মঙ্গলবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

ডেইলি স্টার সাংবাদিকের বাসায় নিহত গৃহকর্মীর মায়ের আর্তনাদ

নিজস্ব প্রতিবেদক

দরিদ্র পরিবারে জন্মেছিল প্রীতি ওরাং। সে জন্য শৈশব থেকেই দেখেছে সংসারের অভাব-অনটন। চা-শ্রমিক মা-বাবা নিরুপায় হয়ে নিরাপদ জীবনের আশায় মাত্র ১৩ বছর বয়সেই গৃহকর্মী হিসেবে প্রীতিকে পাঠিয়ে দেন ঢাকায়। কিন্তু সেই আশাই কাল হলো। নিরাপদ জীবন নিয়ে আর মায়ের বুকে ফেরা হলো না প্রীতির। ফিরেছে লাশ হয়ে। প্রাণপ্রিয় সন্তানকে হারিয়ে এখন পাগলপ্রায় মমিতা ওরাং। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হকের বাসায় কিশোরী গৃহকর্মী প্রীতি ওরাংয়ের মৃত্যুর পর কোনোভাবেই থামছে না মায়ের আর্তনাদ। সাংবাদিকদের কাছে পেয়ে বারবার বলছিলেন, নিরাপদ জীবনের আশায় কলিজার টুকরারে ঢাকায় পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু ফেরত পেলাম মেয়ের লাশ। আমি আমার মেয়ের হত্যার বিচার চাই। এদিকে চাঞ্চল্যকর এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেছে দুই মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ (এইচআরএফবি) ও নারীপক্ষ।

৬ ফেব্রুয়ারি সকালে মোহাম্মদপুরের শাজাহান রোডের বহুতল বাড়ির নিচতলা থেকে গৃহকর্মী প্রীতিকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধারের পর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায় স্থানীয়রা। চিকিৎসক জানান, হাসপাতালে নেওয়ার আগেই তার মৃত্যু হয়েছে। ওই ভবনের নবম তলায় থাকেন ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হক। প্রীতি ওরাং ছিল ওই বাসার গৃহকর্মী।

জানা গেছে, ৭ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা থেকে প্রীতির লাশ কমলগঞ্জ উপজেলার মিতিঙ্গা চা-বাগানে নিয়ে গেলে গোটা এলাকায় নেমে আসে শোকের ছায়া। শোকে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে চা-বাগান এলাকার মানুষ। প্রীতির এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছে না কেউ। প্রীতির শেষকৃত্যের তিন দিন পেরিয়ে গেছে। অথচ পুরো চা-বাগান এলাকায় এখনো শোকের আবহ। সরেজমিন মিতিঙ্গা চা-বাগানের ফাঁড়ি বাগান হালকি টিলায় গেলে দেখা যায়, প্রীতির বাবা লুকেশ ওরাং, মা নওমিতা ওরাং, বোন স্বপ্না ওরাং ও ভাই সঞ্জয় ওরাং উঠানে বসে বিলাপ করছেন। প্রীতির বাবা চা-শ্রমিক লুকেশ ওরাং বলেন, ‘মৌলভীবাজারের স্থানীয় সাংবাদিক মিন্টুর ওপর আস্থা রেখে মেয়েকে ঢাকায় দিয়েছিলাম। তখন তারা বলেছিল, সেখানে আমার মেয়ে ভালো খাবে, সুখে থাকবে এবং বাসায় বাচ্চাদের সঙ্গে খেলাধুলা করবে। মাসে মাসে টাকাও দেবে। কিন্তু আমার মেয়েটি লাশ হয়ে অ্যাম্বুল্যান্সে করে বাড়ি ফিরল। আমি আমার সন্তান হত্যার বিচার চাই।’

তিনি বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ, দিন আনি দিন খাই। মিন্টু আমাকে অনেক ধরনের প্রলোভন দেখিয়েছিল। মেয়ের নিরাপদ জীবনের কথা বলেছিল। আমি একপর্যায়ে তার কথায় রাজি হয়ে গেলাম। মেয়ে পাঠানোর প্রথম দিকে ১০ হাজার টাকা দেয়, পরে আরও ৫ হাজার টাকা দেয় মিন্টু। এরপর আর কোনো টাকা-পয়সা দেয়নি। কোনো দিন ওই বাসায়ও নিয়ে যায়নি।’ লুকেশ বলেন, ‘ঢাকায় যাওয়ার দুই বছরে আমার মেয়েকে একটিবারও দেখতে দেয়নি ওরা। মেয়েকে একটি দিনের জন্যও ছুটি দেয়নি। নানা অজুহাত দেখাত। মাসে দুই-একবার গৃহকর্তার মোবাইলে ওর মায়ের সঙ্গে কথা বলতে দিত।’ এ সময় প্রীতির মা নওমিতা ওরাং বিলাপ করতে করতে বলেন, ‘আমার মেয়েকে বিয়ে দিতে যেসব খরচপাতি লাগবে, সব টাকা দেবে বলেছিল ওই সাংবাদিক। মিন্টু সাংবাদিক বলল, তোমার মেয়েকে দেও ওই বাসায়, সাংবাদিকের একটি বাচ্চার সঙ্গে খেলাধুলা করবে, ভালো খাইবে। আমার মেয়েকে নিয়ে মেরে ফেলবে, এই কথা তো আমার জানা ছিল না। ওকে নিরাপদ জীবনের আশায় পাঠিয়ে ফেরত পেলাম লাশ।’

হত্যার অভিযোগ তুলে প্রীতির চাচা লগেন ওরাং বলেন, ‘মেয়েকে নিশ্চয়ই নির্যাতন করে মেরে ফেলেছে।’ নিহত প্রীতির সহপাঠী প্রতিবেশী কিশোরী কবিতা ওরাং বলে, ‘আমি প্রীতি হত্যার বিচার চাই।’ একই কথা প্রীতির সহোদর বোন স্বপ্না ওরাংয়ের।

মিতিঙ্গা চা-বাগানের হালকি টিলার পূর্ব লাইনের বাসিন্দা অমৃত ওরাং বলেন, ‘প্রীতির সঙ্গে এমন কোনো কাজ করছে, যা ঘরের কেউ হয়তো দেখেছে। তাই তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে মেরে ফেলা হইতে পারে বলে আমার ধারণা।’ বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের মনু-দলই ভ্যালির সভাপতি ধনা বাউরি বলেন, ‘প্রীতি ওরাংয়ের মৃত্যু আসলেই দুঃখজনক। প্রীতি যে ঢাকায় ওই সাংবাদিকের বাসায় কাজ করতে গেছে, সেটা বাগানের কেউই জানে না। প্রীতির মা ও বাবার সঙ্গে কথা বলে সাংবাদিক মিন্টু দেশোয়ারা গোপনে তাকে ঢাকায় পাঠায়। আমি প্রীতি হত্যায় জড়িতদের তদন্তসাপেক্ষে সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।’ কমলগঞ্জ উপজেলার রহিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইফতেখার আহমদ বদরুল বলেন, ‘তদন্ত করে প্রীতি হত্যার প্রকৃত ঘটনা সঠিকভাবে উদঘাটনের দাবি জানাচ্ছি।’

সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবি : গৃহকর্মী প্রীতি ওরাংয়ের (১৫) মৃত্যুর ঘটনায় শাস্তির দাবি করেছে দুই মানবাধিকার সংগঠন। এই ঘটনার উদ্বেগ প্রকাশ করে হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ (এইচআরএফবি) ও নারীপক্ষ কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি করেছে। তারা বলছে, গত বছরের ৬ আগস্ট ৯ বছরের শিশু গৃহকর্মী ফেরদৌসীও ওই বাসা থেকে নিচে পড়ে মারাত্মক আহত হয় এবং তার ওপরে নানা ধরনের নির্যাতনের খবর প্রকাশ পায়। সংগঠন দুটির পক্ষ থেকে এই ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত এবং বিচারের দাবি জানিয়ে প্রীতির পরিবারের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানায়। গতকাল এইচআরএফবি এক বিবৃতিতে জানায়, এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ এবং গৃহকর্মীদের সুরক্ষা ?নিশ্চিত করার জন্য ফোরাম কিছু দাবি জানায়। গৃহকর্মী হিসেবে শিশুদের ব্যবহার বন্ধ করা এবং এই ব্যাপারে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে উদ্যোগ নেওয়া। গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি ২০১৫ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা এবং এ নীতির আলোকে গৃহকর্মীদের সুরক্ষায় আইন প্রণয়ন করা। গৃহকর্মীদের কাজকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা। গৃহকর্মীদের নিবন্ধন জোরদার করার জন্য রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো থেকে সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার দাবি জানানো। অন্যদিকে নারীপক্ষের বিবৃতিতে বলা হয়, সরকার, পুলিশ প্রশাসন ও বিচার বিভাগের কাছে নারীপক্ষর দাবি- প্রীতি উরাংয়ের মৃত্যুর নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটন করে দোষী প্রত্যেক ব্যক্তিকে বিচারের সম্মুখীন করা হোক। একজন দোষীও যেন কোনোরকম প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে বা আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে বেরিয়ে যেতে না পারে সে বিষয়টি নিশ্চিত করা এবং এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণেরও দাবি জানাচ্ছে নারীপক্ষ।

সর্বশেষ খবর