শিরোনাম
মঙ্গলবার, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা
পুলিশ সপ্তাহ

বিতর্কের বাইরে শুধুই ৯৯৯

বেহাল নাগরিক সেবা, হয়রানি নয় সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান চায় সবাই

সাখাওয়াত কাওসার

বিতর্কের বাইরে শুধুই ৯৯৯

মোহাম্মদ তবারাক উল্লাহ

‘স্মার্ট পুলিশ, স্মার্ট দেশ; শান্তি প্রগতির বাংলাদেশ’ স্লোগানে আজ শুরু হচ্ছে পুলিশ সপ্তাহ। বর্ণাঢ্য আয়োজন, বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং আনন্দমুখর পরিবেশে অন্য বছরের মতো এবারও আয়োজনের কোনো কমতি নেই। পুলিশের বিভাগগুলোর মধ্যে সব ধরনের বিতর্কের বাইরে থেকে ‘২৪/৭’ সেবা দিয়ে পুলিশ সপ্তাহের শুরুতেই সব মহলে প্রশংসিত হচ্ছে জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’। এরই মধ্যে পুলিশের বিশেষায়িত এ ইউনিটটি গণমানুষের আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছে। পাহাড়-সাগর-গহিন জঙ্গল থেকে শুরু করে যে কোনো স্থানেই সংকটে পড়ে থাকা সাধারণ মানুষকে সাহায্যের জন্য পাশে দাঁড়িয়েছে ৯৯৯। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হয়রানি নয়, নাগরিকের সেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা পুলিশ সপ্তাহের প্রত্যাশা।

পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তারা বলছেন, বিপদে-আপদে সাধারণ মানুষকে আরও দ্রুত সহায়তা দেওয়ার লক্ষ্যে নতুন আঙ্গিকে সাজানো হচ্ছে জাতীয় এ সেবা ইউনিটকে। একসঙ্গে আরও ১০০ কল রিসিভ করার জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণের অনুমতি পেয়েছে। আগামী অর্থবছরে অর্থছাড়ের পর অল্প সময়ের মধ্যেই এটি কাজ শুরু করবে। ইতোমধ্যে পূর্বাচলে ৯৯৯-এর আরও অফিসের স্থানও ঠিক করেছে কর্তৃপক্ষ।

জরুরি সেবা ইউনিটটির প্রধান ও পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ তবারাক উল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘অসহায় বিপদগ্রস্ত মানুষকে সহায়তা করার ব্রিজ হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন আমাদের প্রত্যেক সদস্য। ভবিষ্যতেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে। আমরা পূর্বাচলে আরও ১০০ ওয়ার্ক স্টেশন করার অনুমতি পেয়েছি। আগামী অর্থবছর আমরা কাজ শুরু করতে পারব বলে আশা করছি। তবে ৫০০ ওয়ার্ক স্টেশন এবং ১ হাজার ৮৪৭ জনবলের প্রস্তাব দেওয়া আছে। কারণ লোকবল সংকটেও অনেক সময় সেবা দিতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়।’

‘অহেতুক’ কলের কথা উঠে এলো এই কর্মকর্তার কথায়ও। তিনি বলেন, ‘সেবাপ্রার্থীদের সঙ্গে আমরা অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে কথা বলি। অথচ মাঝে মাঝে এমন এমন কল আসে, বিরক্তিকর। কোনো কারণ ছাড়াই অহেতুক ফোন দেয়। মাঝরাতে অযথা ফোন দিয়ে ডিস্টার্ব করে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আসলে জাতীয় জরুরি সেবা-৯৯৯ সবার কাছেই আস্থা অর্জন করেছে। এ ধারা অব্যাহত রাখতে নীতিনির্ধারকদের আরও নতুন করে ভাবতে হবে যাতে এ ইউনিটটি কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি না হয়।’

অসহায় বিপদগ্রস্ত মানুষকে সহায়তা করার ব্রিজ হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন আমাদের প্রত্যেক সদস্য। ভবিষ্যতেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে।

তিনি আরও বলেন, ‘সময়ের প্রেক্ষাপটে মানুষের জীবনে চাহিদার ধরন, সংকটের উপস্থিতি কিংবা জীবনযাত্রার বৈচিত্র্যের কারণে বিভিন্ন পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। তবে যে পরিমাণ সাহায্যপ্রার্থীর ফোন আসে তার সঙ্গে তাল রেখে সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা বিলম্বিত ভূমিকা দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে ৯৯৯ সেবা প্রাতিষ্ঠানিক মোড়কে মানুষের তাৎক্ষণিক সমস্যার সমাধানে কার্যকরভাবে ব্যবহারের পরিকল্পনা নিয়ে ভাবা উচিত। বিশেষ করে রাজধানীসহ বড় শহরগুলোর মানুষের সমস্যার ধরন ও বৈচিত্র্যের জন্য এ সেবা আরও ব্যাপক পরিসরে চালু করা প্রয়োজন।’

বিপদে থাকা সাধারণ মানুষকে সহায়তা দিতে ৯৯৯ সদস্যরা সদাপ্রস্তুত। অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী হয়ে মানুষের বিশ্বস্ততার প্রতীক হয়ে উঠেছে ৯৯৯।

১০ ফেব্রুয়ারি পাচার হতে যাওয়া এক নারী ফোন করেন জরুরি সেবা ৯৯৯-এ। কল রিসিভ করেন কলটেকার কনস্টেবল মমিনুর রহমান। ওই প্রান্ত থেকে ওই নারী বলেন, তিনিসহ আরও দুই নারীকে সীমান্তবর্তী জেলা ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার যাদবপুর ইউনিয়নের জলুলী গ্রামের একটি বাড়িতে বন্দি করে রাখা হয়েছে। যে কোনো সময় তার কাছ থেকে মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হতে পারে। হয়তো শিগগিরই তাদের ভারতে পাচার করে দেওয়া হবে। পরে ডেসপাচার এসআই মহিউদ্দীন মুন্না কলার এবং সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখেন। এক পর্যায়ে মহেশপুর থানা পুলিশের এসআই শরীফুজ্জামানের নেতৃত্বে একটি দল তিনজনকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। উদ্ধারকৃত নারীরা রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকার বাসিন্দা। তাদের মুন্নী নামে এক নারী ভারতে ভালো চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে মহেশপুর পর্যন্ত নিয়ে আসেন। পরে ওই বাড়িতে অবস্থানের সময় প্রকৃত সত্য সম্পর্কে তারা অবগত হন।

ইঞ্জিন বিকল হয়ে মিয়ানমার জলসীমায় ঢুকে পড়া ফিশিং ট্রলারকে ৯৯৯-এর সহায়তায় মিয়ানমার নৌবাহিনীর হেফাজত থেকে ১৫ জেলেসহ উদ্ধার করে কোস্টগার্ড। ৩ জানুয়ারি চট্টগ্রামের আনোয়ারার গহিরা উপকূল থেকে মা-মণি নামে একটি ফিশিং ট্রলার সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে ইঞ্জিন শ্যাফট ভেঙে বোটটি বিকল হয়ে সাগরে ভাসতে থাকে। ৪ জানুয়ারি থেকে পরবর্তী ১০ দিন বোটটির কোনো খবর পাওয়া যায়নি। ১৪ জানুয়ারি মিয়ানমারের একটি ফিশিং ট্রলার সাগরে ভাসমান বিকল বোটটি দেখতে পায় এবং বোটটি টেনে মিয়ানমার-বাংলাদেশ জলসীমায় নিয়ে যায়। এরপর বোটের একজন কালু মাঝি বোটের মালিককে ফোনে জানান তারা মিয়ানমার নৌবাহিনীর হেফাজতে আছেন। ১৪ জানুয়ারি রাত ৮টায় বোটমালিক ওবায়দুল হক ৯৯৯-এ ফোন করে সহায়তা চান। পরে সেন্টমার্টিন কোস্টগার্ডের উদ্ধারকারী দল মিয়ানমার-বাংলাদেশ জলসীমায় গিয়ে মিয়ানমার নৌবাহিনীর হেফাজত থেকে ১৫ জেলেসহ বিকল বোটটি উদ্ধার করে সেন্টমার্টিন নিয়ে আসে।

গার্মেন্টে চাকরির কথা বলে একজন যুবতীকে (২২) ঝিনাইদহ থেকে ঢাকার শান্তিনগর নিয়ে আসেন পরিচিত এক ব্যক্তি। এরপর তাকে ময়মনসিংহ গাঙ্গিনারপাড় যৌনপল্লীতে বিক্রি করে দেওয়া হয়। টানা তিন মাস তাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে দেহব্যবসায় বাধ্য করা হয়। এমন তথ্য জানিয়ে ২ ডিসেম্বর রাত ৯টায় একজন খদ্দেরের ফোন ব্যবহার করে এক যুবতী ৯৯৯-এ ফোন করে তাকে উদ্ধারের ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানান। পরে ময়মনসিংহ কোতোয়ালি থানা পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে গিয়ে ওই যুবতীকে উদ্ধার করে অভিভাবকের কাছে বুঝিয়ে দেয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সবার ভরসা এখন সরকারি জরুরি সেবা ৯৯৯। অসংখ্য গল্পের সাক্ষী হচ্ছেন সংস্থাটিতে কর্মরতরা। বাল্যবিয়ে, গৃহকর্মী নির্যাতন, পারিবারিক নির্যাতন, সাইবার অপরাধ, ধর্ষণ, অগ্নিকাণ্ড, সড়ক দুর্ঘটনা, নৌদুর্ঘটনাসহ যে কোনো বিপদে মুহূর্তের মধ্যে সাড়া দিচ্ছে ৯৯৯।

জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ কল সেন্টার থেকে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ৯৯৯-এ সারা দেশ থেকে মোট ৫ কোটি ২৪ লাখ ৩৬ হাজার ৩৪৮টি কল এসেছে। তবে এর মধ্যে কোনো কারণ ছাড়াই ‘অহেতুক’ কল এসেছে ৩ কোটি ১ লাখ ৩৯ হাজার ৮১৬টি। আর যারা সত্যিকার অর্থে সেবা পাওয়ার জন্য ফোন করেছেন তাদের মধ্যে সার্ভিস দেওয়া সম্ভব হয়েছে ২ কোটি ২২ লাখ ৯৬ হাজার ৫৩২ জনকে। এসব কলের মধ্যে মিসকল ৫০ লাখ ২৯ হাজার ৫৪৪টি। ব্লাঙ্ক কল ২ কোটি ২৬ লাখ ৮২হাজার ২২৮টি। ৯৯৯-এ জরুরি প্রয়োজনে সেবা পেতে আসা কলগুলোর মধ্যে পুলিশি সহায়তা পেতে কল এসেছে ১৩ লাখ ৩৭ হাজার ৮০টি। এ ছাড়া অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৭৩টি এবং অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের জন্য ১ লাখ ৪৫ হাজার ১৪৮টি কল আসে।

৯৯৯-এর কলারদের মধ্যে ৮৯ লাখ ৬২ হাজার ১৬৩ জন পুরুষ, ১২ লাখ ৫৩ হাজার ১১৫ শিশু, ৪ লাখ ৫২ হাজার ৬৭৭ জন নারী। তা ছাড়া সেবা নিতে ডিপার্টমেন্টাল কল এসেছে ১ লাখ ৩৭ হাজার ১২৭টি।

পুলিশ টেলিকম সংস্থার অধীনে বর্তমানে একজন অতিরিক্ত ডিআইজির নেতৃত্বে বিভিন্ন পদের ৪২৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী তিন শিফটে রাতদিন (২৪ ঘণ্টা) সপ্তাহে সাত দিন কাজ করছেন ৯৯৯-এ। ৯৯৯-এর বর্তমান সক্ষমতা একসঙ্গে ১০০ কল রিসিভ করতে পারা। খুব শিগগিরই পূর্বাচলে ১০০ ওয়ার্ক স্টেশন কাজ শুরু করবে। এজন্য জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ৫৪৯ পদের অনুমতি পাওয়া গেছে। আগামী অর্থবছরে অর্থছাড়ের পরপরই আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু করা হবে।

সংস্থাটির জনসংযোগ ও মিডিয়া শাখার পুলিশ পরিদর্শক আনোয়ার সাত্তার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সরকারের এ বিভাগটি একেবারে আলাদা। এখানে সাহায্য নিতে, সাহায্য চাইতে কেউ দ্বিধাবোধ করে না। সব সময় চেষ্টা করি সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার। আমরা সব সময় আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করি।’

পুলিশ সপ্তাহ শুরু আজ

‘স্মার্ট পুলিশ, স্মার্ট দেশ; শান্তি প্রগতির বাংলাদেশ’ স্লোগানে আজ শুরু হচ্ছে পুলিশ সপ্তাহ। সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজারবাগ পুলিশ লাইনস মাঠে বার্ষিক পুলিশ প্যারেডে ছয় দিনব্যাপী এ অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করবেন। চলবে ৩ মার্চ পর্যন্ত।

পুলিশ সদর দফতর জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী পুলিশের বিভিন্ন কন্টিনজেন্ট ও পতাকাবাহী দলের সুশৃঙ্খল ও দৃষ্টিনন্দন বর্ণিল প্যারেড পরিদর্শন এবং অভিবাদন গ্রহণ করবেন। পরে তিনি পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশে দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ দেবেন। পুলিশ সদস্যদের কল্যাণ প্যারেডে অংশ নেওয়ার পর কৃতিত্বপূর্ণ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ৪০০ পুলিশ সদস্যকে বিপিএম ও পিপিএম পদক তুলে দেবেন।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

এ ছাড়া আগামীকাল প্রশংসনীয় ও ভালো কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পুলিশের ৪৮৮ জনকে আইজিপি ব্যাজ পরিয়ে দেবেন আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তিনি ব্যাজপ্রাপ্তদের হাতে সনদও তুলে দেবেন।

ভালো লোক নিয়োগ দিতে হবে

পুলিশের মন্দ কাজ করার সুযোগ বেশি

উপনিবেশ চিন্তা থেকে বের হতে পারেনি

 

সর্বশেষ খবর