেট নিয়ে আসতেন কক্সবাজার থেকে। এ ইয়াবা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের কাছে বিক্রি করতেন।

মামুনের তথ্য অনুযায়ী, তারা অনেকদিন থেকেই মাদক ব্যবসা করে আসছেন। ভিকটিমের বাসায় সাবলেট হিসেবে বসবাস করতেন। ভিকটিম ও তার স্বামীর সঙ্গে মামুনের তিন বছরের অধিক সময় ধরে মাদক ব্যবসার সম্পর্ক রয়েছে। তারা একসঙ্গে একই বাসায় থাকতেন। ভিকটিমের স্বামী মামুনকে মাদক ব্যবসায় সাহায্য করতেন। প্রতি মাসে তিন-চার বার কক্সবাজার থেকে ইয়াবা নিয়ে আসতেন মামুন। জুতার ভিতরে ও মোবাইলের পাওয়ার ব্যাংকে করে প্রতিবার দুই থেকে আড়াই হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেট আনতেন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় ২ ফেব্রুয়ারিও ২ হাজার ৭০০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট নিয়ে আসেন। কিন্তু বাসায় এত মাদক রাখা নিরাপদ না ভেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩১৭ নম্বর হলে থাকার সিদ্ধান্ত নেন।

পরে মামুন ভিকটিমের স্বামীকে বলেন তার জামাকাপড় নিয়ে ক্যাম্পাসের হলে আসতে। ভিকটিম মামুনের জামাকাপড় নিয়ে ক্যাম্পাসে আসেন। এর পরই মামুন ও মোস্তাফিজ ভিকটিমকে কৌশলে ও বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি নির্জন এলাকায় নিয়ে যান এবং ধর্ষণ করেন। এরপর রুমে গিয়ে ভিকটিমের স্বামীকেও ভয়ভীতি দেখান। এ ঘটনার সূত্র ধরে তাদের মধ্যে বাগ্?বিতণ্ডা শুরু হয়। সিসিটিভি ফুটেজে ভিকটিমের স্বামীকে ভিকটিমের সামনে মারধর করতেও দেখা যায়। এর পরই তারা থানায় গিয়ে অভিযোগ করেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে র?্যাব মামুন ও তার সহযোগী মুরাদকে গ্রেফতার করে। মুরাদ জাবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হলে থাকতেন।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে র‌্যাব মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন বলেন, মামুন মাদক মামলায় চারবারের অধিক কারাভোগ করেছেন। তার নামে আটটির অধিক মাদক মামলা রয়েছে। জাহাঙ্গীরনগরের বটতলাকে কেন্দ্র করে তিনি ও তার লোকজন মাদকের সবচেয়ে বড় ঘাঁটি করেছেন। তবে নারী নির্যাতনের মামলা এটিই প্রথম। কিন্তু মামলা প্রথম হলেও মামুন এ ধরনের অপকর্ম আগেও করেছেন বলে স্বীকার করেছে। এ ধরনের অপকর্ম তারা আগেও অনেক করেছেন। তিনি নিজেও আগে এমন অনেক নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটিয়েছেন। এমনকি অনেক সিনিয়র শিক্ষার্থীর জন্য মাদক ব্যবসার আড়ালে নারী ধর্ষণের ঘটনায় তার সম্পৃক্ততা রয়েছে। ভিকটিমদের ভয়ভীতি দেখানোর কারণে ও সমাজের কাছে লজ্জায় তা অনেকেই প্রকাশ করেননি। এমন তথ্যও আমরা পেয়েছি।

তিনি আরও বলেন, শুধু মামুন নন, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আরও অনেকেই এমন অনৈতিক ও মাদকের মতো অপকর্ম নিয়মিত করছেন। আমরা বেশ কিছু নাম পেয়েছি। তাদের বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ৩১৭ নম্বর রুমকে তারা গেস্টরুম হিসেবে ব্যবহার করে এসব অপকর্ম করে আসছেন। এটা বেশ অ্যালার্মিং। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় এমন ঘটনা খুবই নেতিবাচক। শুধু জাহাঙ্গীরনগর নয়, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা আসলে কেমন তা নিয়েও এখন ভাববার বিষয়। মামুনের মতো লোকজন নিজেরা অপকর্ম করার জন্য এ ধরনের কাজ করছেন। আমাদের অভিভাবক, শিক্ষকসমাজ ও গণমাধ্যমের এ বিষয়ে কঠোর ভূমিকা নেওয়া উচিত।

এর আগে ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত জাহাঙ্গীরগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেতা মোস্তাফিজুর রহমান, হাসান প্রান্ত, ৪৬তম ব্যাচের সাগর সিদ্দিকী ও উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের সাব্বির হাসানকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

সর্বশেষ খবর