রবিবার, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা
বর্ধিত সভায় শেখ হাসিনা

উপজেলা নির্বাচন উন্মুক্ত, সংঘাতে ব্যবস্থা

♦ সংসদ নির্বাচন কেউ প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারেনি ♦ বন্ধ করতে হবে অবৈধ মজুতদারি, চাঁদাবাজি

নিজস্ব প্রতিবেদক

উপজেলা নির্বাচন উন্মুক্ত, সংঘাতে ব্যবস্থা

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, উপজেলা নির্বাচন উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এই নির্বাচনে কোনো সংঘাত চাই না। যিনি এর সঙ্গে জড়িত থাকবেন, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গতকাল সকালে গণভবনে আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিত সভায় তিনি এ কথা বলেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর পর আওয়ামী লীগের এই বিশেষ বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হলো। দলের কার্যনির্বাহী সংসদ, উপদেষ্টা পরিষদ, জাতীয় পরিষদ, দলীয় এমপি, স্বতন্ত্র এমপি ও স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধি, জেলা-উপজেলার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ ৩ হাজারের অধিক নেতা এতে অংশ নেন। বিশেষ বর্ধিত সভায় স্বতন্ত্র বনাম দলীয় এমপিদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসন, পণ্যের মজুদদারি ও পরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধে জনপ্রতিনিধি/নেতা-কর্মীদের উদ্যোগ গ্রহণসহ জেলা-উপজেলার সম্মেলন করার তাগিদ দেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। এ সভাকে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের মিলন মেলা হিসেবে উল্লেখ করেন দলীয় সভানেত্রী।

অতীতে বর্ধিত সভায় জেলা-উপজেলার নেতারা বক্তৃতা করার সুযোগ পেলেও এবার কাউকে বক্তব্য রাখার সুযোগ দেওয়া হয়নি। কারও কোনো কথা থাকলে তা লিখিত আকারে দলের দফতরে জমা দিতে নিদের্শ দেন শেখ হাসিনা। বেলা পৌনে ১১টায় মঞ্চে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন দলীয় প্রচার সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ ও উপপ্রচার সম্পাদক সৈয়দ আবদুল আউয়াল শামীম। শোক প্রস্তাব পাঠ করেন দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া। স্বাগত বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক, পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

উপজেলা নির্বাচন প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা আরও বলেন, ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে সাধারণ মানুষের জন্য কতটুকু কাজ করেছেন, কারা করতে পারেননি, সেটাও যাচাই-বাছাই হয়ে যাবে। জনগণের কাছে কার গ্রহণযোগ্যতা, সেটাই দেখব। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নৌকা ও দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য উন্মুক্ত রাখার কারণ নেতা-কর্মীদের জানিয়ে তিনি বলেন, নির্বাচন বানচালের জন্য অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছিল। প্রার্থিতা উন্মুক্ত না থাকলে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পাশাপাশি বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে হরণ করা হতো।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যাতে না হয়, সেজন্য ?বিরাট চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র ছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এবারের নির্বাচন নিয়েও একটা বিরাট চক্রান্ত ছিল। নির্বাচনটাই যাতে না হয়, এরকম চক্রান্ত ছিল। অর্থাৎ বাংলাদেশের মানুষ একটা নির্বাচিত সরকার হলে তাদের যে আর্থসামজিক উন্নতি হয় এটাই অনেকের সহ্য হয় না। তাই এমন একটা চক্রান্ত করা শুরু করেছিল। বিএনপি নির্বাচনে আসেনি। নির্বাচন বানচাল করার জন্য তাদের জ্বালাও-পোড়াও, অগ্নিসন্ত্রাস। সেই ২০১৩ সালে শুরু করেছিল, ২০১৪ সালেল নির্বাচন ঠেকাতে পারেনি। ২০১৮ সালে নির্বাচনে এসেও তারা নির্বাচনে জিততে পারেনি। কারন ৩০০ সিটে যদি সাড়ে ৭০০ নমিনেশন দেয় জিতবে কী করে। ঠিক এর পরবর্তীতে এসে আবার তারা নির্বাচন চায় না। চায়, অনির্বাচিত সরকার। অথচ এই বিএনপি নেত্রী একসময় বলেছিলেন ‘পাগল আর শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নন’।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে নির্বাচন হয়েছে, সেটা এখনো তাদের বিরোধীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এমনকি নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় খুনোখুনি হয়ে গেছে। কিন্তু বাংলাদেশে নির্বাচনটা অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে হয়েছে। জনপ্রশাসন, সশস্ত্রবাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করেছে। তিনি বলেন, ভোটার যেন না আসে, নির্বাচনটা যাতে অবাধ না হয়, নির্বাচনই যেন হতে না পারে, সেই চেষ্টা ছিল; যাতে নির্বাচন হওয়ার পরে নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় যে এই নির্বাচন অবাধ ?ও সুষ্ঠু হয়নি। কাজেই নিষেধাজ্ঞা দাও, ওইটা দাও। আমাদের যখন বলেছিল নিষেধাজ্ঞা দেবে, তখন আমিও বলেছিলাম, দরকার হলে আমরাও নিষেধাজ্ঞা দেব, আমরাও দিতে পারি। আমি নিষেধাজ্ঞার রীতিনীতি জানি বলেই বলেছিলাম।

শেখ হাসিনা আরও বলেন, এত কথার মধ্যে আমাদের দেশটা যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, সেদিকে লক্ষ রেখে এবারের নির্বাচন উন্মুক্ত করে দিয়েছি। কারণ, প্রতিপক্ষ থাকুক, নির্বাচনে প্রতিযোগিতা হোক, ভোটার আসবে, নিজেদের পছন্দমতো ভোট দেবে, যাকে খুশি তাকে দেবে, সেই অধিকারটুকু জনগণ পাক। সেভাবে নির্বাচন করেছি বলেই আজকে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারছে না। অনেকেই বলে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারছে না। এই কথাটা আমাদের নেতা-কর্মীদের মাথায় রাখতে হবে, মনে রাখতে হবে।

নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কারণে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, সে ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, এবারের নির্বাচন স্বতন্ত্র ও দলীয়ভাবে করতে গিয়ে অনেকের মনকষাকষি, নানারকম কিছু হয়ে গেছে। যেটা হয়ে গেছে, সেটা হয়ে গেছে, এখন ভুলে যেতে হবে। সবাই এক হয়ে কাজ করতে হবে। জনগণের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস রেখে কাজ করতে হবে। যদি কোথাও কোনো সমস্যা দেখা দেয়, তাহলে সেটা সমাধানের জন্য আমরা আছি, কেন্দ্রীয় কমিটি কাজ করবে। কিন্তু নিজেদের মধ্যে কোনো আত্মঘাতী সংঘাত যেন না হয়, সেদিকে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। দোষারোপ করার অর্থ হয় না। এবার নৌকার জোয়ার ছিল। সেই জোয়ারে যদি কেউ দাঁড়াতে না পারে সেটা কার দোষ। এটা মাথায় রাখতে হবে। দোষারোপ করে কোনো লাভ নেই। কারও কোনো রাগ-ক্ষোভ থাকলে গণভবনেই ঝেড়ে ফেলুন। ঐক্যবদ্ধ হয়ে যান। সংগঠনকে শক্তিশালী করুন। আপনারা ওয়াদা করুন- ঐক্যবদ্ধ থাকবেন তো? এ সময় উপস্থিত নেতা-কর্মীরা দুই হাত তুলে দলীয় সভানেত্রীকে ঐক্যবদ্ধ থাকার ওয়াদা করেন।

জনগণের ভোটে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হবে জেনেই বিএনপি নির্বাচন বানচাল করতে চেয়েছিল বলে মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, সেই সঙ্গে তারা জুগিয়েছিল কিছু প্রভু। তাদের নির্দেশমতো বিএনপি আন্দোলন করে। এখনো কিছু কিছু লম্ফঝম্প করছে, করতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এ দেশের জনগণের সংগঠন, এটা তাদের মনে রাখতে হবে। এটা ভেসে আসেনি কিংবা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী জেনারেল পকেট থেকে এ সংগঠন বের হয়নি। এ সংগঠন মাটি-মানুষের ভিতর থেকে বেড়ে উঠেছে। মানুষই এ সংগঠনের বড় শক্তি।

দ্রব্যমূল্য কমাতে সবাইকে উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, বিশেষ করে পরিবহনের ক্ষেত্রে, অথবা পাইকারি মার্কেটে, অথবা মজুতদারি; এসব জায়গায় চাঁদাবাজি ও মজুতদারি বন্ধ করতে হবে। এই মজুতদারি কেউ অহেতুক করতে পারবে না। পণ্য এলেই যেখানে সেখানে পাইকারি মার্কেটে চাঁদাবাজি, চলার পথে চাঁদাবাজি এগুলো বন্ধ রাখতে হবে। আপনারা এখানে বিভিন্ন এলাকার জনপ্রতিনিধিরা আছেন। আপনাদের এসবে দৃষ্টি দিতে হবে। কৃষকরা যাতে ন্যায্যমূল্য পান সেটি নিশ্চিত করতে হবে, আবার অহেতুক চাঁদাবাজি বা মজুতদারির কারণে যেন পণ্যের দাম বৃদ্ধি না পায় সেদিকেও দৃষ্টি দিতে হবে।

বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মনে রাখতে হবে, যে অর্থ আমরা ব্যয় করি, তার অর্ধেক দামে বিদ্যুৎ দিচ্ছি। কাজেই এখন থেকে যে যত বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করবে, তাকে তত বেশি দাম দিতে হবে। আমরা সেভাবে ব্যবস্থা নিচ্ছি। আর যারা একেবারে পারবে না, তাদের জন্য ছাড় আছে। কিন্তু অতিরিক্ত বিদ্যুৎ যারা ব্যয় করবে, তাদের অতিরিক্ত মূল্য দিতে হবে। বিএনপির সমালোচনা করে শেখ হাসিনা আরও বলেন, বিএনপির মাথা নেই। সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে বসে আছেন তাদের নেতা। সেখান থেকে হুকুম দেন। এতে অবশ্য ভালো হয়েছে। আগে বিএনপি চুপিসারে আগুন দিত গাড়িতে, রেলে, সব জায়গায়। এবার তারা প্রকাশ্যে দিয়েছে, আবার ছবি তুলেছে। তাদের গুরু লন্ডন থেকে বলে দিয়েছে যে ছবি পাঠাতে হবে। তারা পাঠাচ্ছে। ডিজিটাল দেশ। যেভাবেই পাঠাক সব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। ফলে তারা যে আগুন দিচ্ছে, সেই ছবি আর সাক্ষ্যপ্রমাণটা পাওয়া যাচ্ছে। যে যে এলাকায় এই ঘটনাগুলো ঘটেছে, এগুলো জোগাড় করে... এই মামলাগুলো যেন ঠিকমতো চলে এবং শাস্তিটা যেন পায়। তাদের নেতাই তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছে। কাকে দোষ দেবে। নেতাকে খুশি করতে ছবি তুলেছে, পাঠিয়েছে। এখন ডিজিটাল সিস্টেমে যেভাবেই পাঠাক, সংগ্রহ করা কোনো কঠিন ব্যাপার না। সেভাবে প্রমাণগুলো এসেছে।

জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সবাইকে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দুর্নীতির অর্থ কোনো ভালো কাজে লাগে না, বরং তাদের সন্তানরাই বিপদে পড়বে। এই বদনাম যেন না হয়, সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। একটা কথা মনে রাখবেন, নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। কেউ জয়ী হয়েছেন, কেউ জয়ী হতে পারেননি। কিন্তু কিছু ভোট তো পেয়েছেন। সেটি মাথায় রেখে জনগণের আস্থা, বিশ্বাস যেন নষ্ট না হয়, সেটি আপনাদের চলনে-বলনে প্রমাণ করতে হবে। আপনারা সেভাবে কাজ করবেন, সেটিই চাই। যারা নির্বাচিত হয়েছেন জনগণের সেবা করবেন। কারণ জনগণকে যে ওয়াদা দিয়েছেন, তা বাস্তবায়ন করতে হবে।

আন্দোলন করে আওয়ামী লীগই জনগণের ভোট ও ভাতের অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছে উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, সরকার যে মানুষের সেবক এবং সরকারের দায়িত্ব যে মানুষের কল্যাণ করা, সেটি একমাত্র আওয়ামী লীগ যখন সরকারের এসেছে, তখনই এ দেশের মানুষ সেটা উপলব্ধি করেছে এবং সেই সুযোগট পেয়েছে। কোনো দলের একটানা চারবার জনগণের ভোটের ক্ষমতায় আসা এটা কিন্তু সহজ কাজ না। আমরা জনগণের কল্যাণে কাজ করেছি। জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছি, আমাদের উন্নয়নটা তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত। সমাজের প্রত্যেকটা স্তরের মানুষ কেউ যেন অবহেলিত না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রেখে আমাদের পরিকল্পনা নিয়েছি এবং বাস্তবায়ন করেছি। ফলে জনগণের আস্থা, বিশ্বাস আমরা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ধারাবাহিকভাবে ১৫-২০ বছর ক্ষমতায় একই সরকার না থাকলে উন্নয়নটা হয় না এবং উন্নয়নটা টেকসই করা যায় না। নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, ভালো কাজ করতে গেলে সেটি প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা হয়। কিন্তু হয়ে গেলে সেটার সুবিধা তারাও নেয়। তাই যে যাই বলুক, আমাদের আত্মবিশ্বাস নিয়ে চলতে হবে। যারা নির্বাচিত প্রতিনিধি তারা তৃণমূল পর্যন্ত যে ওয়াদা জনগণের কাছে দিয়ে এসেছেন, তা পূরণ করতে হবে।

দেশি-বিদেশি যত চক্রান্তই হোক বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা কেউ থামাতে পারবে না প্রত্যয় ব্যক্ত করে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, সব ষড়যন্ত্র চক্রান্ত রুখে দিয়ে এবার যেভাবে নির্বাচন হয়েছে, তেমনি অর্থনৈতিক উন্নয়নটাও আমরা করে যাব। ২০৪১ সালের মধ্যে ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত স্মার্ট সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলব।

 

সর্বশেষ খবর