শুক্রবার, ৮ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

সহিংসতা হয়রানি ঘরে-বাইরে

বিশেষ প্রতিনিধি

সহিংসতা হয়রানি ঘরে-বাইরে

বরিশালের পুরানপাড়ার ২০ বছর বয়সী সাদিয়া গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেছেন গত সোমবার। মাত্র দেড় মাস আগে তার বিয়ে হয়েছিল। সাদিয়াকে স্বর্ণালংকার, ফ্রিজসহ বরকে চেইন ও আংটি দিয়ে বিয়ে দিয়েছিল পরিবার। খরচ হয়েছিল প্রায় ৮ লাখ টাকা। কিন্তু পাষণ্ড স্বামী রুবেল শুরু থেকেই যৌতুকের দাবিতে করেন নির্যাতন। বিদেশ যাওয়ার জন্য ৩ লাখ টাকা চেয়ে রবিবার বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেন সাদিয়াকে। টাকা না দিলে তালাক দেওয়ার হুমকি দেন। বাড়ি গিয়ে পরদিন বিকালে ঘরে কেউ না থাকার সুযোগে আত্মহত্যা করেন সাদিয়া।

সাদিয়া আত্মহত্যা করলেও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষাজীবন শেষ করে ঢাকায় চাকরি করা শারমিন তার স্বামীর নির্যাতন থেকে বাঁচতে নিজেই ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। গত মঙ্গলবার ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনে আবেদন করেন ডিভোর্সের। নিজের তিন বছরের সন্তান নিয়ে আলাদা জীবনযাপনের পরিকল্পনা তারন। শারমিনের শিক্ষিত স্বামী আল-আমিন প্রচণ্ড সন্দেহবাতিক। সন্দেহ থেকেই স্ত্রীকে করতেন মানসিক নির্যাতন। একপর্যায়ে শারীরিক নির্যাতনও শুরু করেন।

শুধু পারিবারিক সহিংসতাই নয়, পরিবারের বাইরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র, রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন স্থানে যৌন হয়রানি, হেনস্তা ও সহিংসতার শিকার হতে হচ্ছে নারীকে। যেমন ঢাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে গত সপ্তাহে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলেছেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষক এরই মধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন, চলছে আইনি প্রক্রিয়া। একই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রী তুলেছেন হয়রানির অভিযোগ। বিষয়টির তদন্ত চালাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ইউএনডিপি বাংলাদেশ, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও সিআরআইয়ের যৌথ জরিপের তথ্য বলছে, দেশে প্রায় ৮৭ শতাংশ নারী জীবনে অন্তত একবার হয়রানির শিকার হয়েছে। বাস-লঞ্চ-ট্রেন স্টেশনসহ গণপরিবহনে ৩৬ শতাংশ নারী নিয়মিত যৌন হয়রানির শিকার হয়। ৫৭ শতাংশ নারী গণপরিবহনকে সবচেয়ে অনিরাপদ মনে করে। গণপরিবহন ছাড়া রাস্তা, শপিং মল, অনলাইন প্ল্যাটফরমগুলোয় নারী হয়রানি হয় সবচেয়ে বেশি। যৌথ জরিপের ফলাফল অনুসারে, দিনের বেলা নারী হয়রানির শিকার হয়। ৫২ শতাংশ নারী দিনে হয়রানির শিকার হয়েছে এবং বেশির ভাগ ঘটনা বিকালের দিকের। হয়রানির পর ৩৬ শতাংশ নারী প্রতিবাদ করেছে। হয়রানির শিকার মাত্র ১ শতাংশ নারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা চেয়েছে। আর প্রকাশ্যে হয়রানির শিকার হয়েও ৪৪ শতাংশ নারী কোনো সহযোগিতা পায়নি।

পরিসংখ্যান অনুসারে, নারীর প্রতি সহিংসতা বাংলাদেশে ধারাবাহিকভাবে অন্যতম উদ্বেগজনক বিষয়। বিশেষ করে ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যা, যৌন হয়রানি, পারিবারিক নির্যাতনসহ শিশু হত্যা ও নির্যাতন ঘটেই চলেছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালে সারা দেশে ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৫৭৩ নারী। এর মধ্যে ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যার শিকার ৩৩ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছে পাঁচজন। ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছে ১২৯ জন। এর মধ্যে ধর্ষণচেষ্টার পর হত্যা করা হয়েছে তিনজনকে, ধর্ষণচেষ্টার কারণে আত্মহত্যা করেছে তিনজন। গত বছর যৌন হয়রানি ও উত্ত্যক্তের শিকার হয়েছে অন্তত ১৪২ নারী। এসবের প্রতিবাদ করতে গিয়ে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছে ১২২ পুরুষ। বছরটিতে উত্ত্যক্তের কারণে আত্মহত্যা করেছে ১২ নারী। এ ছাড়া যৌন হয়রানির প্রতিবাদ ও উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করতে গিয়ে চার নারী ও চার পুরুষ খুন হয়েছে। এমনকি অনলাইনেও নারী নিরাপদ নয়; এ মাধ্যমেও বাড়ছে নারীর প্রতি বৈষম্য, অবমাননা ও যৌননিপীড়ন। আসক বলছে, গত বছর পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৫০৭ নারী। এর মধ্যে নির্যাতনের কারণে মারা গেছে ২৯২ জন এবং আত্মহত্যা করেছে ১৪২ জন। ২০২২ সালে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিল ৪৭৯ নারী। অন্যদিকে ২০২৩ সালে যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১৪২ নারী। এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের পর হত্যার শিকার হয়েছে ৬৪ নারী এবং আত্মহত্যা করেছে ছয় নারী।

বিশ্লেষকরা বলছেন, কঠোর আইনের প্রয়োগের পাশাপাশি নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতনের মতো সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে নতুন প্রজন্মকে সোচ্চার করে গড়ে তুলতে হবে। সংঘটিত যৌননিপীড়নের প্রতিরোধ, পর্যবেক্ষণের জন্য একটি কমিটি থাকা আবশ্যক। মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নারীধর্ষণ ও অ্যাসিড নিক্ষেপ কমে এলেও পারিবারিক নির্যাতন বেড়েছে। এর কারণ আমাদের সমাজে ছেলেমেয়ের যখন বিয়ে হয় তখন কোনো কাউন্সেলিং থাকে না। সংসার করার ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মানসিকতার পরিবর্তন দরকার এবং কিছু ক্ষেত্রে ছাড়ও দিতে হবে। অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারের কারণে যে মনোযোগ একজন স্বামী বা স্ত্রীর সংসারের জন্য দেওয়ার কথা তা দিতে পারছেন না। আবার টিভিতে বিভিন্ন সিরিয়াল দেখার জন্য অনেকে ব্যস্ত থাকেন। পুরুষও মোবাইলের অতিরিক্ত আসক্তির কারণে নেতিবাচক বিষয়ে জড়িয়ে পড়ছেন। এ বিষয়গুলো দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় পারিবারিক সহিংসতার মাত্রাও অনেক বেড়ে যাচ্ছে। কর্মজীবী নারীকে ঘরের বাইরের কাজ করার পাশাপাশি মনে রাখতে হবে, ঘরে তার সন্তানের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে হবে। কারণ সন্তানরা মাকে বেশি কাছে চায়। আবার স্বামীরও দায়িত্ব স্ত্রী কর্মজীবী হলে তাকে সহায়তা করা এবং সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া।’

গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘নারীর জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, কর্মস্থল কোথাও আমরা নিরাপদ করতে পারিনি। নারী নির্যাতন যে সম্প্রতি শুরু হয়েছে তা নয়, দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। এগুলো প্রতিহত করতে আইন, নীতিমালা, সরকারের সদিচ্ছা, মহামান্য আদালতের নির্দেশনা সবই রয়েছে। কিন্তু চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না তা দেখভালে মনিটরিংয়ের অভাব। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর চুল কাটার ঘটনায় প্রধান শিক্ষক সাফাই গাইলেন যে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করায় চুল কেটে দেওয়া হয়েছে। এটা তার জানা উচিত ছিল, শিক্ষার্থীকে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি দেওয়া অপরাধ। শিক্ষা প্রশাসন, স্থানীয় সরকার, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে মনিটরিং জোরদার করতে হবে।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর