মঙ্গলবার, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

অবৈধ পথে যুবকরা ছুটছে ইতালি

১০ বছরে নিহত শতাধিক, ৩২৯ মামলার বিচার হয়নি একটিরও

বেলাল রিজভী, মাদারীপুর

অবৈধভাবে সমুদ্রপথে ইতালি যাওয়ার ঘটনায় বাড়ছে প্রাণহানি। দালালের প্রলোভনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুবকরা সমুদ্র পারি দিতে গিয়ে পড়ছে মৃত্যুর মুখে। এতে নিঃস্ব হচ্ছে অনেকেই। ১০ বছরে মাদারীপুরে ৩২৯টি মানব পাচার মামলা হলেও বিচার হয়নি একটিরও। অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করছেন- এ জন্যই বেপরোয়া হয়ে উঠছে দালালচক্র। সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুললে এই অপরাধ কমবে বলে দাবি পুলিশের। ভুক্তভোগী পরিবার ও কয়েকটি এলাকা ঘুরে জানা যায়, কোনোভাবেই থামছে না অবৈধপথে ইতালি যাওয়ার প্রবণতা। ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে বাড়ছে প্রাণহানি। ১০ বছরে মারা যাওয়ার মধ্যে মাদারীপুরের রয়েছে শতাধিক যুবক। এখনো নিখোঁজ অনেকেই। সবশেষ গত ১৪ ফেব্রুয়ারি তিউনিশিয়ায় নৌকায় আগুন ধরে মারা যাওয়া আট বাংলাদেশির মধ্যে পাঁচজনই মাদারীপুরের বাসিন্দা। স্থানীয়রা জানান, এলাকার তরুণ-যুবকরা দালালের খপ্পরে পড়ে। প্রলোভনে পড়ে ভিটেমাটি বিক্রি করার পাশাপাশি সুদে টাকা এনে সন্তানদের অবৈধভাবে বিদেশে পাঠান অভিভাবকরা। দুর্ঘটনায় আদরের সন্তান মারা যাওয়ায় নিঃস্ব হয় পরিবারগুলো। মানবধিকার কর্মীরা বলছেন, দালালচক্রকে নির্মূল না করায়, একের পর এক নৌকাডুবিতে মারা যাচ্ছে মানুষ। প্রতিরোধে প্রয়োজন জনপ্রতিনিধিদের আন্তরিকতা আর সচেতনতা বৃদ্ধি। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রচ্ছায়ায় জেলাজুড়ে গড়ে উঠেছে একাধিক দালালচক্র। থানায়ও রয়েছে বড় সিন্ডিকেট। যদিও পুলিশ বলছে, শুধু আইনের প্রয়োগেই থামবে না এ অপরাধ। গড়ে তুলতে হবে সামাজিক আন্দোলন। জেলা পুলিশের তথ্য মতে, গত ১০ বছরে মাদারীপুরে ৩২৯টি মানব পাচার মামলা হয়েছে। এর মধ্যে মীমাংসা হয়েছে ১১১টি মামলার। বিচার হয়নি একটিরও। এমন দুর্ঘটনায় নিহতের স্বজনদের অনেক সময় মামলাও করতে দেয় না দালালচক্র। সামান্য কিছু টাকা দিয়ে মীমাংসার চেষ্টা চালায় তারা। এতে কমছে না এমন দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা। একাধিক সূত্র জানায়, ২০১৩-২০২৩ এই ১০ বছরে মাদারীপুরে আদালত ও থানায় মানব পাচারের মামলা হয়েছে ৩২৯টি। এর মধ্যে জেলার বিভিন্ন থানায় মামলার সংখ্যা ২৯২টি ও আদালতে ৩৭টি মামলা দায়ের হয়। মামলায় মোট আসামি ১ হাজার ৪৬৬ জন হলেও গ্রেফতার হয় মাত্র ২৮৭ জন। আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয় ৯৬টি মামলার, আদালতে চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা পড়ে ৮৭টি মামলার। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত ১১১টি মামলা মীমাংসা হওয়ায় বাদী মামলা প্রত্যাহার করেছেন। গত ১০ বছরে অবৈধপথে ইতালি পাড়ি জমিয়েছেন ৫ হাজার ৫০০ জন। বিভিন্ন মামলা, ভুক্তভোগী স্বজন ও জেলা পুলিশ সূত্রে দালালদের তালিকায় যাদের নাম পাওয়া গেছে তারা হলো, গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের সুন্দরদী গ্রামের মোশারফ কাজী, একই উপজেলার গজারিয়া গ্রামের রহিম শেখ, মাদারীপুর সদর উপজেলার কুমড়াখালী গ্রামের এমদাদ বেপারী, একই উপজেলার বড়াইলবাড়ীর জামাল খান, দক্ষিণপাড়ার সামাদ বেপারী, চর-নাচনার আতিবর মোড়ল ও কাশেম মোড়ল, বড়াইলবাড়ী গ্রামের সবুজ মীরা, জামাল খান, রুবেল খাঁ, সুমন মীরা, শ্রীনাথদি বাজিতপুরের জাহাঙ্গীর হাওলাদার, চাছার গ্রামের ইউসুফ খান জাহিদ, গাছবাড়িয়া গ্রামের নাসির শিকদার, রাজৈর উপজেলার বদরপাশা গ্রামের জুলহাঁস তালুকদার, একই উপজেলার তেলিকান্দি গ্রামের মনিকা বেগম, শাখারপাড়ের কামরুল মোল্লা ও এমরান মোল্লা, আমগ্রাম কৃষ্ণারমোড় এলাকার শামীম ফকির ও সম্রাট ফকির, শিবচর উপজেলার দত্তপাড়া গ্রামের শহিদুল মাতুব্বর ও সিরাজ মাতুব্বর। মানবধিকারকর্মী মশিউর রহমান পারভেজ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে অবৈধপথে ইতালি যাওয়ার সময় মাদারীপুরের যুবকরা মৃত্যুর মুখে পড়েন। মারাও গেছেন অনেকে। দালালদের বিচার না হওয়ার কারণেই এই অপরাধ কমছে না। মানব পাচারের ঘটনায় দালালদের কঠিন বিচার হলে সমাজ থেকে এই অপরাধ কমিয়ে আনা সম্ভব। মাদারীপুর আদালতের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবদুলাহ আল মামুন বলেন, এলাকাভিত্তিক গড়ে উঠেছে দালালচক্র। এই চক্রটি শক্তিশালী হওয়ায় বাদীকে অনেক সময় মামলা তুলে নিতে ভয়ভীতি দেখায়। এতে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে দালালরা। মাদারীপুরের পুলিশ সুপার মাসুদ আলম জানান, শুধু আইনের প্রয়োগ করেই দালাল নির্মূল করা সম্ভব নয়। প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন। পাশাপাশি জনপ্রতিনিধিদের সচেতনা বৃদ্ধি করতে হবে। তাহলে সমাজ থেকে দালাল নির্মূল হবে। এ ছাড়া মানব পাচার মামলায় অনেক দালাল গ্রেফতারের পর জামিনে বেরিয়ে আবার একই কাজে জড়াচ্ছে। সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুললেই এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না।

সর্বশেষ খবর